ক্রায়োজেনিক্স: এ কেমন শীতলতা?!

ক্রায়োজেনিক্স কী! জেনিক্স কেনোই বা কাঁদবে! ক্রায়োজেনিক্স (Cryogenics) নিয়ে উৎসাহীদের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী তাইমিয়ান তামজিদ লিখেছেন কাকাড্ডা ডট কমে। বিজ্ঞানের ছাত্র নন, অথচ বিজ্ঞানমনস্ক, বিজ্ঞান নিয়ে জানতে চান, পড়তে চান এমন পাঠকদের জন্য যুতসই একটা ক্রায়োজেনিক্স শীতলতার গল্প! 

 

ক্রাইয়োজেনিক্স (Cry-O-Genics) মোটেও জেনিক্সকে কাঁদতে উৎসাহ দিচ্ছেনা সে বরং সবাইকে ঠান্ডা করায় মত্ত! বিজ্ঞানের খটমটে ভাষায়, “Cryogenics হলো অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রা সৃষ্টি এবং সেই তাপমাত্রায় পদার্থের বিভিন্ন ধর্ম বিশ্লেষণ।” নিম্ন তাপমাত্রায় ধর্ম বিশ্লেষণ? সে তো বরফের দেশে করলেই চলে? মজার বিষয় হলো, বরফের দেশও Cryogenics এর কাছে অত্যন্ত গরম। হ্যাঁ, “অত্যন্ত গরম”, কেননা এর কার্য সীমার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা -১৫০°সেলসিয়াস (১২৩ কেলভিন; -২৩৮°ফারেনহাইট)। যেহেতু সেলসিয়াস আর ফারেনহাইট স্কেলে Cryogenics এর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মানই ঋণাত্মক, তাই এ ক্ষেত্রে সাধারণত কেলভিন স্কেলই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

Cryogenics এর আতসবাজিতে প্রথম আগুন দেন সুইস পদার্থবিজ্ঞানী রাউল পিকটেট এবং ফরাসি প্রকৌশলী লুইস পল কেইলেটেট ১৮৭৭ সালে বায়ুর তরল ফোঁটা তৈরি করে। তারা দুইজন দুটি ভিন্ন পন্থায় বায়ুকে তরলীকরণ করেন। আর আতসবাজির বিস্ফোরণটি ঘটে এর ছয় বছরের মাথায় ১৮৮৩ সালে যখন জিগমান্ট রব্লেউসকি এবং কারল ওলসজেউস্কি অক্সিজেন (৯০ কেলভিন তাপমাত্রায়) এবং নাইট্রোজেনকে (৭৭ কেলভিন তাপমাত্রায়) তরল করতে সক্ষম হন। বিস্ফোরণের ক্রায়োনিক আলোকচ্ছটা নজর কাড়ে অনেক বিজ্ঞানীর আর শুরু হয় Cold war, মানে আর কি, শীতল করার যুদ্ধ! লক্ষ্যমাত্রা এবার Absolute Zero (শূণ্য কেলভিন তাপমাত্রা; যে তাপমাত্রায় ইলেকট্রন, প্রোটনও স্থিরাবস্থা লাভ করে এবং যা অর্জন তাপগতিবিদ্যার সূত্রানুযায়ী অসম্ভব)।

কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে বিজ্ঞানী জেমস দেওয়ার পড়েন বিপাকে! ১৮৯৮ সালে ২০ কেলভিন তাপমাত্রায় তিনি হাইড্রোজেনকে তরল করতে সক্ষম হলেও একে সংরক্ষণ করে রাখার মত কোনো বস্তু তিনি পেলেননা। অবশেষে নিজের হাতিয়ার নিজেই তৈরি করলেন তিনি, যাকে বর্তমানে বলা হয় “দেওয়ার ফ্লাস্ক”। যুদ্ধ তখন ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করে। Cryogenics এর পরবর্তী বলার মত সাফল্য আসে হেইকে কেমারলিং এর হাত ধরে; ৩.২ কেলভিন তাপমাত্রায় হিলিয়াম গ্যাসকে তরল করেন তিনি। তবে এরপরের সফলতাগুলি আর খুব বড় রকমের নয়, কেননা, ৩.২ কেলভিন যে ০ কেলভিন হতে বেশি দূরে নয়! তাই বলে Cryogenics এর সফলতার ঝুলি একেবারে হালকা হয়ে যায়নি, বিজ্ঞানীরা বর্তমানে ১ কেলভিনের ৪ কোটি ভাগের ১ ভাগ তাপমাত্রায় সোডিয়াম গ্যাসকে শীতল করতে পারেন! ৪ কোটি ভাগের ১ ভাগ! কম কিসে!

ক্রায়োজেনিক চেম্বার

তাপমাত্রা স্কেলের অনেক নিচে হয়ত বিজ্ঞানীরা নেমেছেন, কিন্তু তার জন্য অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে চিন্তা ভাবনার তাপমাত্রা কিন্তু ঠিকই বাড়াতে হয়েছে। ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রা অর্জন করতে বর্তমানে মূলত চারটি পদ্ধতিতে হয়:

১. Heat Conduction
২. Evaporative Cooling
৩. Cooling by Rapid Expansion: এটি সাধারণত রেফ্রিজেরেশন বা এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়।
৪. Adiabatic Demagnetization: শূণ্য কেলভিনের কাছাকাছি তাপমাত্রায় যেতে ব্যবহৃত হয়।

এত শীতল করে তবে লাভ কি? এই শীতলতা কি তবে শুধু গবেষণার খাতিরেই? লাভ অবশ্য আছে বৈকি! লাভের হিসাবের আগে চলুন এই হু হু ঠান্ডায় পদার্থের অবস্থার ছোট্ট একটা চেকাপ দিয়ে আসা যাক! সুপারকন্ডাক্টিভিটি এবং সুপারফ্লুইডিটি – এ দুটো ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় পদার্থের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাপমাত্রা যখন অত্যন্ত কম তখন পদার্থের রোধ এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, এর রোধ হয়ে পড়ে শূণ্য। ফলে তড়িৎ প্রবাহে থাকে না কোনো বাধা – এ ধর্মকে বলা হয় সুপারকন্ডাক্টিভিটি। আবার পদার্থের সান্দ্রতাও (সহজ ভাষায় সান্দ্রতা হল, তরল বা বায়বীয় পদার্থের অভ্যন্তরীণ ঘর্ষণ।) ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় পৌঁছায় প্রায় শূণ্যের কোঠায়। ফলে এমন তাপমাত্রায় এরা বিনা বাধায় চলাচল করতে পারে। যেমন তরল হিলিয়াম পদার্থের অণুর মধ্যকার ফাঁকা স্থান দিয়েও চলাচল করতে সক্ষম।

এবার তবে আসি লাভের হিসাবে। সুপারকন্ডাক্টিভিটি ধর্মের উপর ভিত্তি করে প্রস্তুতকৃত ইলেক্ট্রোম্যাগনেট হয় অত্যন্ত শক্তিশালী, যা ব্যবহারের অন্যতম ক্ষেত্র MRI মেশিনে। এছাড়াও খাবার সংরক্ষণে, বড় বড় শহরে পাওয়ার ট্রান্সমিশন লাইনে, ইনফ্রারেড টেলিস্কোপে ব্যবহার হয় ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রা। পদার্থের আয়ু বৃদ্ধিতে হিট টেম্পারিংই এখন একমাত্র সমাধান নয়; এর জায়গা দখলে আবির্ভাব হয়েছে ক্রায়োজেনিক প্রসেসিং এর। স্পেস শাটলের জ্বালানিতে তরল অক্সিজেন/হাইড্রোজেনের ব্যবহার চাপ কমিয়েছে অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির। উন্নততর গবেষণায়ও রয়েছে Cryogenics এর পদচারণা। Particle acceleration এর দ্বারা বিগ ব্যাং এর অনুরূপ অবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে CERN এর প্রস্তুতকৃত LHC (Large Hedron Collider) হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রায়োজেনিক সিস্টেম।

এত কিছুর পরেও ক্ষান্ত দেয়নি Cryogenics। জন্ম দিয়েছে আরও কিছু শাখার:
১. Cryobiology: জীবের উপর ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রার প্রভাব বিশ্লেষণ।
২. Cryosurgery: ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় মৃত বা আক্রান্ত টিস্যুর উপর অস্ত্রোপচার।
৩. Cryonics: ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় মানবদেহ সংরক্ষণ, এই বিশ্বাসের সহিত যে, ভবিষ্যতে উন্নততর বিজ্ঞান হয়ত তাদের আবার জীবিত করতে সক্ষম হবে।
৪. Cryotronics: ইলেকট্রনিক্সে সুপারকন্ডাক্টিভিটির ব্যবহার, প্রস্তুতি এবং বিশ্লেষণ।

মাত্র ১৩০ বছর বয়সী Cryogenics এর আরো অনেক পথ এগোনো বাকি। তবে যতটা পথ পাড়ি দিয়েছে তাতেই খুলে দিয়ে গেছে অনেক সম্ভাবনার দুয়ার। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে হয়ত এর সরাসরি ছোঁয়া আমরা পাই না বা পাব না কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার্য দ্রব্যাদির পেছনে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত খুব বড় রকমের দায়িত্ব পালন করবে এই Cryogenics।

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। 

Loading

Leave a Comment