তথ্যের বাণিজ্য

অনেক দিন ধরেই দার্জিলিং যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো আমার। গতবার গ্রীষ্মের ছুটিতেই কাজটা সেরে ফেলার প্ল্যান করছিলাম বন্ধু মিজানের সাথে বসে। সব কিছু ঠিক-ঠাকও করে রেখেছিলাম মনে মনে। কিন্তু তখনও দুশ্চিন্তা ছিলো কীভাবে যাবো-কোথায় থাকবো তা নিয়ে। বাস না ট্রেন, ট্রেন না এরোপ্লেন- এই তেটানা নিয়ে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে এক ট্রাভেল এজেন্সির দারুণ অফারওয়ালা স্পন্সরড এড চোখে পড়লো। খুশিতে বাক বাকুম হয়ে সেবারে দার্জিলিং ভ্রমণের একটা বিহিত করে ফেললাম সেই ট্রাভেল এজেন্সি থেকে। দার্জিলিং যাওয়ার পরেও থাকা-খাওয়া সহ আরো অনেক ব্যাপারে সাহায্য পেলাম ফেসবুক মারফত।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন সব চিন্তা-ভাবনা ওলট-পালট করে দিলো। ফেসবুক জানলো কী করে যে আমি দার্জিলিং যাওয়ার কথা ভাবছি?! শুধু এই দার্জিলিং ভ্রমণের ব্যাপারটাই নয়, সব ক্ষেত্রেই ফেসবুক আর গুগল আমাকে তাই দেখাচ্ছে, যা আমি দেখতে চাচ্ছি। একটুখানি ঘেটে দেখলাম, আমাদের প্রত্যেকটা সার্চ, স্ট্যাটাস, কমেন্ট, মেসেজের ওপর নজর রাখে ফেসবুক, প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করে আমাদের সম্পর্কে মিলিয়ন মিলিয়ন তথ্য। আর এইসব তথ্য সর্টিং করে বিক্রি করে দেয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে। ফেসবুকের এই তথ্য বাণিজ্যের কারণে আমরা ঠিক ওই জিনিস গুলোই আমাদের নিউজফিডে দেখতে পাই, যা আমরা দেখতে চাই বা যেসব বিষয় নিয়ে আমরা আগ্রহ বোধ করি। ফেসবুকে একটা ওয়েডিং গাউনের বিজ্ঞাপন কেবল একটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেয়ের কাছেই যাবে, কোনো বালক বা বৃদ্ধের কাছে নয়। এই ধরণের রুচি, বয়স, অবস্থান সব নিয়ামককে সর্টিং করে বিজ্ঞাপন দিতে পারার জন্যই দিনকে দিন ফেসবুক, গুগল হয়ে উঠছে মহাপরাক্রমশালী কর্পোরেশন। ওয়েডিং গাউন কিংবা শেভিং রেজারের বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য প্রয়োজন কিছু নিরীহ তথ্য। যেমন- আপনার বয়স, আপনার সার্চের বিষয়বস্তু, আপনার লোকেশন ইত্যাদি। কিন্তু ফেসবুক কী আমাদের সম্পর্কে কেবল এইসব নিরীহ তথ্যই রাখে?! এর পাশাপাশি আরো অনেক স্পর্শকাতর তথ্যও কি জেনে নিচ্ছে না?
নিজের অজান্তেই আমরা নিজেদের সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়ে দিয়েছি ফেসবুক, গুগলের কাছে। এতে করে আমাদের অভিরুচি, আবেগ, অনুভূতি সবই জানা হয়ে যাচ্ছে ফেসবুক, গুগলের। এক কথায়, কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত অজস্র তথ্যের ভান্ডার হয়ে আছে এই ফেসবুক। আপনি কী ধরণের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, আপনার প্রথম বাইক কবে কিনেছিলেন, আপনি শীঘ্রই বিয়ে করছেন কি না -এসব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল আছে ফেসবুক। আপনার নিজের সম্পর্কেই একটি তথ্য, যা হয়তো আপনি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু ফেসবুক তা ভুলবে না। একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারটা হয়তো দারুণ। ক্ষুদ্র স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে, নতুন গানের দল খুঁজে পাচ্ছে তাদের জন্য উপযোগী কাস্টমার বা অডিয়েন্স। যেকোনো ক্ষুদ্র উদ্যোগকে বড় করতে ফেসবুক এড সত্যিই অসাধারণ একটা জিনিস। তবে একটা কথা মাথায় রাখতেই হবে যে ফেসবুক এই অসাধারণ জিনিসটা করছে আপনার দেয়া তথ্য বিক্রি করেই। ছোট একটা গানের দল কিংবা চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের কাছে তথ্য বিক্রি হয়তো আপনার ব্যক্তি জীবনে তেমন কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। কিন্তু এই তথ্য গুলো যদি চলে যায় এমন কারো কাছে, যেটা আপনার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়,তখন?! জাতীয় নিরাপত্তা, ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য আজকালকার দিনে তথ্য খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার হয়ে উঠেছে। কারণ, দিন শেষে ফেসবুক মুনাফাই চাইবে। সেখানে হয়তো বিক্রি হয়ে যেতে পারে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর তথ্য। নিয়মিত কুকিজ ডিলিট করে ও এনক্রিপটেড নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ফেসবুকের এড টার্গেটিং প্রসেস থেকে নিজের প্রোফাইলকে মুক্ত করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো, এই পরিবর্তিত বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে নিজেকে তথ্য প্রদান ও তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে স্মার্ট রাখা। এই স্মার্টনেসটা শুধু যে ব্যক্তির প্রয়োজন তা নয়, রাষ্ট্রেরও প্রয়োজন বটে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Loading

Leave a Comment