আমরা গাইব শুধু গান, হতে চাইনা শিরোনাম

পঁচাত্তর কি ছিয়াত্তরের কলকাতা শহর। প্রতিবেশী বাংলাদেশে তখন চলছে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ষাটের দশকের শুরু থেকে বব ডিলান, জিম মরিসনরা তখন আরবান ফোক নামে নতুন এক জনরার (genre) গান নিয়ে রাজত্ব করে চলেছে। সারা বিশ্বের সংগীত যেখানে এগিয়ে চলছে তখন বাংলা গানের চর্চায় লেগে আছে স্থবিরতা। গতানুগতিকতার বাইরে কোনো ভাবেই বের হতে পারছিলো না বাংলা গান। তখনই এসেছিলো মহীনের ঘোড়াগুলি। বাংলা গানের নতুন ধারা সৃষ্টি করা এই গানের দলকে নিয়ে কাকাড্ডায় লিখেছেন তরুণ কবি সোহান আহমেদ তন্ময়। 

আমরা গাইব শুধু গান, হতে চাইনা শিরোনাম

“লোকের ভাল লাগছে না মন্দ লাগছে আমরা বুঝতেই পারিনি তখন। আমাদের উৎসাহটাই এত বেশি ছিল,ইয়াং স্টারদের ভাল লাগছে কিন্তু যারাই একটু প্রাচীনপন্থী তারা তো দুচক্ষে আমাদের দেখতে পারত না।”
মনি’দা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়)কে উৎসর্গ করে মহিনের ঘোড়াগুলি’র সদস্যদের একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য ডকফিল্মে ব্যান্ডের অন্যতম গীতিকার রঞ্জন কথাগুলো বলছিলেন।
মনে হল, এই সংকট চলছেই; সমস্ত কলা’র-ই প্রধানতম বাতিক! রবীন্দ্রবৃত্ত ভেঙে জীবনানন্দও ক্ষোভানলে পড়েছিলেন, শুনেছি ‘রূপসী বাংলা’ বইটার নাম তিনি ‘বাঙলার ত্রস্ত নিলীমা’ পাকা করেছিলেন কিন্তু লোকে নেবে না বলে সম্পাদক শেষ পর্যন্ত নামটা রাখেননি। “মহিনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে” জীবনবাবুর এই জ্যোৎস্নাপীড়িত ঘোড়াগুলি আজ দাপিয়ে বেরাচ্ছে। দালি’র এই ‘মেল্টিং ক্লকস’ সময়ে পৌঁছে এক বিশ্বময়তা জড়িয়ে থাকে ওদের যন্ত্রে, সঙ্গীতে। ওরা শুনেছে প্রচুর; বিটলস থেকে বাউল! রক-ফোক জনরা হিসেবে ওদের গানগুলো পরিচিত হলেও অর্কেস্ট্রা, অপেরা, স্প্যানিশ, আমেরিকান আরবান ফোক, সাইকাডেলিক এমনই অনেক জনরা নিয়ে ছিল ওদের নিরীক্ষা। দলটা এগিয়ে ছিল সময়ের অন্যদের থেকে, সেই জনপ্রিয় সিনেমা নির্ভর গানের যুগে ওরা পরিবর্তনকে বাজিয়েছে, আধুনিকতার সংকট ঝংকৃত হয়েছে যন্ত্রে, ব্যঞ্জো-গিটার-ড্রাম হাতে ওরা বাংলার সুরের নিজস্বত্বাকে খুঁজেছে। যেহেতু ওদের নিশ্বাসে ছিল ফুলের গন্ধ, প্রাণে নাচের সুর। কাফকা’র রোজ সকালের আরশোলাদের তারা ‘পাখিদের সুরে গান’ শুনিয়ে ফেরাতে চেয়েছিল নিজস্ব জীবনবোধে, কৃষক আর দিনমজুরকে সঙ্গে নিয়েই শুনতে চেয়েছিল আলী আকবর আর রবিশংকর, ওরা এই বিপন্ন জনপদে বিটলস, ডিলান আর বেতোভেনের ছন্দময়তাকে আনতে চেয়েছিল, এই নাগরিক নিসঙ্গতায় ক্রমাগত আলোকবর্ষ দূরে চলে যাওয়া আগামীকে বৃষ্টি হয়ত পারেনি বৃষ্টির বিশ্বাস দিয়ে গেছে গানে গানে। ওরা ওদের কথা বলেছে। শুধু কথায় নয় সঙ্গীতের অপূর্ব এক পরিবরতন এসেছে বস্তুত মনিদা’র হাত ধরে।আমরা বিশ্বের স্বরূপ জানতে পেরেছি আমাদের গানে, গিটারে বেজেছে সময়। খুব বড় একটা পদক্ষেপ ছিল, তেমনি লোকে পেছনে টেনেও ধরেছে। ‘সংবিগ্ন পাখিকুল ও কোলকাতা বিষয়ক’ নামে ৭০’এ বের হওয়া বারো মিনিটের ব্যাতিক্রমী অথচ তীব্র প্রথম অ্যালবামটিতেই চমক ছিল বেশ, একদমই ফ্লপ গেছে! তারপর এক অত্যুৎসাহী শ্রোতা সুব্রত’র অনুপ্রেরণা ও সাহায্যে অনেকটা গোছানো ঢঙে ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ নামে ৮০’তে দ্বিতীয় অ্যালবাম বের হয় কোলকাতা বই মেলায়। শ্রোতারা এই অ্যালবামটা ভালোভাবেই নেন। ‘শুনে নাও শিশিরের’ শিরোনামে গানটার শেষ পারায় কবিতার ভঙ্গিতে বলা লাইনগুলো এরকম- “যদি সব ফুল ঝরে যায়, সব সুর যায় হারিয়ে তবে এ গানের শেষটা তোমরাই গাইবে” হতাশ হতে চাইনা, কিন্তু কেন জানি মনে হয় আমরা আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, বাংলা গান দিয়ে আমরা পৃথিবীর ভূগোল কে ছুঁতে পাচ্ছি না, খুব একটা সত্যতা নিয়ে বাজাচ্ছি না! ‘এই মুহূর্তে, বোকারা স্বপ্ন দেখে পৃথিবীটা সাজাবার’ মহিনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত ‘মায়া’ অ্যালবামের এই গানটিতে তীব্র হতাশা এই সময়কে নিয়ে! তবু শিরোনামই হোক আমাদের শিরোনামহীনতা- “আমরা গাইব শুধু গান হতে চাই না শিরোনাম” ঝরা সময়ের গান(তৃতীয় অ্যালবাম) এর এই প্রত্যয়ই পারে ঝরা সময়ের এই দিনগুলোতে আমাদের গহীনের সুর যন্ত্রে অনুরণিত করতে, আমাদের একত্রিত করতে সঙ্গিতের নো ম্যান্স ল্যান্ডে। সিসিলিয়া বারটোলি, মোজার্ট ও রোসসিনি নিজস্ব স্টাইলে গেয়ে খ্যাতনামা এই ইতালিয়ান অপেরা শিল্পী মনে করেন- “Music is a way to dream together and go to another dimension”
লেখকঃ বৃত্তিতে প্রকৌশলী, অনুরাগে কবি। 

Loading

Leave a Comment