শূন্য বৃত্ত

কলিং বেল বেজে উঠতেই পিচ্চি চাচাতো বোনটা খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে গেল দরজা খুলতে!
“কে?, জিজ্ঞেস করতেই উত্তর এলো, “বাবা আমি।”
মহানন্দে দরজা খুললো মেয়েটা। চাচ্চু ঢোকার আগেই বলে উঠল, “এখন না, এখন না! আগে আমি উপর-নিচ করব!”
‘উপর-নিচ’ মানে চাচ্চুর হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে কয়েকবার ওঠা-নামা করা। কিছুক্ষণ পর আবার আবদার- “বাবা, কোলে উঠবো!” তারপর দিগ্বিজয়ী হাসি নিয়ে বাবার কোলে উঠে পিচ্চিটা ঘরে ঢুকলো। খেতে বসেও একই কাণ্ড। পিচ্চিটা ডিম দিয়ে খাচ্ছে। চাচ্চু বললো, “বাবা, তুমি কী খাচ্ছো?”
-“ডিম খাচ্ছি।”
–“কোথায় ডিম? এটাতো মাংস!”
-” না, এটা ডিম!”
–“নাহ্। মাংস।”
-“উহু! মাংস না, এটা ডিম!”

ততক্ষণে দুইজনের কাণ্ড দেখে হাসছে সবাই। সবার হাসি দেখে পিচ্চিটা ঠোঁট উল্টে চেয়ার থেকে উঠে গেল। “আমি খাবই না। বাবা ডিমকে মাংস বলে!” শুরু হলো মধুর অভিযোগ! শেষমেষ, চাচ্চু যখন অনেকবার করে বললো যে, “আচ্ছা ঠিক আছে! তুমি ডিম দিয়েই খাচ্ছো”, তখন খুশি হয়ে সে আবার খেতে বসলো। বিকেলবেলা।চাচ্চু বাইরে বেরোবে। আবারও সেই একগাদা প্রশ্ন! “বাবা কোথায় যাও?”
-“বাইরে যাই বাবা।”
–“বাইরে? নামাজে যাবা না?”
-“হ্যাঁ বাবা, যাবো।”
–“আল্লাহু আকবার বলবানা?”
-“হ্যাঁ বাবা, বলবো।”
–“নামাজ তো মসজিদে পড়তে হয়। বাইরে কেন যাবা?”
-“বাইরে গিয়ে তারপর মসজিদে যাবো, বাবা।”
–“আচ্ছা। কখন আসবা?” “এইতো, সন্ধ্যায়।”
-“ও, আমি তোমাকে ফোন করবো, ধরবা কিন্তু!”
–“আচ্ছা বাবা!”

তারপর চাচ্চু না যাওয়া পর্যন্ত মেয়েটা দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। বসে বসে দেখছিলাম। দ্বিতীয়বারে­র মত। দ্বিতীয়বারের মত বললাম কারণ দৃশ্যগুলো খুব পরিচিত। শুধু সময় আলাদা, মানুষগুলো আলাদা। প্রথমবারের দৃশ্যগুলো অনেক বছর আগের। সেই দৃশ্যে চাচ্চু আর পিচ্চিটার জায়গায় বাবা আর আমি! আজকাল বাবার কথা খুব বেশি বেশি মনে হয়…খুব বেশি। সারাদিন ক্লাস শেষে একগাদা ক্লান্তি নিয়ে বাসে করে ফেরার পথে মনে হয়, এই সময় বাবা পাশে থাকলে বেশ হত। বাবার কাঁধে মাথা রেখে পুরোটা পথ অনায়াসে পার করা যেত! বৃষ্টি হলে বাবার কথা মনে হয়। ছোটবেলায় বাবা আর আমি বৃষ্টিতে ভিজতাম খুব। আম্মু প্রথমে দিতে চাইতো না,পাছে ঠান্ডা না লেগে যায়! তখন আমি বাবার কাছে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম। বাবা জিজ্ঞেস করতো, “কী হয়েছে?” আমি বলতাম, ” বৃষ্টিতে ভিজবো।”
-“ভেজো।”
–“আম্মু বকবে”।

এরপর কিছুক্ষণ দুইজনই চুপচাপ। কিছুক্ষন পর দেখা যেত আমরা দুইজন বৃষ্টিতে ভিজছি! ছোটবেলার আরেকটা দৃশ্য প্রায়ই মনে পড়ে। বাবা আর আমি রেললাইনে হাঁটছি। আমি বাবার আঙুল ধরে রেখেছি এক হাতে, অন্য হাতে রং-তুলি, ছবি আঁকার জিনিসপত্র। হাঁটতে হাঁটতে একটা খোলা জায়গা দেখে বাবা ছবি আঁকতে বসে গেছে আর আমি রং-তুলি এগিয়ে দিচ্ছি। বাবা জলরঙে আকাশ আঁকছেন। ভেজা কাগজে নীল রং ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি আর মনে মনে ভাবছি, যখন বাবার মত বড় হব, তখন আমিও রেল-লাইনের পাশে বসে ছবি আঁকবো। এখনও হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ছবি আঁকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বাবাকে নিয়ে রেল-লাইনের পাশে বসে ছবি আঁকা আর হয় না। কোনো একদিন হবে হয়তো! আমাকে সকালবেলায় ঘুম থেকে ডেকে তোলার কাজটা সবসময় বাবাই করে। এই যে এখন বাসা থেকে এত দূরে – এখনও ফোনে বাবাই আমাকে ডেকে তোলে। অ্যালার্ম বাজলে সেটা বন্ধ করে আবার হয়তো ঘুমে তলিয়ে যাই। কিন্তু বাবা যখন ভোরবেলা ফোনে নরম গলায় বলে, “বাবা, ভালো আছো? “, তখন কী করে যেনো আপনা-আপনি ঘুম কেটে যায়! মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড রাগ হয় নিজের উপর। বাবাকে যে কতটা মনে পড়ছে, সেটা বাবাকে বলতে পারি না (কিংবা বলি না), তাই। ফোন করে “হ্যালো, বাবা কোথায় তুমি? কী কর?” এইসব অহেতুক প্রশ্নের ভিড়ে সেই কথাটা বলা আর হয়না। বাবাও আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমায় প্রশ্ন করে, “কী কর বাবা?” “খেয়েছ?” “ক্লাস শেষ?” “বাসায় এসেছ?” “বাস থেকে সাবধানে নামবে…” “রাস্তা সাবধানে পার হবে…”।

ব্যস! তারপর দুইজনই চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ। আমি ভাবি, তোমার কথা অনেক মনে পড়ছে, এটা বলব। তুমিও ভাবো হয়তো। কিন্তু বলা আর হয় না। কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর -“আচ্ছা বাবা, রাখি ” -এইটুকুতেই আটকে যায় আমাদের রোজকার কথাবার্তা। আমি বেশিরভাগ সময়েই যেটা ভাবি, শেষ পর্যন্ত সেটা করতে পারিনা। যেমন, বাবা যখন আমায় দেখতে আসে, তখনও ভাবি অনেক কিছু বলব! বলা আর হয় না। চলে যাওয়ার সময়ও ” সাবধানে যেয়ো”-এটুকু ছাড়া আর কিছু বলতে পারিনা। কিছুই ঠিকঠাক হয় না, সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়!

আমার অসংখ্য ইচ্ছের মাঝে একটি হল- আমার সময় একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার আগে অন্তত হাজারবার বাবার আঙুল ধরে হাঁটা! হাজারবার বাবার সাথে বৃষ্টিতে ভেজা ! অার অসংখ্যবার বলা, “বাবা, তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসি!

আর একটি ইচ্ছে- এই দৃশ্যগুলো শুধু দ্বিতীয়বার না, বারবার দেখার মত সৌভাগ্য যেন সবার হয়! একইসাথে তীব্র কষ্ট আর তীব্র আনন্দের এই অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি থেকে কেউ যেন কোনদিন বঞ্চিত না হয়।

বাবার জন্য আবারও অনেক অনেক ভালোবাসা!

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment