Barbie Politics: বার্বির রূপকথা, বার্বির রাজনীতি

১৯৫৯ থেকে বর্তমান সময়টাকে কি কোনো নাম দেয়া যায়? যায় বটে। বার্বি যুগ বলতে কোনো কিছু শুনেছেন কি? একে ঠিক তাই বলা যায়।
বার্বি – বর্তমান বিশ্বে মেয়ে শিশুদের কাছে এক জনপ্রিয় খেলনার নাম। এই সহজ সরল খেলনাটি নিয়ে খুব গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় খুব কম মানুষই পান। ছোটবেলায় পুতুল খেলা আমরা কে না খেলেছি? আবার, এ নিয়ে ছেলেদের বিদ্রূপও কম শুনতে হয়নি। তবুও সঙ্গে সঙ্গে এক অভিযোজন ক্ষমতাকে বেড়ে উঠতে দিয়ে রীতিমত জেদ করেই খেলেছি বলা যায়। কিন্তু বড় হওয়ার পর, সেই না বুঝে করা বিদ্রূপটুকু নিয়ে ভেবে দেখার সময়টাও আমাদের থাকেনা বৈকি !
বার্বি ডলের গোড়ার ধারণাটিও সেখান থেকেই এসেছে।
পুতুলখেলা। একটি নিষ্পাপ বিনোদন। এই খেলনা দিয়েই শুরু হয় প্রথম বিভাজনটি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুতুল খেলারত মেয়েটিকে দেখে হাসাহাসি করে কোনো ছেলে শিশু। আবার বাবা-মারাও কী কম যান? “না,বাবা, তুমি কেন পুতুল খেলতে চাইছো? ওসব মেয়েদের খেলনা” এটি নিঃসন্দেহে সবাই-ই শুনে এসেছেন।
এ ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করবো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসরিন খন্দকারের কথাগুলো-“ এর কারণ কি এই যে, একদম শৈশব থেকেই তারা তাদের চারপাশের মতাদর্শ থেকে জেনে নিয়েছে পুতুলখেলার মেয়েলি জগত পুরুষালি জগতের তুলনায় হেয় ? তারা কি একভাবে তখনই পরিবার থেকে, চারপাশের মানুষ থেকে বুঝে নিতে শুরু করেছে যে, বাবা হচ্ছে সংসারের প্রধান, মা তার অধস্তন ? নারী-পুরুষের সামাজিক ভূমিকাগত পার্থক্যের সঙ্গে এর মধ্যকার ক্ষমতার সম্পর্কও কি ওদের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ?”
পদ্ধতিটা নিঃসন্দেহেই এক অতি বৃহৎ পার্থক্য গড়ে দেয়ার একদম শুরুর দিকের সূক্ষ্মতম এক ফাটল। এটি খুবই সূক্ষ্ম, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে অনুসন্ধান করলে তবেই আমি বা আপনি বুঝতে পারবো- এমন বলাটা অন্যায় হবে না।
এবার আসি নিষ্পাপ সৌন্দর্য্যের অধিকারিনী বার্বি ডলের কথায়। খেলনা প্রস্তুতকারী কোম্পানি ম্যাটেলের উদ্ভাবন এই বার্বি। নিজের কণ্যা শিশুকে বড়দের মতো পুতুল বানিয়ে তা নিয়ে খেলতে দেখেই বার্বি বাজারজাত করার আইডিয়াটি প্রয়োগ করেন ম্যাটেলের অন্যতম এক কর্ণধার রুথ হ্যান্ডলার । এভাবেই ১৯৫৯ সাল থেকে রমরমা বাণিজ্য করে আসছে এই অতি জনপ্রিয় বার্বি ডল।
বার্বি জন্ম যে বছর, স্নায়ুযুদ্ধের বহুল আলোচিত নিক্সন ও ক্রুশ্চেভ – এর ‘রান্নাঘর বিতর্ক’ হয় সে বছরেই, অর্থাৎ, ১৯৫৯ সালে। বিতর্কটি ছিল গৃহস্থালী সামগ্রীর উদ্ভাবনে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের তুলনামূলক দক্ষতা নিয়ে, যার স্টেজটি তৈরি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পড়ে, এমন একটি আদর্শ শহুরে রান্নাঘরের নকশায়! ঘরে শ্রম কমাতে পারে এমন সব গৃহস্থালী সামগ্রী যেমন: ওয়াশিং মেশিনসহ টেলিভিশন, পেপসি কোলা, হাই হিল, এমনকি লিপস্টিকের মত নানান বিলাসী দ্রব্যও সেখানে মজুদ ছিল। আমেরিকার পুঁজিবাদী বাজারের সুফল বার্তা পৌঁছানোই ছিল এই নকশার উদ্দেশ্য। অন্যদিকে, সমাজবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন এসবের পরিবর্তে গুরুত্ব দেয় জীবনধারনের জন্য দরকারি জিনিসপত্র উদ্ভাবন ও উৎপাদনে। বিতর্কের একটি পর্যায়ে তাই সোভিয়েতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ জানতে চান, মুখে খাবার তুলে দিতে পারে এমন কোনো পণ্য মার্কিন বাজারে আছে কি না!
এটি ছিল সম্মুখযুদ্ধের একধরনের আপাত শান্তিময় বিকল্প, হেঁয়ালি মনে হলেও তাই স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়টিতে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যকার প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই সভা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই নব্য মার্কিনি মতাদর্শ নিমেষেই যুদ্ধের বিকৃত অভিজ্ঞতা, পারমাণবিক অস্ত্রের হত্যাযজ্ঞ, রাজনৈতিক সচেতনতা – সব ভুলিয়ে দিয়ে বিলাসে গা ভাসানোকে গুরুত্বপূর্ণ করেছিল ।
এরকম সময়ে রুথ বেড়াতে গিয়েছিলেন জার্মানিতে। তখনকার জার্মানের জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড ছিল ‘বিল্ড ৮’। এতে প্রকাশিত এক কার্টুন চরিত্র ছিল লিলি, যে কিনা তার উচ্চাবিলাষী অর্জনের পথ হিসেবে ব্যবহার করে তার নারীত্ব ও যৌনতাকে। যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সমাজে, যৌনবাদী পুরুষের জগতে ক্রমেই লিলি একটি জনপ্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠে। লিলি পুতুল প্রাথমিকভাবে বিক্রি হতো অ্যাডাল্ট শপে। পরবর্তীকালে বাচ্চার খেলনা হিসেবে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। আর দূরদর্শী রুথ? তিনি এই পুতুলের ব্যবসা নিয়ে তুমুল সম্ভাবনা দেখতে পান। এ সময় তিনি সেখানে থেকে নিয়ে আসেন লিলি নামক পুতুলটি।
এরপরের কাহিনী হলো লিলির অনুকরণে নতুন পুতুল বার্বি তৈরি করা। এর জন্য ম্যাটেল কোম্পানি বেছে নেয় যুদ্ধাস্ত্র নকশাবিদ জ্যাক রায়ান-কে।
এখন প্রশ্ন ওঠে, পুতুল তৈরিতে যুদ্ধাস্ত্র নকশাবিদকে কেন দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো?
উত্তরটা শুনলে চমকেই উঠতে হয়। জ্যাক রায়ানকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়, কেননা তিনি যুদ্ধাস্ত্রের মত ভয়ানক জিনিসকে নিরীহ বেশে ঢেকে দেওয়ার দক্ষতার কারণে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আর এভাবেই যৌন উপকরন লিলি পুতুলের পুনর্জন্ম ঘটেছিলো আরেকবার , শিশুর খেলনা হিসেবে। অর্থাৎ, স্নায়ুযুদ্ধের বিলাসিতার আরেক বিকৃত সত্তা হিসেবেই জন্ম নেয় বার্বি ।
আনুপাতিক হারে বারবির শরীরের মাপ মানব শরীরের ছয় ভাগের এক ভাগ। মানব শরীরের আকারে একে ধরা গেলে বারবির উচ্চতা দাঁড়ায় পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। শরীরের মাপ দাঁড়ায় ৩৬”-১৯”-৩৩”। বারবির ওজন মাপক যন্ত্রতে বারবির ওজন দেওয়া থাকে ১১০ পাউন্ড। যথার্থ যৌনাবেদনময়ী হওয়ার জন্য বারবিকে করা হয়েছে বিশালবক্ষা, যা কোনভাবেই তার শরীরের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই শেষ নয়। বারবির রয়েছে এক বিশেষ দাঁড়াবার ভঙ্গি। বারবি পুতুল যেন এমন একটি কাজেই নেমেছে যেন সে খুব ছোটবেলাতেই বাচ্চা মেয়েদের শিখিয়ে দিতে পারে কীভাবে মোহনীয় ভঙ্গিতে নিজেকে মেলে ধরতে হবে। বলতেই হয়,অদ্ভুত চিকন শরীর, তুলনামূলক বড় মাথা, উচ্চতা-সব মিলিয়ে অসম্ভব এক শরীরী আদর্শ নিয়ে বারবিকে মেয়েদের আইকন হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে!
বার্বি বিজ্ঞাপনের গানটিও সেক্ষেত্রে খাসা। গানটি হলো- “আমি শুধু তোমার মতো হতে চাই” (“I want to be just like you”)। বার্বিকে অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে শিশুদের সামনে উপস্থাপন করতে এটি যথেষ্ট। এছাড়াও বার্বি মতো পোশাকের (Barbie look alike clothes) বাণিজ্য তো রয়েছেই!
এই বার্বি কিন্তু পুঁজিবাদ ও ব্যবসাকে দারুণভাবে প্রমোট করে। ছোট মেয়েদের আবেগের জায়গা দখল করে থাকা বার্বির সবচেয়ে প্রিয় কাজ কোনটা বলুন তো? তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো শপিং করা। এবং তার স্লোগানই যেন, শপিং কর, পিৎজা পার্টি করো! বার্বি আরো বলে, “Maths class is tough”! বুঝুন তবে,পড়াশোনার প্রতি কী বিশাল অনীহা দেখায় জনপ্রিয় এই বার্বি! যাকে কিনা আবার দেখাতে চাওয়া হয় মেয়েদের আইকন হিসেবে!
বার্বি কেবল একটি পুতুলই নয়, একটি বিশাল ব্র্যান্ড যার রয়েছে বিশাল আকৃতির এক পরিবার (!) এবং প্রচুর বন্ধুবান্ধব। তাকে নিয়ে পরিপূর্ণভাবে খেলার জন্য রয়েছে বাড়িঘর, আসবাবপত্র এমনকি শপিংমল!
বার্বি ব্র্যান্ডের জেনারেল ম্যানেজার ডিকিনসন সদর্পেই বলেন, ”বারবির গবেষণা দল অন্যান্য অনেক উপাদানের মতো মেয়ে বাচ্চাদের জন্মদিনের ভিডিও বিশ্লেষণ করে আবিষ্কার করে যে, বার্বির কল্যাণে মেয়েশিশুর ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার ভঙ্গি পাল্টে গেছে”। তার ভাষায় এই দাঁড়াবার ভঙ্গি “কিছুটা এ্যাগ্রেসিভ, কিছুটা সেক্সি”!
ছোট একটি মেয়ের মাঝে হয়তো এই ভাবটি আসা অসম্ভব। তার পক্ষে সমাজের ছলচাতুরী বোঝাও খুবই কঠিন একটি বিষয়। তবে এই বার্বির আদর্শ নারী ভূমিকায় মনোরঞ্জনকারিনী সুন্দর অবয়ব, তার ভবিষ্যৎ জীবনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। কেননা ব্যাপারটি মনস্তাত্ত্বিক এবং এর মাধ্যমে খুব সূক্ষ্মভাবে শিখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাহিদামত মেয়েদের ভূমিকা কী হওয়া চাই। এর প্রভাব? হ্যাঁ, এবার তাই নিয়ে কথা হোক।
হলিউডের বাঘা বাঘা অভিনেত্রীদের অভিযোগ, তাঁদের পারিশ্রমিক এর পরিমাণ অভিনেতাদের তুলনায় কম। এবার সিনেমায় নারীর ভূমিকা দেখি। নারীকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিনেমায় ব্যবহার করা হয় শুধুই ‘গ্ল্যামার’ আনার জন্য,সৌন্দর্যের জন্য। অথচ একজন মেয়ে অথবা একজন মা কিংবা একজন বোনের বা স্ত্রীর ভূমিকা কি কেবলই সুন্দরী হয়ে ওঠা? সংসারের রাশ তো তাঁরাই টেনে ধরেন। শক্ত হাতে সব সামলান। তাহলে এরপরও নারী ভূমিকার কোনো স্বীকৃতি দিতে আমাদের দু’বার ভাবতে হবে কেন? কেনই বা শুধু সিনেমার গ্ল্যামার বাড়াতে নারীকে ব্যবহার করা হবে?
আরেকটি চমৎকার উদাহরণ দিই। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের প্রোফাইল পিকচারে ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে পূর্ণবয়স্ক, আবেদনময়ী,লাস্যময়ী বার্বির ছবি। এ থেকেই ‘বার্বি রাজনীতি’র উদ্দেশ্যটি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়! কিছু বোঝার আগেই কীভাবে আমরা বার্বি হয়ে ওঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাচ্ছি, তাও প্রমাণিত হয়! সৌন্দর্যচর্চা, শপিং-বারবির প্যাশন হওয়ার ফলেই বার্বিকে প্রমোট করার মাধ্যমে শুধু বার্বিরই নয়, প্রচার হয়ে যায় বিলাসী অন্যান্য দ্রব্যেরও। আর এখানেই ব্যবসায়ীদের লাভ!
বার্বি হয়ে উঠতে চাওয়ার তীব্র যে পাগলামো, তার চলতি নাম ‘বারবি সিন্ড্রোম’। এর উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করবো সিন্ডি জ্যাকসন এর নাম। বার্বির শরীরের আদর্শকে ‘অন্ধ অনুকরন’ করতে গিয়ে চৌদ্দ বছরে তিনি প্লাস্টিক সার্জারি করেন একত্রিশবার! আর এভাবেই প্লাস্টিক পুতুল বার্বি হয়ে ওঠার স্বপ্ন পূরণ করে সিন্ডি নাম লিখিয়েছেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। এই সিন্ডি জ্যাকসন তার এতগুলো প্লাস্টিক সার্জারিকে ব্যাখ্যা করেন নিজ শরীরকে ইচ্ছামত আকার দেওয়ার ‘স্বাধীনতা’ হিসেবে। অথচ নিজেকে পালটে ফেলে বার্বি হয়ে ওঠা কতটা ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক – সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
পুরুষতান্ত্রিক নজরদারি বা Surveillance অনুসারে নারী শরীরের পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আদর্শ নারীর ওপর আরোপ করায় জোর দেয়া হয়। আর এই লক্ষ্যেই যেন বারবির ওজন কমানোর গাইডের স্পষ্ট ও প্রথম উপদেশ, “খেয়ো না”। বার্বির মতো চিকন শরীরের অধিকারী হতে গিয়ে অজস্র কিশোরী না খাওয়ার বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। অনেকক্ষেত্রেই এর শেষ পরিণাম মৃত্যু। আর এই বিষয়ে কিশোরীদের উৎসাহিত করতে কিংবা বাধ্য করতে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো ছোট মেয়েদের স্বপ্নের খেলনা, হাল আমলের বার্বি ডল।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্য যে কোনো মানসিক রোগে যে গড় মৃত্যু হার, তার চাইতে ‘না খেয়ে’ কিশোরী মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এক্ষেত্রে যে দুটি শব্দ বলতে হয় সেগুলো হল- অ্যানোরেক্সিয়া ও বুলিমিয়া ।
অ্যানোরেক্সিক নারী খাওয়া-দাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দেয় অথবা শুধু পানি খেয়ে থাকে (water diet)। আর বুলেমিক নারী একসাথে অনেক বেশী খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ পর স্বেচ্ছায় বমি করে সব খাবার উগরে দেয়। ১৯৮৩ সালে প্রখ্যাত ব্যান্ড কারপেন্টার এর গায়িকা ক্যারন কারপেন্টারের কথাই বলা যায়। তাঁর মৃত্যু অ্যানোরেক্সিয়ার কারণেই হয়েছিল।
এই ধরণের রোগের ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয় ও স্পটলাইটে আসে যখন প্রিন্সেস ডায়ানা তাঁর ডায়েট কেন্দ্রিক মানসিক বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করেন। এর পরে অনেক জনপ্রিয় পশ্চিমা তারকাও তাঁদের না খাওয়ার বিপত্তির কথা স্বীকার করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায় আরেকটি তথ্যও। বার্বির আবিষ্কারক রুথ হ্যান্ডলারের নাতনি স্টেসি হ্যান্ডলার তার ‘দ্য বডি বারডেন: লিভিং ইন দ্যা শ্যাডো অফ বার্বি’ বইটিতে তার ‘না খাওয়া বিপর্যয়’-এর কারণ হিসেবে বার্বি পুতুল ও তার দাদিকে দায়ী করেন।
সমাজবিশ্লেষক জিয়াউদ্দিন সরদারের মতে, “গত শতকের নারী যদি বন্দী হয় রান্নাঘরের বন্দীশালায়, এই শতকের নারী বন্দী তার নিজ দেহের কারাগারে”। বার্বি বাণিজ্যের পুরুষতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রোফিটের হিসেব কষা ভয়ানক দিকগুলো আমাদের শুধু বিস্মিতই করেনা, বরং আতঙ্কিতও করে। অন্তত তথ্য ও পরিসংখ্যান তাই বলছে।
বার্বিকে নিয়ে বহু সমালোচনা হয়েছে। এসেছে বহু নিন্দার স্রোতও। এরপরও বার্বি সদর্পে টিকে আছে মানুষের আবেগ ও ম্যাটেলের ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার জোরে। নিন্দার জোয়ারে ভেসে না যাওয়ার লক্ষ্যে ম্যাটেল যুগে যুগে বারবি নিয়ে তাদের কৌশল পাল্টেছে, যদিও আজও তারা তাদের মূলনীতি একটুও পাল্টায়নি।
সৌন্দর্য কোনোভাবেই নারীর একমাত্র হাতিয়ার নয়। “প্রকৃতিগতভাবে নারী সৌন্দর্যের প্রতীক, মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি “- এসব কথা নিতান্তই চোখে ধূলো দেয়া কথাবার্তা। নারী তার নিজ গুণেই অদ্বিতীয়া হয়ে উঠতে পারে। সুন্দর হতেই হবে-এ কথাটি বাণিজ্যের স্বার্থে প্রচারকৃত বাণী। নারী ভিনগ্রহের কোন প্রাণী নয়; নারীও মানুষ। নারী মানবজাতির মাঝে এক অনন্য সত্তা; বাণিজ্যের কোন বস্তু সে নয়।
বাচ্চা মেয়েদের মাঝে বার্বিপ্রীতি ঢুকিয়ে দিয়ে একদিকে যেমন মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য পূরণ করা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে টিপিক্যাল নারী, যে বার্বির মতোই অতি মেয়েলি শখ নিয়ে তার মেয়েলি জগতে বিরাজ করবে, বার্বি হবে যার আদর্শ – তাদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টাতেও বার্বির স্রষ্টারা সমানভাবে কাজ করে যাচ্ছে অতি দক্ষতার সঙ্গে।
বার্বি ডল যেন নারী নামক মাটির দলাকে পুরুষবাদের মর্জি মত গড়ে নেয়ার এক অব্যর্থ হাতিয়ার! বার্বি এমন এক অস্ত্র, যাকে মিছরির ছুরি বললেও নেহাৎই কম বলা হয়! তাই এখনও বার্বি তার গান গেয়ে যায়,আর নারীরাও আটকে থেকে যান তাদের সাজঘর কিংবা ডায়েটচার্টের কোয়ান্টিটিতে!

লেখকঃ সাহিত্য সম্পাদক, কাকাড্ডা ডট কম

দ্রষ্টব্যঃ এই প্রবন্ধটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নাসরিন খন্দকারের পুতুল খেলার রাজনীতি: বার্বি কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত!

Loading

Leave a Comment