বিউটি বোর্ডিংয়ে একদিন

পুরান ঢাকা। চারশ বছরের ইতিহাসে ঘেরা এই এলাকাটির কথা চোখ বন্ধ করে ভাবলেই ভেসে ওঠে পুরোনো লাল-হলদে বাড়ি, ঘুপচি গলি, ঘোড়ার গাড়ি, বাহারি খাবারের দোকান, বুড়িগঙ্গা আর প্রাচীনত্বের গন্ধ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সুবাদে এই কয়দিনে পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়িয়ে সেই প্রাচীনত্বের গন্ধ মাখার সৌভাগ্য আমাদের কয়জনের হয়েছে। যখনই ক্লাসের ছুটি তখনই আমরা বেড়িয়ে যাই নতুন কোনো জায়গায়, নতুন কোনো গন্ধ গায়ে মাখতে। এই ঘুরে বেড়ানোর নেশাতেই একদিন, কোনো রকম পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়াই আমরা চলে এসেছিলাম পুরোনো ঢাকার বাংলাবাজারে ১নং শ্রীশদাস লেনের বাড়িটিতে।

বাংলা সাহিত্যের পাঠক-বোদ্ধাদের কাছে হয়তো এই বাড়িটি তীর্থতুল্য। বলছিলাম, বিউটি বোর্ডিং-এর কথা। ছোট্ট গেট দিয়ে ঢুকে একটুখানি উঠোন পেরিয়েই অফিস ঘর। অফিস ঘরে চলছিলো জম্পেশ আড্ডা। আমরা খানিকটা উঁকি-ঝুঁকি দেয়ার চেস্টা করতেই ভেতরে ডেকে নিলেন অভ্যর্থনায় বসে থাকা ভদ্রলোকটি। ভদ্রলোকের নাম তারক সাহা। বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান স্বত্বাধিকারী। বিউটি বোর্ডিংয়ের ইতিহাস জানতে চাইতেই তিনি খুলে দেন গল্পের ঝুলি। ইতিহাস-সাহিত্যের ভালো বোদ্ধা বলে মনে হলো তাকে।

এই বাড়িটি ছিলো নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। তিনি বাড়িটিকে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে “সোনার বাংলা” পত্রিকার অফিস হিসেবে দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পত্রিকাটি চলে যায় কলকাতায়। পত্রিকা অফিস কলকাতায় চলে যাওয়ার পর সে বাড়ির দোতলায় আবাসিক হোটেল গড়ে তোলেন দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা। নলিনী মোহনের মেয়ে বিউটির নামে নামকরণ হয়  বিউটি বোর্ডিং।

[huge_it_slider id=”2″]

 

 

 

ততোদিন পূর্ব বাংলায় বাংলাবাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প। স্বাভাবিকভাবেই এখনকার শাহবাগ, কাঁটাবন কিংবা কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মতো করে এখানটাতেই গড়ে ওঠে সাহিত্য আড্ডা। তখন আশেক লেনে থাকতেন শামসুর রাহমান, প্যারিদাস রোডে বেলাল চৌধুরী। শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে। আর কাছাকাছি একটা দোতলা দালানে থাকতেন শহীদ কাদরী। এক কাপ চা কয়েকভাগ করে খেতে এখানে রোজ চলে আসতেন এঁরা। আরো আসতেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান।

সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তো, তখন বিউটি বোর্ডিংয়ের দোতলায় উঠবার সিঁড়িতে কাগজ-কলম হাতে দেখা যেতো শামসুল হককে। এই বোর্ডিংয়ে বসেই পূর্ব বাংলার প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিকল্পনা করেছিলেন আব্দুল জব্বার খান। আহমেদ ছফার ‘স্বদেশ’ সহ বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী বের হতো বিউটি থেকে।

বিউটি বোর্ডিংয়ের হল অব ফেমে জায়গা হবে বাংলা সাহিত্যে-সংস্কৃতির প্রথিতযশা সব ব্যক্তিত্বের। শামসুর রাহমান, জহির রায়হান, রণেশ দাশগুপ্ত, ফজলে লোহানী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমেদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, সত্য সাহা, এনায়েত উল্লাহ খান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ড. মুনতাসীর মামুন, খান আতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুর হক, জুয়েল আইচ প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তির পদচারণায় মুখরিত থাকত বিউটি বোর্ডিং।

 কবি বেলাল চৌধুরী বিউটি বোর্ডিংয়ের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, “পুরু দেয়ালের গায়ে ছোট ছোট নিচু জানালা। মাঝখান বরাবর তারই একটির পাশে বসে কথা বলছি আমি আর আদি ও অকৃত্রিম, একক ও স্বরাট ‘বিউটিয়ান’ শহীদ কাদরী। কথা বলছি মানে শুনতেই হচ্ছে বেশি। আবার সঠিক করে বলতে গেলে শোনাও নয়, গিলছি বললে অত্যুক্তি হয় না। কীভাবে এমন একটি দৃশ্য রচিত হয়েছিল আগেই বলেছি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। যারা শহীদ কাদরীকে চেনেন তারা আমার সঙ্গে সায় দেবেন কি না জানি না, আড্ডার সমার্থশব্দের একটি হচ্ছে শহীদ কাদরী। শুধু আড্ডাবাজই নয়, আড্ডাবাজ শব্দটিকে রবারের মতো রাজাধিরাজ পর্যন্ত টেনে নিতেও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। “

সাতান্ন থেকে বাষট্টি সাল পর্যন্ত সময়কালে শামসুল হকের প্রায় সব লেখাই ছিলো বিউটি বোর্ডিংয়ে বসে। তাঁর জন্য ছিলো নির্দিষ্ট চেয়ার-টেবিল। বিউটি বোর্ডিং প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, ‘তখন আমার লেখার জায়গা ছিল না। বাসার বারান্দায় বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটি জায়গায় থাকতাম আমি। লেখার জন্য আমি বিউটি বোর্ডিং ব্যবহার করতাম। এই ভবনের পাশের কোনায় যে জানালাটি দেখা যায়, সেখানে চেয়ার-টেবিল পেতে আমি লিখতাম। সকাল ৮টা থেকে ১০টা-১১টা পর্যন্ত লিখতাম, তারপর বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আবার দুপুর ২টা কি আড়াইটায় আসতাম, বিকাল সাড়ে ৫টা-৬টা পর্যন্ত লিখতাম, তারপর আড্ডা শুরু হতো। রাত সাড়ে ৯টা-১০টায় আড্ডা ভেঙে গেলে আবার ঐ কোনায় বসে লিখতাম। ৫৭ থেকে ৬২ সাল পর্যন্ত সময়ের লেখাগুলো, প্রায় সব লেখা এই বিউটি বোর্ডিংয়ের ওই কোনায় বসে লেখা।’

তারক সাহার বর্ণনায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিলো বিউটি বোর্ডিং এর স্বর্ণযুগ। শুধু সাহিত্য আড্ডাই নয়, রাজনীতিতেও ছিলো এই বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখানে পা রেখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেতাজি সুভাষ বসু সহ আরো অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাবকে যেমন বাদ দেয়া যায় না, তেমনি উপেক্ষা করা যায় না এই দোতলা দালানটির ভূমিকাও। স্বাভাবিক কারণেই একাত্তরের মার্চে হিংস্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় বিউটি বোর্ডিং। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রাতে বোর্ডার, কর্মচারী সহ ১৭ জন শহীদ হন। এর মধ্যে বিউটি বোর্ডিং এর মালিক প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা, চলচ্চিত্র শিল্পী শামস ইরানী, অভিনেতা যোশেফ কোরায়া, চিত্রশিল্পী হারাধন বর্মণও ছিলেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রহ্লাদ চন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের সহযোগিতায় আবারো দাঁড়ায় বিউটি বোর্ডিং। ১৯৯৫ সালে হয় আড্ডা পুনর্মিলনী। ২০০৩ সালে গঠন করা হয় বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ। বিউটি বোর্ডিংয়ে যারা আড্ডা দিতেন তাদের বলা হতো ‘বিউটিয়ান’। ১৯৯৮ সালে গঠন করা হয় ট্রাস্টি বোর্ড। ৬০ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের আছে ১১ সদস্যের কার্যকরী কমিটি। তাছাড়া ২০০৫ সাল থেকে দেয়া হচ্ছে বিউটি বোর্ডিং সম্মাননা।

এখনও ২৪টি রুম, খাওয়ার রেস্তোরাঁ, সবুজ উঠান আর প্রাচীনত্বের গন্ধ নিয়ে টিকে আছে বিউটি বোর্ডিং। এখনও প্রকাশনার কাজে ঢাকার বাইরে থেকে বাংলাবাজারে আসা লেখক-প্রকাশকদের রাজধানীতে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ১ নং শ্রীশদাস লেনের বাড়িটি। ঐতিহ্য বজায় রাখতে নতুন নতুন সাহিত্য সংগঠনগুলোর আড্ডা দেয়ার সুযোগ করে দিতে চেষ্টা করেন বিউটির কর্তাবাবু তারক সাহা। কবি সংসদ বাংলাদেশ সহ আরো কিছু সংগঠন এখানে এসে করছে মাসিক বা পাক্ষিক অনুষ্ঠান আর আড্ডা।

এই পুরোনো দোতলা বাড়ির প্রত্যেকটা ঘর, বারান্দা, করিডোর আর উঠান ইতিহাস-ঐতিহ্যের মায়া জালে ঘেরা। আজ অনেক বছর পরেও বিউটির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কিংবা করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করা যায় এর স্বর্ণালী সময়কে। যারা সাহিত্য, ইতিহাস বা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন তাদের জন্য অসাধারণ একটি জায়গা বিউটি বোর্ডিং।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, অর্থায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Loading

Leave a Comment