মূল্যস্ফীতির ভেতর-বাহির

অর্থনীতি শব্দটা শোনা মাত্রই আঁতকে উঠতাম আমি। একদিন খেলার পাতাটা দেখতে দেখতেই অর্থনীতিতে আগ্রহ জাগাতে পারে এমন এক আশ্চর্য তথ্য খুঁজে পেলাম। বছর দশেক আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তখন জিম্বাবুয়ে সফরে। দলের সাথে জিম্বাবুয়ে গিয়েছেন প্রথমআলোর কোনো এক ক্রীড়া প্রতিবেদক। তার রোজনামচার কলামে একদিন লিখলেন, জিম্বাবুয়েতে নাকি একটা ব্রেড কিনতেও গাড়ি ভর্তি করে ডলার নিয়ে যেতে হয়! কী আজব ব্যাপার!

সেদেশে টাকার দাম নাকি খুবই কম। এই জেনে আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, বাংলাদেশ থেকে জিম্বাবুয়েতে এক হাজার টাকা নিয়ে গেলে কতো কতো নোট পাবো আমি।  ছোট্টবেলার সেই হিসেবে গাণিতিক যুক্তির চাইতে কল্পনা ছিলো অনেক বেশি। তবে এই ব্যাপারটাই আমাকে অর্থনীতি সম্পর্কে আরো একটু কিছু জানতে আগ্রহ করে দিয়ে গিয়েছে…

জিম্বাবুয়েতে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিলো!

জিম্বাবুয়ের এক প্যাক ব্রেডের জন্য এক ব্যাগ ডলারের মত অনেক উদাহরণই দেয়া যাবে। একে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় মূল্যস্ফীতি। বইয়ের ভাষায় বললে, দামস্তরের ধারাবাহিক বৃদ্ধিকেই মূল্যস্ফীতি বলে। কেবলমাত্র জিনিসের দাম বেড়ে গেলেই যে মূল্যস্ফীতি হয় তা নয়।  এটি একটি সামগ্রিক বিষয়। শুধুমাত্র একটি পণ্যের দাম বেড়ে গেলেই যে মূল্যস্ফীতি হয় তা না। পণ্যের দাম বেড়ে চলার প্রক্রিয়ার নাম মূদ্রাস্ফীতি। যেমন- বাংলাদেশে এক কেজি চালের দাম ষাট টাকা। ইউএসএ-তে একই মানের এক কেজি চালের দাম দুই ডলার অর্থাৎ একশত আশি টাকা। মানে ইউএসএ-তে চালের দাম বাংলাদেশের তিন গুণ। কিন্তু এর পরেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ইউএসএ-এর চাইতে বেশী। কারণ, বাংলাদেশে চালের দাম আগের চাইতে বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশী। তাহলে আমরা মূল্যস্ফীতিকে সংজ্ঞায়ন করতে পারি, এভাবে- “একটি নির্দিষ্ট সময়ের তুলনায় আরেকটি নির্দিষ্ট সময়ে সামগ্রিক দামস্তরের পরিবর্তনই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি।”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কেন হয়?

বাজারে অর্থের পরিমাণ বেড়ে গেলে কিংবা চাহিদা বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। মূদ্রার সরবারহ বৃদ্ধিকে বলায় হয় মূদ্রাস্ফীতি। অর্থনীতিতে মূদ্রার সরবারহ বৃদ্ধি পেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবারহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি হয়। এ সময় অনেক বেশী টাকা সীমিত পণ্যের পেছনে ছোটে। এতে করে চাহিদা ও মূল্যস্তর উভয়ই বেড়ে যায়। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, মূল্যস্ফীতি ও মূদ্রাস্ফীতি দুটো ভিন্ন বিষয়।

আবার যদি ধরে নেই পণ্যের সরবারহ ও মূদ্রার সরবারহ উভয়ই আছে। কিন্তু মানুষ বেড়ে যাওয়ায় বা অন্য কোনো কারণে চাহিদা বেড়ে গেলো। তখনও মূল্যস্ফীতি হতে পারে।

মূল্যস্ফীতিকে বলায় অর্থনীতির নীরব ঘাতক। এর কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যায়, ফলে ব্যয় করতে হয় বেশী। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়।  এতে করে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় নিম্নআয়ের মানুষদের। আবার মূল্যস্ফীতি একেবারে না থাকলেও হয় না। কারণ বাজারে চাহিদা থাকলে বিক্রি বাড়ে। আর বিক্রি বাড়লে উৎপাদকেরা উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী হয়। পণ্যে মূল্য আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলে মানুষও সময়ের সাথে আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে নিতে পারে। বিনিয়োগকারীরা লাভের আশায় অধিক বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি হয়। কিন্তু দ্রব্য মূল্য  যদি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তাহলে দেশের শ্রমিক, শিক্ষক, কর্মচারীগণ তাদের আয় বাড়াতে সমর্থ হয়না, ফলে এসব মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে, তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনতে পারেনা। আরেক শ্রেণীর মানুষ জিনিস পত্রের দাম যে হারে বাড়ে তার চেয়ে বেশী হারে তাদের আয় বাড়াতে সক্ষম। সাধারণত ব্যবসায়ীরা এই  শ্রেণীর অন্তরভুক্ত। মূল্যস্ফীতির সময় এই শ্রেণী আর্থিকভাবে উপকৃত হয়।

আধুনিক অর্থনীতিবিদগন সবসময় একটি স্বল্প কিন্তু স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতির পক্ষে মতামত দেন। কারণ স্বল্পমাত্রার ও স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির সূচকগুলোকে চলমান রাখে এবং এর বাজারগুলোকে সচল ও স্থিতিশীল রাখে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সূত্রঃ

  1.  মূল্যস্ফীতি কী? – আমিরুল ইসলাম
  2. মূল্যস্ফীতি কতো খারাপ? – শওকত হোসেন মাসুম (কিশোর আলো সেপ্টেম্বর ২০১৫)
  3. মূদ্রাস্ফীতি বনাম মূল্যস্ফীতি – ফারুক মঈনদ্দীন

Loading

Leave a Comment