পুরুষ বাক্স

চার বছরের এক বাচ্চাকে নিয়ে বাবা বসে আছে পার্কে। বাচ্চাটা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে! তার বেলুন উড়ে গেছে, গ্যাসের বেলুন। আশেপাশে কোনো বেলুন বিক্রেতাকেও দেখা যাচ্ছে না। বাবা তার ছেলের কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বললেন, ‘বোকা ছেলে, কাঁদছে দেখ! ছেলেরা আবার কাঁদে নাকি! আর তুমি বেলুন দিয়ে কি করবে মেয়েদের মতো!’ ছেলে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে, বাবার কথা তার কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট না। সে শুধু এইটুকু বুঝতে পারছে তার কান্না করা উচিৎ হচ্ছে না। কিন্ত তার মন তো মানতে চায় না, তার সাধের বেলুন, উড়ে গেল। তাকে কাঁদতে না করা হচ্ছে, সংগত কারণেই তার মন কারণ খুঁজছে যে কেন সে কাঁদবে না, এত কষ্ট লাগার পরও! ‘কারণ সে ছেলে’, বাবার কথা মনে পরে আবার।
মনকে যে বসে আনতে পারে সেই মহামানব, তবে তার একটি সুস্থ উপায় আছে। এখানে বাচ্চা ছেলেটাও তার মনকে বসে আনতে শিখছে, শুধু উপায়টা পাশবিক। উপরের গল্পটাকে বিচ্ছিন্ন ধরে নিই। একটু অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক।

আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজে দু’একটা নারী নির্যাতন বিষয়ক খবর পড়েই থাকি। আর খবর গুলোর মধ্যে এক সুন্দর মিল পাওয়া যায়। প্রতি ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী এক বা একাধিক পুরুষ। মারধোর টাইপ নির্যাতনের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম অবশ্য দেখা যায়, কিন্ত আজ পর্যন্ত এরকম খবর হয়ত খুব বেশী মানুষ দেখেননি যে ‘একাধিক নারী দ্বারা যৌন হয়রানির স্বীকার হলো স্কুল ছাত্রী’! যাই হোক, এই ব্যাপারে আমরা মোটামুটি একমত যে নারীরা নির্যাতিত হয় প্রধানত পুরুষ দ্বারা।

কালে কালে প্রচুর মহাপুরুষের আগমন দেখেছি আমরা। তাদের বিচরণ অনেক দিকে। নারী-পুরুষ এলাকাতেও তাদের রয়েছে বিভিন্ন তত্ত্ব। বিশ শতকের এমন একজন মহাপুরুষ হচ্ছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। আধুনিক পুরুষতন্ত্রের জনক। আজও তাঁর সব উক্তি মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও অনুসরণ যোগ্য। কিন্তু নারী সম্পর্কে তাঁর অনেক উক্তিই ছিল অবৈজ্ঞানিক। ফ্রয়েড পিতৃতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও কুসংস্কার দিয়ে, যাকে তিনি বলেছেন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। ফ্রয়েড বেড়ে উঠেছেন চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে। যেখানে পুরুষের হাতে থাকে সব ক্ষমতা ও নারী থাকে নির্জীব কীটের মতো- যে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না বা সে ধারণা তাকে দেয়া হয়না। সেখানে নারী ও পুরুষ, উভয়ের কাছেই নারীমুক্তি ব্যাপারটা খুব উদ্ভট ঠেকে। ফ্রয়েডের কাছেও তাই।

বিশ শতকের মানুষজন বিজ্ঞানের প্রচুর মহিমা দেখেছে। তাদের কাছে পুরাণের চেয়ে বিজ্ঞান বেশী গ্রহণযোগ্য হবে তাই স্বাভাবিক। তারা ফ্রয়েড দ্বারা সম্মোহিত হয়েছিল কারণ তাঁর ব্যাখ্যাগুলো ছিল বাহির থেকে নিখুঁত বিজ্ঞান, অথচ ভেতরে ভয়ংকর কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আসলে তাঁর বিশ্লেষণ সাধারণ ধর্মীয় পুরাণ ছাড়া কিছুই ছিল না। তিনি দিনে দিনে প্রকাশ করেছেন তথাকথিত মনের ‘অদৃশ্য সূত্র’। তিনি মানুষকে বুঝিয়েছেন লিবিডো আর শীশ্নাসূয়ার পুরাণ। সবাই অবশ্য তা মেনে নেননি। যেমন টমসন, অ্যাডলার প্রমুখ। তাঁরা মানুষকে আলো দেখাতে চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের কথা মানুষ শুনেনি। পুরাণের ক্ষমতা অনেক। মানুষকে সম্মোহিত করার সবচেয়ে বেশী ক্ষমতা খুব সম্ভবত এরই আছে। আর তাতে যদি পরানো হয় বিজ্ঞানের মুখোশ, আর কী প্রয়োজন?

বর্তমান পৃথিবী অনেক উন্নত। তবে মানুষের এক বিশাল অংশ আছে অন্ধকারে। যদিও তারা জানে না তারা কোথায়। জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। হুমায়ূন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ বইটির ভূমিকায় একটি চমৎকার উক্তি আছে- “এক বড় অশুভ সময় এসেছে পৃথিবীতে, যারা অন্ধ তারাই চোখে সবচেয়ে বেশী দেখতে তো পাচ্ছেই, তারা অত্যন্ত বেশী বিশ্বাসও করছে, এবং পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বাসের বিকট মহামারী।”

লৈঙ্গিক রাজনীতির উদ্ভবে সরাসরি ভূমিকা রাখে ধর্ম। ইসলাম, খ্রিষ্টান, ইহুদিদের ধর্ম অনুযায়ী নারীর জন্ম পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে। ইহুদীদের প্রাচীন পুরাণ অনুসারে- ঈশ্বর আদুমের জন্য একজন সুন্দরী, সতী, পতিপ্রায়ণা স্ত্রী সৃষ্টির জন্য তিনবার উদ্যোগ নেন। সেই পুরাণ অনুযায়ী আদমের প্রথম স্ত্রীর নাম লিলিথ। লিলিথের মতে- সেও আদমের মতোই একই ভাবে তৈরী। তাই আদমের কর্তৃত্বমূলক মনোভাব তাঁর পছন্দ হয়নি। পরে আদম যখন উত্তেজিত হয়ে লিলিথের উপর বল প্রয়োগ করে বাধ্য করতে চাইল, তখন লিলিথ মন্ত্র পাঠ করে বাতাসে মিশে গিয়ে স্বামী ত্যাগ করল। ঈশ্বর আবার আদমের স্ত্রী সৃষ্টির উদ্যোগ নেন। এবার তার নাম দেন হাওয়া। তবে তাকে পুরোপুরি সৃষ্টি করতে পারেননি। হাওয়াকে সৃষ্টির সময় আদম তা দেখে ফেলে ও সৃষ্টির প্রক্রিয়ার প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে। তাই এই স্ত্রীও পরিত্যাক্ত হয়। সবশেষে ঈশ্বর আদমের পাঁজরের একটি অতিরিক্ত হাড় থেকে এমন এক হাওয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হোন যে আদমের স্ত্রী হিসেবে যোগ্য, অর্থাৎ যে পতিপরায়ণ। এই পুরাণ সরাসরি ইঙ্গিত করছে যে নারী তার স্বামীর প্রতি বাধ্য থাকবে- সে এমন করেই সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দু পুরাণ এ দিক দিয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে, সেখানে আছে- মনু বলেছেন, ‘পতি সদাচারহীন, পরদাররত বা গুণহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রী পতিকে দেবতার মতো পূজা করবে’ [৫:১৫৪]

পুরাণমতে পুরুষ সৃষ্টিকর্তার অনন্য ও সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি। আর নারী হচ্ছে বিকলাঙ্গ ও অসুম্পূর্ণ। ইহুদী পুরুষরা ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনা করেন- ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, কেননা তিনি আমাকে নারী করেননি।’ যুগে যুগে আসা প্রবাদ পুরুষের বেশীরভাগই তা বিশ্বাস করতেন। প্লাটো দু’কারণে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছেন। প্রথমত- প্রভু তাকে স্বাধীন মানুষ করেছেন; ক্রীতদাস করেন নি। আর দ্বিতীয়ত- প্রভু তাকে নারী করেন নি। পিথাগোরাস বলেছেন- “রয়েছে এক শুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে, আলোক ও পুরুষ। রয়েছে এক অশুভ নীতি, যা সৃষ্টি করেছে অন্ধকার ও নারী।”

সনাতন ধর্ম গুলোতে নারীদের পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে আরো ভয়ঙ্কর ভাবে। এসব রীতিনীতি-পুরাণ-ধর্ম’­ এর রয়েছে মানুষকে সম্মোহিত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা। এসবের আছে মানুষকে পুরোপুরি অন্ধ করে দেয়ার শক্তি। এসবের সৃষ্টি হাজার বছর আগে। আজও যা মানুষকে কামড়ে ধরে আছে। অসুস্থ করে তুলেছে সমাজ, নারী ও পুরুষকে।

ফিরে আসি একদম প্রথমে বলা গল্পটিতে। যেখানে বাবা তার ছেলেকে শেখায় কান্না না করতে। কেননা কান্না হচ্ছে মেয়েদের কাজ। এটি একটি ছোট্ট উদাহরণ। ছেলেদের আরো ভয়ঙ্কর সব শিক্ষা দিয়ে বড় করা হয়। সমাজে নারীরা যদি বাস করে কারাগারে, তাহলে পুরুষেরা বাস করে একটি বাক্সে। বাক্সটি তাকে গড়ে তুলে পুরুষ হিসেবে, মানুষ করতে পারে না। সে জন্মের পর থেকেই প্রশিক্ষিত হতে থাকে এই বাক্সের নিয়ম অনুযায়ী। যাতে বলা আছে তুমি পুরুষ, তোমার কাঁদা চলবে না, রাগ ছাড়া কোনো আবেগের প্রকাশ তোমাকে মানায় না, নারী থাকবে তোমার অধীনে, নারীকে অধীনস্ত করার মাধ্যমে প্রকাশ পাবে তোমার পুরুষত্ব। যে পুরুষ এর বিপরীতে যায়, সে ধর্ষিত হয়, মানসিক ভাবে। তাকে সবাই চিহ্নিত করে পুরুষত্বহীন হিসেবে। যদিও শারীরিকভাবে অন্য পুরুষের সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই। সমাজে মেয়েদের পোশাক, পছন্দের রঙ, প্রসাধনী আলাদা করা আছে। পুরুষের এসব পছন্দ করাও পাপ। তার এসব পছন্দ হল মানে সে তার পুরুষত্ব হারালো। তাই পুরুষের মানুষ হওয়ার চেয়ে ‘পুরুষ’ হওয়াটা অনেক বেশী জরুরি। এতে যদি তাকে বিবেকহীন হতে হয়- সমস্যা নেই। বেলুন হারিয়ে গেলে তার কাঁদা চলবে না। হোক সে চার বছরের অবুঝ শিশু। নারীকে তার অধীনস্ত করার আগ পর্যন্ত সে পুরুষ নয়। নারী তাকে সমীহ করে না চললে সে পুরুষ নয়। তাই পরিবারে তাদের সব নিয়মকানুন শিখিয়ে দেয়া হয়, ছোটবেলা থেকে, যাতে তাদের ছেলেকে কেউ অসম্মান না করতে পারে। একটা ছেলে কে অসম্মান করতে চাইলে তা করা খুবই সহজ। তাকে চরিত্রহীন, চোর ইত্যাদি বললে সে যতটুকু অসম্মানিত হবে তার চেয়ে অনেক বেশী হবে যদি তাকে মেয়ে ডাকা হয়।

“If it would destroy a 12-year-boy to be called a girl, what are we then teaching him about girls?” – Tony Porter.

পুরুষ বাক্সই মানুষ থেকে আলাদা করে পুরুষকে, আর পুরুষ থেকে নারীকে। নারী মুক্তির আগে প্রয়োজন অন্য একটি জিনিস, শুনতে হাস্যকর লাগলেও তা হচ্ছে পুরুষের মুক্তি, পুরুষ বাক্স থেকে। বর্তমানে প্রচুর প্রতিষ্ঠান কাজ করছে নারী মুক্তির জন্য, কেউ কেউ তার সাথে চাচ্ছে পুরুষের মুক্তিও। তাদের প্রচেষ্টা সফল হোক, মুক্তি পাক নারী, পুরুষ ও মানুষ।

“Now I also want to say, without a doubt, there are some wonderful, wonderful, absolutely wonderful things about being a man. But at the same time, there’s some stuff that’s just straight up twisted. And we really need to begin to challenge, look at it, and really get in the process of deconstructing, redefining, what we come to know as manhood” – Tony Porter (Co-founder, A Call to Men)

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, ঢাকা।

Loading

Leave a Comment