রেজাল্ট ভয়ংকর

রেজাল্ট! এই শব্দটির ভয়াবহতা কতোটুকু তা আর নতুন করে বলার বোধহয় প্রয়োজন নেই। কিন্তু দুই বছরের চর্চা আর শ্রমের ফসল প্রাপ্তির এই দিনটি উৎসবের না হয়ে কেমন করে টানটান উত্তেজনার এক ভয়লাগানিয়া দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলো, সেটাই আমার আজকের লেখার মূলকথা।

আজকে মাধ্যমিক পরীক্ষার যে রেজাল্ট দেয়া হয়েছে, তাকে প্রায় সাতটার মতো ক্যাটাগরিতে (A+, A, A-, B, C, D, F) ভাগ করে দেয়া হয়েছে। সৌরভ পেয়েছে A-, ইশিকা পেয়েছে B, জীবন উৎরাতে না পেরে পেয়েছে F গ্রেড। অথচ গতকাল বিকেল পর্যন্তও সবাই একসাথে ঘুরেছে- ফিরেছে, আনন্দ করেছে! আর আজ কারো মন ভালো, কারো একটু মন খারাপ, কারো কারো আবার মন খারাপের পরিমাণটা অনেক বেশি! সবাইকে এমন ভাগ করে দেয়াটার কি খুব বেশিই দরকার ছিলো?!

লেখার প্রথম অংশটা পড়ে নির্ঘাৎ আমাকে ভয়ানক রেজাল্ট বিদ্বেষী ভাবছেন! তবে আমি মোটেই রেজাল্ট বিদ্বেষী না। আমি আসলে কী চাই, তা জানতে হলে আপনাকে আরো একটু ধৈর্য নিয়ে এই বিরক্তিকর লেখাটা পড়ার কাজটুকু চালিয়ে যেতে হবে।

আপনাদের সামিয়ার কথা বলেছি?! ও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। গোল্ডেন এ প্লাস শব্দটা কে প্রথম চালু করেছে এ ব্যাপারে যদিও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে সব বিষয়ে আশির ওপরে মার্কস পেলে তবেই আপনি গোল্ডেন গার্ল বা গোল্ডেন বয়। সামিয়ার কথা বাদ দিন, আপনি নিজে যদি একজন গোল্ডেন বয় বা গোল্ডেন গার্ল হয়ে থাকেন তবে আপনি নবম-দশম শ্রেণীর দুই বছরে ঠিক কী কী শিখলেন, তা কি পুরো বলতে পারবেন?! যদিও পুরো বলতে পারলেই আপনি মেধাবী, নইলে মেধাবী নয় – ব্যাপারটা তা না। তবে আমি মনে করি, রেজাল্টটা কিংবা আরও ভালো করে বলতে গেলে – রেজাল্টের উদ্দ্যেশ্যটা এমন হওয়া উচিত যে- আপনি পুরোটা বছর ক্লাসে কী কী জিনিস শিখলেন তা বছর শেষে আপনাকে জানানো। গণিতে ৮০ মার্কস সিকিউর করতে কিংবা পুরোপুরি ১০০ মার্কসের উত্তর করতে যে গণিত বই পুরোটা ঝালাপালা করা একদমই অপ্রয়োজনীয় একটা কাজ, সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দিতে হবে না। কোনমতে ৮০ পেলেই বলে দেয়া হচ্ছে, আপনি এ প্লাস। কোনো কারণে না পেলে আপনি গাধা,গরু, ঘোড়া সহ আরো অনেক চারপেয়ে প্রাণীর কোনো একটা! মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণিত বিষয়ে আপনার এ প্লাস গ্রেড কিন্তু কখনো জানাবে না, আপনি আসলে কী কী জিনিস শিখলেন। আর কোনো জিনিস শিখলেই যে, ৩ ঘন্টা সময়ে আপনাকে তা পেরে দেখাতে হবে, এমনটা কেনো?!

নাজিয়া জেএসসি আর এসএসসিতে ডাবল গোল্ডেন নিয়ে নামী কলেজে এইচএসসি পড়তে এসে পড়েছে বিপাকে। কারণ, মাধ্যমিক ত্রিকোণমিতি ভালো করে না শিখেই সে এ প্লাস পেয়ে গেছে, ত্রিকোণমিতি না জেনেই এ প্লাস পাওয়া যায় বলেই হয়তো সে ত্রিকোণমিতিতে মনোযোগ দেয়নি। যেহেতু, সে গোল্ডেন পেয়েছে, সেহেতু নামী কলেজে চান্সও পেয়েছে। কিন্তু এইচএসসিতে ধাপে ধাপে ত্রিকোণমিতির মারপ্যাঁচে তার জীবন অতিষ্ঠ।

গণিত আর বিজ্ঞানের পোকা রজত। ক্লাসে সব সময় ৯৫ এর ওপর নম্বর পেতো বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে। মাধ্যমিক পরীক্ষাও দিয়েছিলো দুর্দান্ত। কিন্তু প্লাস ছুটবে তো ছুটবেই, ছুটেছে শারীরিক শিক্ষা, চারুকলা, ধর্মের মতো বিষয়গুলোতে। যদিও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে শারীরিক শিক্ষা বা চারুকলা নেই, তবু কলেজের বাছাই প্রক্রিয়ায় গোল্ডেন না পাওয়ার দায় তাকে নাজিয়ার মতো অতো নামী কলেজে ভর্তি হতে দেয়নি।

সুতরাং, প্রচলিত গ্রেডিং সিস্টেম দিয়ে কখনোই জানা যাবে না আপনি কী শিখেছেন আর কতোটুকু শিখেছেন। সবচেয়ে ভালো হতো, যদি বছর শেষে আমরা জানতে পারতাম যে সারাটা বছরে আমরা কী কী জিনিস শিখেছি, কী কী জিনিস শিখতে হবে এবং কোন বিষয়ে জানাটা কতোটুকু পূর্নাঙ্গ হয়েছে।

ফলাফল দেয়ার এ পদ্ধতিটা খুব আজগুবি মনে হচ্ছে? এই পদ্ধতিতে ফলাফল কিন্তু পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই দেয়া হয়। আর হ্যাঁ, প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দেয়াটাও আমার কাছে অন্যায্য বলে মনে হয়। যে আঁকিয়ে হতে চায়, গণিত, রসায়নে তার মেধা খোঁজার কোনো অর্থ নেই। যে কেমিস্ট হতে চায় তার মেধাও চারুকলা, শারীরিক শিক্ষায় খোঁজাটা নিরর্থক। তবে সমস্যা হলো- আমরা সবাই ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই বা বড় বেতনের চাকরী পেতে সাহায্য করবে- এমন বিষয়ে পড়তে চাই। ঠিক এই কারণেই,এই প্রতিযোগিতার কথা বিবেচনা করেই রেজাল্ট দিতে হচ্ছে এই ভুল পদ্ধতিতে। ‘ভালো রেজাল্টে ভালো চাকরি ‘- এই মনোভাবই আমাদের কাছে রেজাল্টের মতো আনন্দ উৎসবের দিনটাকে ভয়ংকর একটা দিন করে তুলেছে।

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকদের প্রতি অনেক কথাই অনেকে বলেন। তবে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাদের নিজেদেরও কিছু উদ্যোগ নেয়া দরকার। প্রথমেই আমাদের নিজের মধ্যে একটা বিশ্বাস আর আদর্শ দৃঢ় করতে হবে যে, আমরা মোটেই চাকরির জন্য পড়বো না। আমরা পড়বো জানার জন্য, আমরা পড়বো নিজের কৌতুহুলকে মেটাবার জন্য। আমাদের জানতে হবে, আমরা কী করতে চাই। আমরা যা করতে চাই তা যদি আমরা প্রচন্ড ভালোবাসা আর অধ্যবসায় নিয়ে করতে পারি তবে ঐ কাজটায় আমরাই হবো দুনিয়ার সেরাদের একজন। জীবিকার চিন্তা যে করতে হবে না তা না। তবে ঐ জীবিকার পথটা যদি তোমার নিজেরই অপছন্দ হয়, তবে জেনে রেখো, তুমি আর যাই হও কখনোই সুখী হতে পারবে না।

আজ একটু আগেই রেজাল্ট দিয়েছে। ভালো বা খারাপ দুটোর অনুভূতিই এখনও খুবই কাঁচা রয়ে গেছে। রেজাল্ট যেমনই হোক না কেনো, আপনাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই সময়টা নতুন শুরুর। শুরুর আগে আরো একবার ভেবে নিন কয়েকটা প্রশ্ন। আপনি কী করতে চান, নিজেকে কোথায় দেখতে চান। প্রশ্নের উত্তরগুলো নিজের কাছে নিজে দিন। আর হ্যাঁ, উত্তর দিতে গিয়ে চাকরী, জীবিকা এসব হতাশা সৃষ্টিকারী ফ্যাক্টরগুলোকে মাথা থেকে ঝেড়ে উত্তর দেবেন। আপনার সত্য সুন্দর উত্তর আর স্বপ্ন বাস্তবায়নের তীব্র ইচ্ছাই আপনার সত্যিকারের ভবিষ্যত গড়ে দেবে, এসএসসির রেজাল্ট না। তাই এসএসসির রেজাল্ট যাই হোক না কেন, স্বপ্ন দেখুন, স্বপ্নের পথে এগিয়ে যান, প্রতিনিয়ত নিজেকে গড়ে তুলুন। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখুন…….সবার জন্য শুভ কামনা!

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Loading

Leave a Comment