বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান মনস্কতা

উপলব্ধিটা হয়েছিল ২০১১ সালের এক শীতের সন্ধ্যায়। আমি আর রুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া এক বড়ভাই, যিনি খুব ভালো গান গাইতে পারেন, বসে ছিলাম রাজশাহীর একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে। উদ্দেশ্য ছিলো ওই ভাইয়ের গলায় আমার সংগীতায়োজনে একটা গান রেকর্ড করা। তো, কি কথায়ই যেন উঠে এলো ভূত-প্রেত সংক্রান্ত ব্যাপারস্যাপার। উনি বললেন, তিনি নাকি তাদের গ্রামে দেখেছেন এমন এক লোক যিনি পরণের লুঙ্গির মধ্য থেকে বের করে আনতে পারেন মিষ্টি, টাকা ইত্যাদি! সেই অদ্ভুত লোক নাকি পাঁচ বছর বয়স থেকে দীর্ঘ বারো বছর নিরুদ্দেশ ছিলেন। সতেরো বছর বয়সে নাকি তিনি গ্রামে ফিরে আসেন এবং এইসব ভেল্কিবাজী দেখাতে শুরু করেন এবং ঐ ভাইয়া নিজচোখে না দেখলেও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানেন যে, ঘটনা সত্য।
সেদিন এই নিয়ে হাসাহাসি করেছিলাম। বলেছিলাম, বাংলাদেশের জাদুকর এজন্য মিষ্টি-মন্ডা এনে দিচ্ছে। উনাকে ক্যাডবেরি চকলেট বের করতে বললেই ফেঁসে যাবেন হয়তো। নেহায়েত হাসাহাসি করে সেদিন ব্যাপারটা কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করে দেখলাম ভাইয়া রসিকতা নিতে পারছেন না, তিনি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন, রেগে যাচ্ছেন! ঘটনাটা আমার মনে সেদিনই চিন্তার জন্ম দিয়েছিল। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে এখন বিজ্ঞান শিখছে, বিজ্ঞান বিভাগে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও বিজ্ঞানের নানান বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করছে। কিন্তু, এদের বেশীরভাগই বোধহয় বিজ্ঞান পড়ছে শুধুমাত্র পড়ার জন্য।

পড়াশোনার উদ্দেশ্য দুই প্রকার – করে খাওয়ার দক্ষতা অর্জন এবং জ্ঞান আহরণ। এবং, আমাদের দেশে বিজ্ঞান পড়ুয়া এইসব শিক্ষার্থীদের বোধহয় শুধু করে খাওয়ার শিক্ষাটাই হচ্ছে, বিজ্ঞানমনষ্কতার উন্মেষ ঘটছে না।

বিজ্ঞানশিক্ষা ও বিজ্ঞানমনষ্কতার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায়, বিজ্ঞান হচ্ছে বিশ্বের যাবতীয় ভৌত বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, নিয়মসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ ও গবেষণালদ্ধ পদ্ধতি যা জ্ঞানকে তৈরিপূর্বক সুসংগঠিত করার কেন্দ্রস্থল। ল্যাটিন শব্দ সায়েনটিয়া থেকে ইংরেজি সায়েন্স শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ বিশেষ জ্ঞান।[১] আবার, আধুনিক বিজ্ঞানের উৎস আলোচনা করতে গিয়ে বলা যায়, দর্শন হতেই বিজ্ঞানের উন্মেষ। যদিও আমরা বর্তমানে দেখতে পাই দর্শন ও বিজ্ঞান দুটি পৃথক পদ্ধতিগত শিক্ষা। তথাপি দার্শনিক পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অভিন্ন নয়। হয়ত নীতিগতভাবে এদের মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য থাকার কথা ছিল না। কারণ প্রাচীনকালে সভ্যতার ঊষালগ্নে আমরা বিজ্ঞানকে দার্শনিক বিষয়বস্তু হিসেবেই আলোচিত হতে দেখি। তখন বলা হতো, Natural Philosophy বা ভৌত দর্শন। নিউটনের ‘ন্যাচারালিস ফিলোসফিয়া প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ এর প্রমাণ। পদার্থবিজ্ঞানে যুক্তির প্রয়োগ, আরোহী-অবরোহী পদ্ধতির প্রয়োগ – এসবই দার্শনিক ভাবপ্রসূত। কিন্তু ক্রমশ গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান শাস্ত্রীয় দর্শন থেকে আলাদা হয়ে বর্তমান বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে।[২]

সুতরাং, বিজ্ঞান শব্দটির সবচেয়ে সরলীকৃত অর্থ হলো- বিজ্ঞান হচ্ছে একটি দর্শন, যে দর্শনের মূল ভিত্তিই হলো প্রশ্ন করা ও কার্যকরণ অনুসন্ধান করা।[৩] এবং, এককথায় বিজ্ঞানমনষ্কতা বলতে সেই দুটি বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় যা বিজ্ঞানকে ধারণ করতে অপরিহার্য। এই দুটি বৈশিষ্ট্য হলো – প্রশ্ন করার প্রবণতা এবং কার্যকরণ অনুসন্ধানের
প্রবণতা। সুতরাং, যে ব্যক্তি অন্তরে উপরোক্ত দুটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করবেন তিনিই বিজ্ঞানমনষ্ক হিসেবে বিবেচিত হবেন। এজন্য বিজ্ঞানের ছাত্র হবার প্রয়োজন নাই। যেমন: আহমদ শরীফ বা হুমায়ুন আজাদ, কেউই বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। দর্শন ও সাহিত্যের ছাত্র হয়েও তাঁরা বিজ্ঞানমনস্কতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তেমনি স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানমনষ্ক ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। তিনিও স্বেচ্ছায় প্রশ্ন ও কার্যকরণ অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনষ্কতার প্রমাণ রেখেছেন। একই কথা প্রযোজ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বেলায়ও। তিনিও বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। কিন্তু, তিনি গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন শিশুদের। শিখিয়েছেন আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির কার্যকরণ।[৪]

অপরদিকে, “বিজ্ঞানশিক্ষা” শব্দটি শুধুমাত্র পদ্ধতিগত এবং সীমাবদ্ধ বিজ্ঞান শিক্ষাকেই বুঝায়। এটি সাবজেক্ট ও সিলেবাসনির্ভর নিতান্তই সীমিত পরিসরে বিজ্ঞানের কিছু কার্যকরণকে আয়ত্ব করার শিক্ষা। রাষ্ট্রপ্রণীত “শিক্ষা” সর্বদাই নির্দিষ্ট। এর গতিপথ নির্দিষ্ট এবং নিয়ন্ত্রিত। যেকেউ এই নির্দিষ্ট গতিপথে চলে, নির্দিষ্ট সিলেবাস মুখস্থ করে “বিজ্ঞানশিক্ষা” সম্পন্ন করে দক্ষ কর্মী হতে পারে। এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী একেকজন কর্মী উৎপাদন নিশ্চিত করে। এতে সেই কর্মীটি অন্তরে আদৌ প্রশ্ন করার এবং অনুসন্ধানের ক্ষমতা রাখেন কিনা – সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। বস্তুত, এই বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশকে শিক্ষাব্যবস্থা তেমন গুরুত্ব দেয় না। একজন ব্যক্তির মনের মধ্যে প্রশ্ন করার ক্ষমতা এবং অনুসন্ধানের স্পৃহা জাগবে কি জাগবে না তা নির্ভর করে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক শিক্ষা এবং শিক্ষাব্যবস্থার পরিবেশের উপরে।

এবারে আরও একটি ঘটনার কথা বলি যা আমাদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করবে, পদ্ধতিগত “বিজ্ঞানশিক্ষা” কিভাবে একজন ব্যক্তিকে বিজ্ঞানমনষ্ক করতে ব্যর্থ হয়। মাধ্যমিকে আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। তো, আমাকে বাসায় পড়াতেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি আমাকে খনিজ পদার্থের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, হাজার বছর ধরে গাছপালা মাটির তলায় পড়ে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে এইসব খনিজ মজুদ
হয়েছে – এসব শুধু পড়ার জন্য পড়ো, কিন্তু বিশ্বাস কোরো না। কারণ, ধর্মগ্রন্থে স্পষ্ট আছে, এইসব স্রষ্টার দান।
অর্থ্যাৎ, তিনি নিজে বিজ্ঞানচর্চা করেছেন ঠিকই, কিন্তু, বিজ্ঞানমনষ্ক হতে পারেন নাই। এবারে তিনি আমাকে বিজ্ঞানচর্চা করতে বলছেন ঠিকই কিন্তু বিজ্ঞানমনষ্ক হতে রীতিমত বাধা দিচ্ছেন! এইভাবে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বাধাগ্রস্থ হয় পদে পদে। বিজ্ঞানমনষ্কতা ও বিজ্ঞানশিক্ষার মধ্যকার এই যে দ্বৈরথ তা মানুষকে বিজ্ঞানমনষ্ক হতে বাধা দেয়। বিজ্ঞানশিক্ষা হলো প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার একটি অংশবিশেষ। তাই, বিজ্ঞানমনষ্কতা এবং বিজ্ঞানশিক্ষা পুরোপুরি দুইধরণের কথা বলে। বিজ্ঞানমনষ্কতা মানুষকে বলে সম্ভাবনার কথা। আর বিজ্ঞানশিক্ষা বলে সীমাবদ্ধতা ও শর্টকাটের কথা। অর্থাৎ, কোন পথে, কতটুকু বিজ্ঞান শিখলে দক্ষ টেকনোলজিস্ট হওয়া যাবে এবং কোন কোন পথে যাওয়া বারণ। “শিক্ষা” সামগ্রিকভাবে একটি প্যাকেজ, যেখানে জ্ঞানের বহু শাখার অল্প অল্প তথ্য সীমাবদ্ধ করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ হলো রাষ্ট্রপ্রণীত একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা যেখানে শিক্ষার্থী মূলত রাষ্ট্রের কাছ থেকে শিখছে, প্রকৃতির কাছ থেকে নয়। বিজ্ঞানশিক্ষাও এইরকম একটা প্যাকেজ। এখানেও রয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে স্রেফ দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশেষ সিলেবাস এবং লিমিটেড পাঠদান। অপরপক্ষে, বিজ্ঞানমনষ্কতা রাষ্ট্রনির্ভর কোনো বিষয় নয়, প্রকৃতিনির্ভর বিষয়। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নাই, এতে রয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত যাচাই করার সুযোগ।
অপরদিকে শিক্ষাব্যবস্থা তথা বিজ্ঞানশিক্ষার কেবলমাত্র দুটি উদ্দেশ্য – পরীক্ষার নম্বর ও অর্থসংস্থান। এই অর্থসংস্থান হলো বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে করে খাওয়ার নিছক শিক্ষা, কোনো দর্শনের উন্মেষ ঘটানো এর উদ্দেশ্য নয়। কারণ, বৈজ্ঞানিক দর্শনের উন্মেষ বস্তুত সকল বিষয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, এমনকি তা শাসককেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ছাড়ে না। আর শাসক প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া মানে শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। মুক্তচিন্তার উন্মেষ মানেই সকল পদ্ধতিগত, সীমিত জ্ঞানচর্চার বিলোপ। সুতরাং, বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশ বিজ্ঞানশিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা এমনকি খোদ রাষ্ট্রের জন্যেও একটি বিপদজনক বিষয়ই হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু, বিজ্ঞানশিক্ষা কেবলমাত্র বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট কিছু তত্ত্ব শেখায়। সেগুলো মানুষকে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে না, ফলে শাসক থাকেন নিরাপদ। শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানশিক্ষা বলতে আমি শুধু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতকে বুঝাচ্ছি না। “শিক্ষাব্যবস্থা” বা “বিজ্ঞানশিক্ষা” – এসবের প্রকৃতি সমগ্র পৃথিবীতেই কমবেশী একইরকম। খোদ ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে জর্জ বার্নাডশ বলেছিলেন, “একজন ছাত্রকে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী দেওয়া হয় কখন? যখন সেই ছাত্র একটা তথাকথিত শিক্ষাপ্রদানের পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত সে নিজের সম্বন্ধে ভাববার সকল ক্ষমতা হারিয়ে ফেল তখন।”[৫]

শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহারিক শিক্ষাকেও সীমাবদ্ধ করে বিজ্ঞানমনষ্কতাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টাও স্পষ্ট। এইদেশের ইতিহাসে দীর্ঘদিন কোনো ব্যবহারিক বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবস্থাই ছিলোনা। এজন্য খোদ বিজ্ঞানশিক্ষাও বেশ প্রকাশ্যেই সমাজে চলে আসা হাজার বছরের ধর্মশ্রায়ী কুসংস্কারগুলোকে ধারণ করে, এদের রদ করার চেষ্টা করে না। স্রেফ টেকনোলজিতে দক্ষ কর্মী উৎপাদনের জন্য কুসংস্কারকে দূরীকরণের প্রয়োজনও নাই। তাই, খোদ বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাই বিজ্ঞানমনষ্ক নয়। তাঁরাই বয়ে বেড়ান ধর্মাশ্রয়ী কুসংস্কার। তাঁরা শিক্ষার্থীদের মনে সেইসব কুসংস্কারের বীজ বপন করে দেন। পরিবার থেকেও শিক্ষার্থীরা পায় নানান ধরণের ধর্মাশ্রয়ী কুসংস্কারের শিক্ষা। ফলে, উচ্চতর শিক্ষায় দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পেলেও ছোটবেলা থেকে মনের মধ্যে জেঁকে বসা কুসংস্কারগুলো বিজ্ঞানকে মনের মধ্যে আলোড়িত করতে বাধা দেয়।
আবার, আরেকটু ভিন্নচিত্রও দেখা দেয়। যদি আমরা ধরে নেই এইসব শিক্ষার্থীর জীবনে ধর্ম একটা বিরাট প্রভাব ফেলে, তারা ধর্মীয় অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলে – তাহলেও ভুল হবে। এ স্রেফ ধর্মপ্রেম নয়। এ হলো নিখাঁদ কুসংস্কার, নিখাঁদ গোড়ামী। ব্যক্তিগত জীবনে এদের বেশীরভাগও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি নির্ভরশীল নয়, শুধুমাত্র বিজ্ঞানশিক্ষার বেলায় ঘটে সংঘাত, তাও কিছু কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্নে – যেমনঃ কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, ভূগোল ইত্যাদি।
এতো গেল ধর্মাশ্রয়ী কুসংস্কারগ্রস্থদের কথা। আবার, এমনও বিজ্ঞানশিক্ষার্থী দেখা যায় যারা হয়তো বিজ্ঞানচর্চায় পারদর্শী কিন্তু নিজেরা বিজ্ঞানমনষ্ক নয়। অর্থ্যাৎ, উদ্ভাবনীর দিকে এদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। এরা দক্ষ বিজ্ঞানকর্মী হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই বিজ্ঞানী নয়। এরকম উদাহরণ ভরী ভরী যেখানে শিক্ষার্থীর একাডেমিক রেজাল্ট দুর্দান্ত, কিন্তু, তারা মোটেও বিজ্ঞানমনষ্ক নয়। তারা বিজ্ঞানকে আয়ত্ত্ব করতে পারে, তত্ত্বের মারপ্যাঁচ, জটিল-কঠিন সমীকরণ বুঝতে পারে, তা দিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টও করতে পারে কিন্তু, সৃজনশীলতার বেলায় অত্যন্ত কাঁচা। অর্থ্যাৎ, জানাশোনা সমীকরণ, জানাশোনা সমস্যা এরা সমাধান করতে পারে, কিন্তু উদ্ভাবনী শক্তি গড়পড়তা নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানশিক্ষার পরেই এদের লক্ষ্য থাকে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করা অথবা বিদেশে পাড়ি জমানো। আমাদের দেশের সর্বোপরি বিজ্ঞানশিক্ষার যে চল,
যে কাঠামো রয়েছে সেটাই এই সৃষ্টিশীলতাকে নষ্ট করার জন্য দায়ী বলে মনে হয়। তাছাড়া, আমাদের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, ওয়ার্কিং সেক্টরের অভাব এসবও গভীরভাবে জড়িত। এসব ছাড়াও আরও একটি ব্যাপারকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তা হলো, আমাদের সমাজে বিজ্ঞানশিক্ষা একটি এলিট স্থান অধিকার করেছে। এখানে ছেলেমেয়েদের চাপ দিয়ে বিজ্ঞান পড়তে দেওয়া হয়। অনেকের হয়তো থাকে না যথেষ্ট আগ্রহ। তাছাড়া সেই পুরাতন কুসংস্কারগুলোকেও আরও সযত্নে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে বাধ্য করে এই ভাবতে যে – কোনোমতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারলেই হলো, তাহলেই মিলে যাবে একটা চাকুরী। এইরকম মানসিকতা থেকে বিজ্ঞানকে শুধু চর্চা করাই হয়, নিজেকে শুধু কর্পোরেট জগতের জন্য প্রস্তুত করাই হয় কিন্তু, প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষার ফলে মস্তিষ্কে যে যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানমনষ্কতার অনুরণন ঘটার কথা, তা আর ঘটার সুযোগ পায় না। কুসংস্কার, অপশিক্ষা আর রাষ্ট্রীয় দৈন্যের ফলে অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায় এইদেশের বেশীরভাগ শিক্ষার্থীর
বিজ্ঞানমনষ্কতা; বিজ্ঞান আটকে যায় সীমিত পরিসরের মধ্যে। বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনষ্কতা এক জিনিস নয়। বিজ্ঞানমনষ্ক একজন ব্যক্তি সর্বদাই স্বশিক্ষিত এবং শুভব্রতচারী। তাঁরা যদিও জনহিতকর কাজে নিয়োজিত থাকেন। বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের মধ্যে স্বাধীনতাবোধ জাগ্রত হতে বাধ্য। আর, স্বাধীনতাবোধ কর্তৃত্বতন্ত্রের পতন ঘটানোর জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী চেতনা। এতে রাষ্ট্র নামক কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ সমাজের সংস্কার সাধন করেন ঠিকই তথাপি খোদ রাষ্ট্রই তাঁর শত্র“ হয়ে দাঁড়ায়। আবার, উল্টোদিকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে টেকনোলজির প্রতি অন্ধমোহ সৃষ্টি করে। আর, টেকনোলজির প্রতি অন্ধমোহ পারমাণবিক বোমার জন্যও ভালোবাসার জন্ম দিতে পারে। বিজ্ঞানকে তাই ক্ষুদ্র পরিসরে আটক করে ফেললে তা জন্ম দেবে স্রেফ চমকপ্রদ কর্পোরেট খেলনার। এসব খেলনা দিয়ে মানুষ খেলবে ঠিকই, পয়সাও আসবে বহুত, কিন্তু, সংস্কার ভাঙবে না।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পাদটীকা:
[১] মাধ্যমিক বিজ্ঞান নবম ও দশম শ্রেণি, প্রকাশক জাতীয় টেক্সটবুক বোর্ড
[২] বিজ্ঞান ও দর্শন: একটি নিজস্ব পাঠ, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, মুক্তমনা ব্লগ, প্রকাশ: আগস্ট ৩১, ২০১২
[৩] বিজ্ঞান শিক্ষা বনাম বিজ্ঞান মনস্কতা, আমি কোন অভ্যাগত নই, মুক্তমনা ব্লগ, প্রকাশ: জুলাই ৩, ২০১৩
[৪] বিজ্ঞান শিক্ষা বনাম বিজ্ঞান মনস্কতা, আমি কোন অভ্যাগত নই, মুক্তমনা ব্লগ, প্রকাশ: জুলাই ৩, ২০১৩
[৫] মোহাম্মদ মোর্তাজা, শিক্ষার জগাখিচুড়ি: কিন্ডারগার্টেন বনাম মাদ্রাসা, মনীষী ভাবনায় শিক্ষা, পৃষ্ঠা ১০৩

হদীস:
[১] আমি কোন অভ্যাগত নই. (৩ জুলাই ২০১৩). বিজ্ঞান শিক্ষা বনাম বিজ্ঞান মনস্কতা. মুক্তমনা ব্লগ. থেকে উদ্ধার করা
[২] উইকিপিডিয়া. (২৯ নভেম্বর ২০১৩). বিজ্ঞান. উইকিপিডিয়া. থেকে উদ্ধার করা
[৩] ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী. (৩১ আগস্ট ২০১২). বিজ্ঞান ও দর্শন: একটি নিজস্ব পাঠ. মুক্তমনা ব্লগ. থেকে উদ্ধার করা
[৪] মাধ্যমিক বিজ্ঞান নবম ও দশম শ্রেণি. জাতীয় টেক্সটবুক বোর্ড.
[৫ ]মোহাম্মদ মোর্তাজা. (২০০৯). শিক্ষার জগাখিচুড়ি: কিন্ডারগার্টেন বনাম মাদ্রাসা. মনীষী ভাবনায় শিক্ষা (পৃ. ১০৩).-এর

Loading

1 thought on “বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান মনস্কতা”

  1. অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তব একটি লেখা যা আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করল।

    Reply

Leave a Comment