কর হানি দ্বারে নবযুগ ডাকিছে তোমারে

বাঙালির জীবন মানেই যেন বারো মাসে তেরো পার্বণ। রঙের ছড়াছড়ি, রূপ, রস,গন্ধ! বছর শেষের শুরু হতে না হতেই যেন নতুন বছর শুরুর শেষ ঘনিয়ে আসে। এভাবেই কাটছে বাঙালির যুগ যুগান্তর। নববর্ষকে নব নব রূপে বরণ করে নিতে বাঙালি তাই আকুল পাগলপারা!

তবে বলতেই হয়, চৈত্রের বিদায়েও কিন্তু কম আড়ম্বর থাকেনা। চৈত্র সংক্রান্তিতে গেয়ে ওঠা হয়, “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও, যাও গো এবার যাবার আগে।” চৈত্রের বিদায়ে তেঁতো খাওয়া, গানে গানে পুরনো সুখ দুঃখের স্মৃতিকে বিদায় জানানো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। নতুনের আশায় বুক বেঁধে স্মৃতিকাতরতায় বর্ষবিদায়।

পহেলা বৈশাখ আমাদের জন্য এক অতি আনন্দের দিন। এই বাংলা নববর্ষের ইতিহাসটাও বেশ পুরনো। বহুকাল আগে থেকেই হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা সনের চল ছিল,যা শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকা মতে এপ্রিলে মাঝামাঝি সময় থেকে। তাই কৃষিপ্রধান বাংলায় নববর্ষের প্রথম দিন আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পালন করা হতো অনেক আগে থেকেই। তবে এখন যেমন এর একটি সার্বজনীন রূপ আমরা দেখতে পাই,তখন তেমনটা ছিলোনা।

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল। তাই ফলনের সাথে সেটি মিলতো না বলে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন।তো, সম্রাটের এই আদেশ অনুসারেই তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম প্রণয়ন করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে তা গণনা শুরু হয় এবং এই পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথম প্রথম নাম ছিল ফসলি সন, পরে নামকরণ হয় “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ। আর এভাবেই আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা শুরু হয়। উৎসব উদযাপিত হতো ভূমির মালিকদের খাজনা আদায়ের পর অধিবাসীদের আপ্যায়ন করা, দোকানদারদের ক্ষেত্রে নতুন হালখাতা তৈরি ও ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন দিয়ে। এই উৎসব করা, আপ্যায়ন এসব মিলিয়েই এই দিনটির আবেদন তাই বাঙালির কাছে অন্যরকম, যা সেই সময় থেকেই বাঙালির রক্তে মিশে গেছে।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের নজির প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়! ১৯৩৮ সালেও একই কাজ করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমনভাবে প্রচলিত ছিলোনা।

১৯৪৭ এর পর থেকে পূর্ববঙ্গে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসন। ধীরে ধীরে বাঙালির পরিচয়ে আঘাত আসতে থাকলে ১৯৬০ এর দশকে এরই প্রতিবাদস্বরূপ ১৯৬৭ সনে রমনা বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা হয়। সেই থেকে এই রীতি চলে আসছে। বর্ষবরণ উৎসবের প্রাণকেন্দ্র যেই রমনা বটমূল, স্বাভাবিকভাবেই­ অনেকে মনে করে থাকেন সেখানের ছায়াসুনিবিড় বৃক্ষটি বটগাছ। মজার কথা হলো, প্রকৃতপক্ষে সেটি কিন্তু বটগাছ নয় একটি অশ্বত্থগাছ।

রমনার এই বটমূলে প্রতিবছর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ছায়ানটের শিল্পীরা সমবেত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেন। সেইসাথে বরণ করে সারাদেশ। পহেলা বৈশাখের আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতিবছরই রঙবাহারি শিল্পসামগ্রী যেমন :মুখোশ,পুতুল, বাঁশি এসবের মাধ্যমে শোভাযাত্রা বের করে বৈশাখকে উদযাপন করে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরাসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। এটি প্রতিফলিত করে বাঙালির জীবনযাত্রাকে। এই ‘শোভাযাত্রা’র শুভসূচনা হয়েছিল ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনার মধ্য দিয়ে। এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে প্রতিবাদস্বরূপ ও বাঙালি চেতনাকে জাগ্রত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এটি আমাদের পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর অধরা বা ইনট্যানজিবল সাংস্কৃতিক ঐতিহ‌্যের তালিকায় স্থান লাভ করেছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের খবর, গৌরবের তো বটেই!

এই যে পহেলা বৈশাখ,এই যে আনন্দের ছড়াছড়ি, মেলা, লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নতুন বছরকে বরণ করার এই যে শুভ প্রচেষ্টা-এসব কী নিছকই বিনোদন? এই প্রশ্ন আজ তুলতেই হয়!

পহেলা বৈশাখ উদযাপন থেকে শুরু করে এর প্রতিটি অঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য এক পরিচয়। অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র, অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার প্রেরণা। কিন্তু আজকাল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইতিহাস নিয়ে অনাগ্রহ কিংবা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা-এমন নানামুখী কারণে তরুণসমাজ কেবল পহেলা বৈশাখের তথাকথিত বিলাসিতা আর রোমান্টিসিজম এই আটকে যাচ্ছে। তাদের চেতনাগত জায়গাটা একেবারেই শুন্যের পর্যায়ে নেমে আসছে। পহেলা বৈশাখ মানেই কেবল আড্ডাবাজি, পান্তা ইলিশ খাওয়া, সবশেষে একঘেঁয়েমি কাটাতে কিছুক্ষণ পরই ভিনদেশী গানে সুর তুলে দেয়া- এই সংজ্ঞা ভুলে যাবার সময় কিন্তু হয়েছে। পহেলা বৈশাখ কেবল বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে ঘোরাফেরা নয়। তুমি কেবল লাল পেড়ে সাদা শাড়ি নাহয় খাদি পাঞ্জাবী পড়েছো বলেই যে রাতারাতি বাঙালি হয়ে গেছো, প্রতিটা জাতীয় দিবসে প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করছো, দায়িত্ব পালন হয়ে গেছে(!), “এই তো চেতনায় পরিপূর্ণ তুমি!” -এমনটা ভাবলে তা নেহাৎই বাতুলতা। পহেলা বৈশাখ যেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে বলে, সেটাই আসলে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানে রহিম, গৌতম, অমিত, অ্যানথনি চার বন্ধু যেখানে বৈশাখে মুড়ি-মুড়কি কিনে খায়! বাংলাদেশ মানেই ঠান্ডা লেগেছে বলে পাশের বাড়ির তুলসী গাছ থেকে পাতা চেয়ে নিয়ে এসে চা বানিয়ে খাওয়া! বাংলাদেশ মানে পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে বেহায়াপনা নয়। বরং একটা মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে বলে তাকে চলে যাওয়ার জায়গা করে দেয়া। বাংলাদেশ মানে মালাউন বলে গালাগাল নয়, বাংলাদেশ মানেই ভাই বলে বুকে টেনে নেয়া। বাংলাদেশ মানে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল দুটো নাম একসাথে। বাংলাদেশ মানেই, “আমরা সবাই বাঙালি!” পহেলা বৈশাখ আমাদের ঠিক সেই জায়গাটায় এক সারিতে দাঁড়াতে বলে। পহেলা বৈশাখের অনন্যসাধারণ এই চেতনাটিকে আমরা যেদিন মনে ধারণ করতে পারবো, নিঃসন্দেহেই সেটি হবে আমাদের বিজয়। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে পা দিয়েও প্রকৃত স্বাধীনতা খুঁজছি আমরা। এই অসাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে প্রত্যেককেই। তবেই আজ যেসব সমস্যা আমাদের পা টেনে ধরেছে, যেসব অশুভ কালোছায়ায় আচ্ছাদিত হবার ভয়ে আমরা পালিয়ে বেড়াতে চাইছি- সেগুলো নিজেই পালিয়ে যেতে বাধ্য! আর এই যাত্রা শুরু করতে হবে এখনই, যার নেতৃত্বে থাকতে হবে এদেশের তরুণদের-যারা এদেশের সম্ভাবনা। এই চেতনা ছড়ানোর কাজটাও করতে হবে তাদেরই। জয় হোক বাঙালির, জয় হোক পহেলা বৈশাখের! শেষ করবো আবদুল কাদিরের “জয়যাত্রা” কবিতার লাইন দিয়ে।

“যাত্রা তব শুরু হোক হে নবীন,
কর হানি দ্বারে নবযুগ ডাকিছে তোমারে!

লেখকঃ শিক্ষার্থী, হলিক্রস কলেজ, ঢাকা। 

Loading

Leave a Comment