অর্থনীতি ও উৎপাদন প্রণালী

অর্থনীতি শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে যা ভেসে ওঠে তা হলো টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশ, গ্রাফের সোজা-বাঁকা, প্যাঁচানো রেখা। সত্যিকার অর্থনীতির পরিসর আরো অনেক বড়। কারণ অর্থনীতি যেসব বিষয় আলোচনা করে সে গুলো না হলে আমরা পৃথিবীতে টিকে থাকতেই পারবো না। কোনো সমাজের অর্থনৈতিক নীতি ঠিক করে দেয় সে সমাজের মানুষের ভালো থাকা, খারাপ থাকা, অভিরুচি, অভ্যাস। মানবিক সমাজ গড়তে হলে অর্থনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বেঁচে থাকার জন্য আমাদের বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন হয়। সেসব প্রয়োজন মেটাতে আমরা নানা ভাবে চেষ্টা করি। এই যে প্রয়োজন বা অভাব মেটানোর জয় যে বিভিন্ন প্রকার জিনিস তৈরী করতে হয় তাকেই আমরা বলি উৎপাদন।

পৃথিবীতে মানুষ আসার পরেই আজকের মতো সভ্য রীতিনীতি চালু হয়ে যায়নি। শুরুতে মানুষ গুহায়, জঙ্গলে বসবাস করত। বনের পশু শিকার ও গাছের ফলমূল জোগাড় করে জীবন ধারণ করত। শিকারের জন্য তৈরী করত তীর-ধনুক, পাথরের টুকরাকে ধারালো করে তৈরী করতো ছুরি। অর্থাৎ, সেই সমাজে মানুষের প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস সে নিজেই উৎপাদন করতো। আবার আজকের দিনে, কৃষকেরা চাষবাস করে ধান, পাট, শাকসবজী উৎপাদন করেন। শ্রমিকেরা উৎপাদন করেন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, পোশাক।

সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই মানুষ উৎপাদন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। সব সমাজেরই উৎপাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যুগের সাথে উৎপাদনের উপায় বদলেছে। বিভিন্ন যুগে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে উৎপাদন করেছে, আর সেই উৎপাদনের ভাগ-বাটোয়ারাও করেছে বিভিন্ন উপায়ে। জিনিসপত্র তৈরীর করার মাধ্যমে উৎপাদন আর সেই উৎপাদনকে ভাগ বাটোয়ারা করার নিয়মকে বলে উৎপাদন প্রণালী।

আগের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, উৎপাদন ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব।  সব সমাজেই মানুষকে উৎপাদন করতে হয়েছে এবং উৎপাদন প্রণালীতে অংশ নিতে হয়েছে। বিভিন্ন যুগে উৎপাদন প্রণালীতে মানুষের ভূমিকা ছিলো বিভিন্ন। উৎপাদন প্রণালীতে মানুষদের মধ্যে কে কি ভূমিকা রাখে তার ওপর ভিত্তি করে মানুষের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। আমরা একে বলি উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন প্রণালীতে চাষার সঙ্গে জমিদারের, মজুরের সঙ্গে কল-মালিকের একটা সম্পর্ক তৈরী হয়।

উৎপাদন প্রণালীর সাথে সাথে উৎপাদনের ভাগ বাটোয়ারার নিয়মও বদলে যায়। আদিম যুগে মানুষ যখন বনে জঙ্গলে বাস করত তখন যাবতীয় উৎপাদনের অর্থাৎ শিকারের পশু, গাছের ফলমূলের একটা সুষম বন্টন হতো। তারপর একটা সময় এলো যখন জমিদাররা প্রচুর জমিজমা কব্জা করে রাখতো। চাষীরা সেসব জমিতে বেগার খাটতো। কিন্তু উৎপাদনের অধিকাংশও জমিদার নিয়ে যেতো। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে দেখা যায়, খুব অল্প দামে শ্রম বিক্রি করছে পোশাক শ্রমিকেরা। অন্যদিকে গার্মেন্টস মালিকরা খুব সহজেই লাভবান হয়ে যাচ্ছে।

পশু শিকার করছে আদিম মানবেরা

এই সব সাধারণ বিষয়াবলী নিয়েই আলোচনা করে অর্থনীতি। যদিও এর সিদ্ধান্তগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন প্রণালীর সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে কোটি মানুষের জীবনযাত্রা।

উৎপাদন প্রণালীকে আমরা দুই ভাবে ভাগ করতে পারি। প্রথমটি স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালী, দ্বিতীয়টি পণ্য উৎপাদন প্রণালী। ধর, আমাদের কারোর কিছু কাপড়-চোপড়, কিছু খাবার আর ঘরের জন্য কিছু পর্দা দরকার। আর সেসব আমরা যদি নিজেরাই তৈরী করে নিতে পারি তবে তা হলো স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালী। অর্থাৎ, তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তুমি যদি সেটা নিজেই তৈরী করে নিতে পারো তবে সেটা স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালী। স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালীতে জিনিস-পত্র কেনা থাকতে হয় না। থাকলেও খুব সামান্য। বিক্রি করার উদ্দেশ্যেও স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালীতে উৎপাদন হয় না। স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালীতে বেচা-কেনা হলেও তা আকস্মিক। হঠাৎ, কারোর কিছু প্রয়োজন হলে হয়তো অন্য কারো সাথে বিনিময় করে নেয়া হলো, এমন। ভোগের জন্য সরাসরি উৎপাদনই হচ্ছে স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালীর নিয়ম।

পণ্য উৎপাদন প্রণালীর মূল উৎসাহের জায়গা উৎপাদনের বিক্রি। এই প্রণালীতে যে যাই উৎপাদন করুক না কেন, তা বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারে নিয়ে আসবে। পণ্য উৎপাদন প্রনালীর সমাজেও স্বাভাবিক উৎপাদন হয়ে থাকে। যেমন ধর, তুমি তোমার জন্য একটি ল্যাম্পশেড তৈরী করবে। পণ্য উৎপাদন প্রণালীর সমাজের স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালীতে উৎপাদিত উৎপাদন খুবই নগন্য সংখ্যক হয়।

পণ্য উৎপাদন প্রণালীতে বিনিময় হচ্ছে প্রধান কারণ। কোনো জিনিস যখন বেচা-কেনার জন্য উৎপাদন করা হয় তখন এর মধ্যে নতুন এক রকম গুণ চলে আসে। তুমি যদি স্বাভাবিক উৎপাদন প্রণালীতে একটি কলম উৎপাদন কর, তখন কলমট শুধু তোমার লেখার প্রয়োজন মেটাবে। কিন্তু বিক্রির জন্য উৎপাদিত কলম বিক্রি করে তুমি অন্যান্য জিনিস কিনতে পারবে। অর্থাৎ, পণ্য উৎপাদন প্রণালীতে উৎপাদিত জিনিসের অন্যান্য অভাব মেটানোর ক্ষমতা থাকে।

প্রাচীন বিনিময় প্রথা

বিনিময় থাকতে হলে সমাজে দুটো জিনিস থাকতে হয়। একটি হলো, শ্রম বিভাগ অন্যটি, সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানা।

আমাদের প্রতিদিন নানা জিনিস দরকার হয়। তার সব আমরা নিজেরা উৎপাদন করতে পারি না। আমার হয়তো জুতার দরকার, কিন্তু আমি জুতা তৈরী করতে পারি না, পোশাক বানাতে পারি। এজন্য সমাজে জুতো  তৈরী করে মুচি, পোশাক তৈরী করে তাঁতী। সমাজের আবশ্যকীয় জিনিস উৎপাদনের জন্য যে শ্রম দরকার তা বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিশেষায়িত ভাবে ভাগ করে দেয়ার নাম শ্রম বিভাগ।

শ্রম বিভাগে একজন মুচি সারাজীবন জুতাই তৈরী করে। এতে করে সে জুতা উৎপাদনে অনেক দক্ষ হয়ে যায়। ফলে উৎপাদনের পরিমাণও বেড়ে যায়। সার্বিক ভাবে, ঐ সমাজের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়।

কোনো সমাজে শ্রম বিভাগ থাকলেই যে বিনিময় থাকতে হবে, তা কিন্তু না। সমাজের সবাই যে যা তৈরী করলো, তা থেকে সবাই যদি তার প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ে নিল, এ রকম হলে কিন্তু বিনিময়ের প্রয়োজন পরে না।

কিন্তু বিনিময় থাকতে হলে, সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত অধিকার থাকা চাই। অর্থাৎ, যার যার উৎপাদিত জিনিস তার তারই থাকবে। প্রত্যেকে তাদের তৈরী করা জিনিস বাজারে নিয়ে আসবে, এবং দর কষাকষির মাধ্যমে যে যার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে। মুচির ব্যক্তিগত সম্পত্তি তার জুতো। যেহেতু জুতো খাওয়া যায় না, সেহেতু তার জুতো বিক্রি করে চাল কিনতে হবে।

সুতরাং, বিনিময় প্রথা থাকতে হলে সমাজে শ্রম বিভাগ থাকতে চাই, আর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতে চাই। ব্যক্তিগত অধিকার থাকলে শ্রম বিভাগ যত বাড়বে, বিনিময় প্রথার ততো প্রয়োজন হবে। আর তখনই পণ্য উৎপাদন প্রণালির সৃষ্টি।

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

[স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের অর্থনীতির বিদ্যা নিয়ে আগ্রহ তৈরী করার জন্য কাকাড্ডার অর্থনীতি সিরিজে প্রকাশিত লেখাগুলোতে ড. নীহার কুমার সরকার রচিত ছোটদের অর্থনীতি, এডাম স্মিথের The Wealth of the Nations, ডমিনিক স্যালভেতরের মাইক্রোইকোনমিক্স থিওরী সহ অন্যান্য অন্তর্জালিক আঙ্গিনার সাহায্য নেয়া হয়েছে।]

Loading

Leave a Comment