যৌন নিপীড়ন ইস্যুতে

সম্প্রতি আমি দাদাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার নানী থাকেন, কারণ তিনি সে বাড়িরই মেয়ে। ফেরার সময় আমার নানুমণির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিলো, আমি কাঁদছিলাম। ভ্যানে করে অনেকটা ইটের রাস্তা পেরিয়ে তবে বিশ্বরোডে ওঠা যায়। অপর দিক থেকে দেখলাম অনেকগুলো ছেলে নিয়ে একটি ভ্যান আসছে। প্রত্যেকটা ছেলের হাতে আম, তারা আম খাচ্ছে। আমাদের ভ্যান পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে সবগুলো ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে একসাথে চিৎকার করে উঠলো, “কি মজা!” ওরা আম খেয়ে মজা পাচ্ছে এটা আমাকে বলার কি হলো আমি বুঝিনি। আমি তো আম নই। এমনিতেই কাঁদছিলাম, চোখের পানি দ্বিগুণ জোরে পড়তে লাগলো। ওদের কি প্রাপ্তি হলো ওরাই ভালো বলতে পারবে।

যৌন নিপীড়ন এমন একটা বিষয়, এটা যতক্ষণ না কারো নিজের সাথে ঘটছে, ততক্ষণ সে বুঝতে পারছে না কষ্টটা কি রকম হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোর কারণ হচ্ছে, এগুলো তাদের সাথে হয় না বা হলেও খুব কম। যাঁরা দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা মানব নন, মহামানব। আজ যদি রাতারাতি দাবার ছক উল্টে গিয়ে মেয়েরা নিপীড়ন শুরু করে দেয়, “তুই আলখেল্লা পড়িসনি, তোর গিরার নিচে কাপড় ছিলো” বলে ফেসবুকে মাতামাতি শুরু করে দেয়, তবে আমার মনে হয় সমাজের চিত্রটা অনেকখানি বদলাবে। তবে এটা নিঃসন্দেহে কোনো সমাধান নয়, প্রতিশোধ।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এদেশের বেশির ভাগ মেয়েরই এসবে কিছু যায় আসে না নববর্ষে টিএসসিতে হওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে যে কয়টি সমাবেশ হয়েছে তাতে আমি মনে করতে পারি না আমার কোনো সহপাঠিনীকে দেখেছি। অথচ সেদিন তারা ঠিকই কেএফসি-বিএফসিতে খেতে গিয়েছে, চেক-ইন দিয়েছে, সেলফি আপলোড দিয়েছে, দিনশেষে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, “কি পেলি?” আমি ওদের প্রশ্নের উত্তর দেইনি। আমি জানি আমি কি পেয়েছি। আমি সেখানে শুধুমাত্র ঐ মেয়েগুলোর জন্যই দাঁড়াইনি, নিজের জন্যও দাঁড়িয়েছি। আমি প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে বেড়াতে যাই, আমি চাই না এ ধরনের ঘটনা আমার সাথে ঘটুক। আমার বড় আপুটার সাথে ঘটুক। ছোট বোনটার সাথে ঘটুক। বান্ধবীদের সাথে ঘটুক। আমি সকলের নিরাপত্তা চাই।

একটা মেয়ের ঘৃণ্য দৃষ্টি উপেক্ষা করে চলে যাওয়া খুব সহজ, কিন্তু তার শ্রদ্ধা পাওয়া কি সহজ? একটা মেয়েকে ‘সব ছেলেরা খারাপ’ বলতে বাধ্য করাটা খুব সোজা, কিন্তু “নাহ ছেলেরা অনেক ভালো” বলানোটা কি সোজা? আপনারা মনে করেন চুলে স্পাইক, রঙ বেরঙের সানগ্লাস, “ইয়ো” ভাব নিয়ে চললেই বুঝি হিরো হওয়া যায়। আপনারা বোঝেন না, মেয়েরা কি চায়। আপনারা বোঝেন না, মেয়েদের কাছে সম্মানের কি মূল্য। পথে ঘাটে, বাড়িতে, সভা সেমিনারে, স্কুল কলেজে অনেক মেয়েকে কাঁদান আপনারা। কিন্তু আপনারা জানেন না, আপনাদের কাছ থেকে সম্মান পেলেও অনেক মেয়ের চোখে পানি এসে যায়। সেটাকে অশ্রু নয়, আনন্দাশ্রু বলে। যেদিন আপনাদের কাছে মেয়েদের অশ্রুর চাইতে আনন্দাশ্রু মূল্যবান হয়ে উঠবে, সেদিন দেখবেন আপনার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। অন্যরকম আনন্দ লাগছে। দেখবেন দেশটার সাথে আপনিও নিজের কাছে কত সুন্দর হয়ে উঠেছেন। সকলের জন্য শুভকামনা।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল ও কলেজ।

Loading

Leave a Comment