সাংস্কৃতিক অবকাঠামো

সংস্কৃতি একটা বিশাল শব্দ। এটা কি মহাসাগরের মতো? নাকি সাগরের মতো? নাকি এটা একটা বিশাল দ্বীপ? আমি জানিনা! তবে cultural ethnocentrism নামে একটা টার্ম আছে। যে টার্ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ।

ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক! ধরা যাক, রহিমের একটা পেন্সিল আছে। Faber Castle! সে ক্লাসে গিয়ে ঘোষণা দিলো, তার পেন্সিলটা সবচেয়ে সুন্দর। করিম বললো, না তারটে সবচেয়ে সুন্দর! লেগে গেল মারামারি! রহিম তার পেন্সিলটা সুন্দর প্রমাণ করার জন্য নৃশংসভাবে ভাবে মারল করিমকে! করিম তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মেনে নিলো, রহিমের পেন্সিলটাই সুন্দর! অথচ, তার পেন্সিলটাও কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর হতে পারত! ( অথবা ধরে নিলাম ,সেটা মোটেও সুন্দর বা শ্রেষ্ঠ হতে পারতনা; কিন্তু কোন কিছুকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার যে প্রক্রিয়া সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত?) খুব সহজ কথায়, এই যে নিজের পেন্সিলটাকে জোর করে সুন্দর বানানোর যে প্রচেষ্টা বা সবচেয়ে সুন্দর কিংবা শ্রেষ্ঠ মনে করা, সেটাই হলো cultural ethnocentrism!

ইউরোপিয়ানরা হলো এই মতবাদ প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় কারিগর। উপনিবেশবাদ সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশী জানি। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে কয়টা কারণ মুখ্য তার মধ্যে একটা হলো নিজের সংস্কৃতিকে জোর করে হলেও অন্য সংস্কৃতিতে মেশানো কিংবা অন্য সংস্কৃতির উপর প্রভুত্ব আরোপ। আমাদের এখন যে সংস্কৃতির ভেতর যাপন , সেটা দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায় ইউরোপিয়ানরা কতটা সফল। মানসিক দাসত্বের রেললাইন ধরে চলতে চলতে এখনো আমরা মনে করি, ইংরেজী বলাটা স্মার্টনেস! এখনো এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির অন্যতম শর্ত ইংরেজীতে ভালো করা! এখনো এদেশের দাপ্তরিক কাজের একটা বড় অংশ সারা হয় প্রভুদের ( স্বঘোষিত প্রভু!) ভাষা ইংরেজীতে! সহজ কথায়, আমরা এখনো সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের শিকার।

ইউরোপিয়ান বিশেষত ইংরেজরা কিন্তু এই কাজটা করেছে সূক্ষ্ণভাবে। তারা প্রথমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে নিজেদের প্রভুদের আসনে বসিয়েছে ( ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে, অন্য অনেক দেশে অন্য রকম পলিসি ছিলো) , তারপর অধিকৃত দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষদের বুঝিয়েছে আমরা তোমার প্রভু, আর প্রভুর ভাষা যে সেরা, প্রভুর আচার আচরণ যে সেরা এটা কি তোমাদের হাতে কলমে বুঝিয়ে দিতে হবে? সৈয়দ আমীর আলী, নওয়াব আব্দুল লতিফ, জোঁড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার কিংবা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী কাউকেই তাই বুঝিয়ে দিতে হয়নি। তারা বরং মানুষকে বুঝিয়েছে, ইংরেজরা হলো আলোর দিশা। আমরা যেহেতু অন্ধকারে আছি, কাজেই আমাদের আলোর দিকে যেতে হবে। আমাদেরকে শিখতে হবে ইংরেজী ভাষা। আমাদের রপ্ত করতে হবে কোট-টাই সংস্কৃতি! এমনকি দামদো নদী সাঁতরানো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে কিনা বুঝতে পেরেছিলন পরাধীনতার সমূল যন্ত্রণা -তিনিও বলেছিলেন, আমাদের পূর্ব আর পশ্চিমের দর্শন যৌথভাবেই পড়তে হবে! নইলে আমরা বুঝবনা আমাদের দর্শন কতটা ভ্রান্ত!

মানুষ কিন্তু তবুও বুঝেছিল! ফলে জন্ম নিয়েছিল আরেকটা শ্রেনী! মধ্যবিত্ত শ্রেনী। যাদের সাথে সাধারণ মানুষের ধীরে ধীরে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। যেটার একধরণের পূর্ণতা আমরা দেখতে পাই বর্তমান সমাজে। আমরা একটা খেয়াল করলেই দেখতে পাবো, সাধারণ মানুষের ( এখানে সাধারণ মানুষ বলতে নিম্নজীবি মানুষকে বোঝানো হচ্ছে) সাথে সমাজের অন্যন্য শ্রেণীর একটা দৃশ্যত ফারাক। যদিও বর্তমান বাংলাদেশী সমাজ- দেশীয় সংস্কৃতি, ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি, আরবীয় সংস্কৃতির খানিকটা জগাখিচুড়ি ও অসম্ভব জটিল। তবে, এই দেয়ালটা সহজেই চোখে পড়ে। অথবা চোখে না পড়লেও অন্তত চোখে পড়ে সমাজে বেশ প্রকটভাবে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ।

যদিও, ২০০ বছরের কলোনিয়াল জার্নি, বিশ্বায়ন (পশ্চিমাদের নয়া পলিসি) , আকাশ সংস্কৃতি, তথ্যের অবাধ প্রবাহ সহ নানা নিয়ামকের কারণে আমরা এখন আর ফিরে যেতে পারবনা আমাদের পিছনে। তাছাড়া, আমরা আমাদের বিদ্যমান টুলস নিয়ে কখনো মেরামত করতে পারবনা আমাদের ইতিহাস, আমরা খুব সহজে বাধা দিতে পারবনা সংস্কৃতির আগ্রাসন, প্রবাহ(প্রবাহকে বাধা দেয়া টেকনিকালি পসিবল না); তাছাড়া আমরা এও জানি সংস্কৃতি ধ্রুব না- এটা পরিবর্তনশীল – কাজেই আমরা কিভাবে রুখব cultural ethnocentrism এর প্রভাব? খুব সত্যকথা বলতে গেলে, এর কোন তাত্ক্ষণিক সমাধান নেই। এটা একটা লং রান প্রসেস। কিন্তু আমরা একটা জিনিস জানি যে, হারনান কর্টেয সহ অন্যন্য স্পানিশ আধিপত্যবাদীরা কিভাবে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যাযটেক – ইনকা সভ্যতাকে গুঁড়ো করে বীরদর্পে উড়িয়েছে ইউরোপিয়ান পতাকা। কিভাবে হারিয়ে গেছে quechua, aymara , mayan সহ অন্যন্য ভাষা। রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষাও এখন পুরোপরি মৃত। আমেরিকার অফিশিয়াল ভাষা ইংরেজী। মেক্সিকো, পেরু, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব দেশেই এখন অফিসিয়াল ভাষা স্প্যানিশ। মাত্র পাঁচশ বছরেই ওইদেশের মাটির সাথে ছিন্ন হয়ে গেছে ভাষার সম্পর্ক! কিন্ত আমরা কিন্তু ভাগ্যবান। যে ভাষায় চর্যাপদ লেখা হযেছে, অবিকল সেই ভাষাতেই আমরা এখনও কথা বলতে পারি। আমাদের ভাষা এখনো জীবিত( যদিও ভাষা ধ্রুব না), রোজ স্পন্দিত হয় গলিতে- ফুটপাতে, শোবার ঘরে, টং দোকানে মুখরিত আড্ডায়। কাজেই আমাদের বর্তমান কাজ হওয়া উচিত, কলোনিয়াল জার্নির হ্যাংওভার কাটিয়ে বাংলা ভাষাকে প্রাধাণ্য দেওয়া। আমরা ইচ্ছে করলেই, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সর্বস্তরে বাংলাভাষার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিতে পারি। ইচ্ছে করলেই, উচ্চ শিক্ষার ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও বুদ্ধিজীবিদের সহযোগিতা। ধরে নিচ্ছি, মৌলিক গবেষণায় বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে। বাংলাদেশের এখনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন সেইভাবেই হয়নি। এখনো এদেশে গণতন্ত্র মানে স্রেফ ভোটাধিকার,এদেশ এখনো অর্থনীতিতে স্থিতিশীল নয় ; এও মেনে নিচ্ছি উন্নয়ন একটা সামগ্রিক ধারণা কিন্ত এটা ঠিক যে কোন একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করেই একটা বৃত্ত রচনা হয়। আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষাকে উচ্চশিক্ষার ভাষা হিসেবে প্রাধাণ্য দিতে পারি তাহলে একদিকে যেমন মানুষের জন্য ব্যাপারটা সহজ হবে, তেমনি বাড়বে মানসিক উৎকর্ষতা, সেই সাথে সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাপারটা আরেকটু ত্বরান্বিত হবে।

আমাদের আর জোর করে ইংরেজী পড়তে হবেনা। এই ভেবে অবসেসনে ভুগতে হবেনা যে- আমি ইংরেজী পারিনা। ইংরেজী না পারার কারণে আমি প্রভুর কাছে খারিজ হয়ে যাবো।

আর যেখানে সংস্কৃতির প্রভু নিজেই নিজেকে তৈরী করে আধিপত্য করছে আমাদের দেশে, সেখানে আমার এই যে খারিজ হয়ে যাওয়া সেটা কেনো সামাজিক নর্ম হয়ে দাঁড়াবে? কেনো, ইংরেজীতে পাশ করতে না পেরে পনের বছরের শরীর ঝুলবে আমগাছের ডালে?

লেখকঃ শাদ আশরাফ
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।

সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ- বদরুদ্দীন উমর

Loading

Leave a Comment