আলেকজান্দ্রিয়ার ব্যবচ্ছেদ শিল্পীদের গল্প

রিতুর ছোট ফুপি পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ফুপির টেবিলে কালো রঙের মস্ত একটা বই রিতু দেখেছে, নাম GRAY’S ANATOMY. এই বইটা পড়তে গেলে ফুপির ইয়া নফসি, ইয়া নফসি অবস্থা হয়। রিতুও একদিন খুলে দেখেছে বইটা। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি দেয়া আছে। ফুপির কাছ থেকে রিতু ANATOMY –এর আরো অনেক কিছু জেনেছে। আপাত বিরক্তিকর পাঠ্য বইটার পেছনের যে একটা সুন্দর ইতিহাস আছে, সে গল্পটাও একদিন সে জেনে নিয়েছে ফুপির কাছ থেকে।

ANATOMY –এর বাংলা হলো শারীরবিদ্যা। শারীরবিদ্যা (Anatomy) শেখার জন্য মানব দেহকে কেটে উন্মুক্ত করার শিল্পের নাম ব্যবচ্ছেদ। ব্যবচ্ছেদ বিদ্যার আছে প্রাচীনত্ব আর ইতিহাস। এই সাহসী চর্চার পেছনে রয়েছে একাডেমিক প্রচেস্টা, উদ্ভাবনশৈলী, শৈল্পিক আদর্শবাদ, কল্পনা ও অন্যায়পরতা। ক্লদ বার্নার্ড নামের ফ্রেঞ্চ দেহতত্ত্ববিদের বর্ণনায় শারীরবিদ্যা হলো সকল দেহতত্ত্ব বিদ্যার ভিত্তি। এই দুটিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি না করতে পারলে চিকিৎসাবিদ্যা শেখার বিজ্ঞান পদ্ধতি বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।

মানবদেহ ব্যবচ্ছেদের গল্প শুরু হয়েছিলো প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ হতে ২৫০ অব্দের মধ্যে। যিশু খ্রিস্টের জন্ম পূর্ব ৩য় শতকে আলেকজান্দ্রিয়া নগরী ছিলো চিকিৎসাবিদ্যার অনেক নতুন নতুন দিক উদ্ভাবনের উর্বর ভূমি। হিরোফিলাস ও এরাসিসট্রাসেস নামের দুই বিখ্যাত শারীরিতত্ত্ববিদ সে সময়টায় ব্যবচ্ছেদবিদ্যা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালান। তাদের শারীরবিদ্যা ও দেহতত্ত্ব নিয়ে আবিষ্কার গুলো ছিলো অসাধারণ। এই আবিষ্কার গুলো মানব ইতিহাসের ঐতিহাসিক ধাঁধাঁ গুলোর ছক খুলে দেয়ার সূচনা করে। তাদের এই গবেষণা কেবল মাত্র মানবদেহ নিয়ে প্রাচীন মিথ গুলোকে অসত্য প্রমাণ করেনি, চিকিৎসাবিদ্যার জন্য খুলে দিয়েছিলো নতুন দিগন্ত। এই দুই মহান চিকিৎসকের কিছু বইয়ের কথা শোনা গেলেও, তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের সম্পর্কে যা জানা গেছে তার অধিকাংশই তাদের পরবর্তী সময়ের বিজ্ঞানীদের দেয়া উক্তি ও তথ্যের মধ্য দিয়ে পাওয়া গেছে।

এর পূর্বের শতাব্দিতে এরিস্টটল বিভিন্ন জানোয়ারের দেহ ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। পরবর্তীতে গ্যালেন ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও তা করেন। কিন্তু মানব দেহ ব্যবচ্ছেদের মতো একটি প্রথা বিরোধী কাজ প্রথম করেছিলেন হিরোফিলাসই।

খ্রিস্টের জন্মের পর, খ্রিস্টান চার্চ থেকে মানবদেহ ব্যবচ্ছেদকে নারকীয় বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্য ব্যবচ্ছেদ ছিলো এক ধরণের ট্যাবু। সে সময় চার্চ থেকে হিরোফিলাস ও এরাসিসট্রাসেসের গল্প গুলো প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। প্রচার করা হয় যে, হিরোফিলাস ও এরাসিসট্রাসেসের গবেষণা কেবল মৃত মানুষদের ওপর ছিলো না, তারা গবেষণার জন্য জীবিত মানুষকেও ব্যবচ্ছেদ করেছিলো। সে সময়ের খ্রিস্টান সমাজ তাদের আলেকজান্দ্রিয়ার মুচার (Butchers of Alexandria) বলে অভিহিত করে।
পরবর্তী সময়ে অলাস কর্ণেলিয়াস সেলসাস নামে এক অ-খ্রিস্টান ঐতিহাসিক জানান যে, হিলোফিলাস যে দেহ ব্যবহার করতো তা আসতো আলেকজান্দ্রিয়ার রাজকারাগার থেকে। সেলসাসের বক্তব্য থেকে ধারণা পাওয়া যায়, হিলোফিলাস ও তার সহচর এরাসিসট্রাসেস অতোটা নির্দয় ছিলেন না। মেডিসিন নামের গ্রন্থে সেলসাস বলেন যে, জীবন অবস্থায় ব্যবচ্ছেদ নিষ্ঠুরতা এবং তা অপ্রয়োজনীয়।

পোপ দ্বিতীয় বেনেফিসের আমলে মানুষের পুনর্জীবনের ধারণা আবারও প্রচলন করা হয় এবং শব-ব্যবচ্ছেদকে নিষিদ্ধ করা হয়। সাভার্তাস নামের এক চিকিৎসক মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে তার ফলাফল প্রকাশ করলে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

মুসলিম সমাজেও খ্রিস্টানদের মতো ব্যবচ্ছেদকে অপবিত্র বলে বিবেচনা করা হতো। যদি ইবন-আল-নাফিসের মতো অনেক ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রচেস্টা চালিয়ে গেছেন।

ব্যবচ্ছেদের ইতিহাসের পরবর্তী মাইলফলকটি রচিত হয় ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে যখন আন্দ্রেস ভেসালিস নামে পাদুয়ার তরুণ ব্যবচ্ছেদবিদ্যার প্রফেসর তাঁর অনবদ্য রচনা “দ্য হিউম্যানি কর্পোরিস ফেব্রিকা লিবরিস সেপটেম” (the seven books on the fabric of the human body) প্রকাশ করেন। আধুনিক ব্যবচ্ছেদ বিদ্যার প্রসারে ভেসালিসের ভূমিকা ছিলো পথপ্রদর্শকের মতো। জানা যায় যে ভেসালিসের সহকর্মী জোয়ানেস সিউস ইংল্যান্ডে ব্যবচ্ছেদবিদ্যাকে উৎসাহী করেন।

ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় “ইউনিভার্সিটি অব বেলেগানা”-তে শত বছরের পুরোনো ব্যবচ্ছেদাগার রয়েছে। এসব ব্যবচ্ছেদাগারে নজর রাখতেন সে সময়ের ধর্ম যাজকেরা। তাদের নিয়মানুযায়ী মৃতদেহের হৃদপিন্ড ও মাথায় ঈশ্বরের বাস। তাই সেখানে কোনো রকম স্পর্শ না করেই ব্যবচ্ছেদের কাজ করতে হবে। এই নিয়ম অমান্য করলে কঠিন শাস্তিরও বিধান ছিলো।

বাঙ্গালী সমাজে মৃতদেহ স্পর্শ করাই ছিলো এক রকমের গর্হীত অপরাধ। ১৮৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর বঙ্গের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। মেডিকেল কলেজ অব বেঙ্গলের প্রথম আবর্তনের চারজন ছাত্র ও একজন শিক্ষকের এই কাজ ছিলো পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসেই হাজার বছরের কুসংস্কার ভেঙ্গে দেয়া এক যুগান্তকারী ঘটনা।

ইউরোপে যেমন গ্যালিলিও, কোপারনিকাসরা বারবার ধর্মমন্দির থেকে বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছিলেন তেমনি বঙ্গেও শব-ব্যবচ্ছেদের ক্ষেত্রে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক ধর্মীয় বাঁধা নিষেধের ব্যারিকেড। ছাত্রদের শিক্ষার স্বার্থে মৃত মানুষের দেহ তো দূরের কথা ইতর প্রাণির ব্যবচ্ছেদ করতেও বাঁধার মুখ পড়তে হয়েছে।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা অসংখ্য কুসংস্কারের দেওয়াল গুড়িয়ে দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, অনেক কুসংস্কার, মিথ বর্তমান আধুনিক সমাজেও দারুন প্রতাপে টিকে আছে। অতীতে যারা কুসংস্কারের দেওয়াল গুড়িয়ে দিয়ে এসেছেন, তাঁদের পথচলা কখনোই সহজ ছিলো না। আমাদেরও হবে না। কিন্তু বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় যে ব্যাটনটা আমাদের হাতে আছে তা পরবর্তীর কাছে পৌঁছে দিতে এই কঠিন পথেই আমাদের হাঁটতে হবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, অর্থায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Loading

Leave a Comment