বেঁচে থেকো মেঘ রোদ আর ঘাসফুলের জন্য

আমরা কত অদ্ভূত! তাই না? আমাদের পরীক্ষা দিতে ভালো লাগেনা, সারাদিন পড়াশোনা করতে ভালো লাগেনা, কিন্তু পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে বই পড়ার মত ( পাঠ্যবই নয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় অপাঠ্যবই!) চমৎকার একটা কাজ করতে চাই না। খুব সাবধানে, সযত্নে নিজেদের বই পড়ে সময় নষ্ট করা থেকে দূরে রাখি। একটা অপ্রিয় কাজের যেন ক্ষতি না হয়, সেজন্য একটা সুন্দর কাজ করা থেকে দূরে থাকি। এত অদ্ভুত কেন আমরা! আবার আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আরও বেশি অদ্ভুত। অপাঠ্যবই এদের এতই ভালো লাগে যে এটা তাদের পড়াশোনার ক্ষতি করতে পারে, এই পরম সত্য (!) টা তারা বোঝেই না! কিন্তু এসব অতিঅদ্ভুত মানুষের চারপাশের মানুষগুলো প্রাণ পণে চেষ্টা করেন এদের সুপথে আনতে, অপাঠ্যবই যে কতখানি ক্ষতির কারণ তা বোঝাতে। অবশেষে বই এর প্রতি ভালোবাসা কমাতে না পেরে শর্ত জুড়ে দেন – যাই কর, পড়াশোনার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এই মানুষগুলো আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, আমাদের ভালো চান সত্যিই। কিন্তু আমরা যে কিসে ভালো থাকি, তা প্রায়শই বুঝতে পারেন না। অবশ্য এটা নির্ভর করে ভালো থাকা কাকে বলে তার ওপর। ভালো থাকার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। তোমরা যারা প্রথম ধরনের অদ্ভুত মানুষের মধ্যে পড়, তাদের বলছি – ভালো থাকা মানে কী?

ভালো করে পড়াশোনা করার মানেই বা কী? সব বিষয়ে বেশি বেশি নম্বর পাওয়া? জিপিএ ৫ পাওয়া? ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়া? ভালো চাকরি পাওয়া…..? তারপর? দিনশেষে কী পেলে? অনেক তো পড়লে পাঠ্যবই। এবার একটু বসো না একটা অপ্রয়োজনীয় অপাঠ্য বই নিয়ে। এখান থেকে হয়তো তোমার পরীক্ষায় কোনো প্রশ্ন আসবে না। কিন্তু কিছু না কিছু একটা পাবেই। প্রশ্ন করতে পারো কী এমন পাবো? আর সেটা যখন পরীক্ষায় ভালো করতে কোনো কাজে লাগবে না, কী হবে সে পাওয়া দিয়ে?

এটা খুব সুন্দর প্রশ্ন হতে পারে! এবার আমি একটা প্রশ্ন করি? -তুমি বৃষ্টিতে ভেজো না? গান শোনো না? ক্রিকেট দেখো না? ফুটবল খেলো? কিংবা ব্যাডমিন্টন? সাঁতার কাটো তো? বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাও, পিকনিক করো, মুভি দেখো- কি? করো না এইসব? পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে এসব থেকে?

মনে হয় না। তাহলে কেনো করো? মজার ব্যাপার হল, বৃষ্টিতে ভিজলে, গান শুনলে, খেলা দেখলে বাবা – মায়েরা বলেন যে এগুলো রিক্রিয়েশান, দরকার আছে এসবের। আর যদি পরীক্ষার আগে তুমি এমন একটা কবিতাও পড় যেটা সিলেবাসে নেই কিংবা পাঠ্যবইয়ের বাইরের একটা গণিতের সমস্যা সমাধান করতে বসো, তাহলে তো সর্বনাশ!

এমন অনেক দেখেছি – একটা ছেলে বা মেয়ে হয়তো গণিত অনেক ভালোবাসে, পাঠ্যবই এর বাইরের একটা সমস্যা সমাধান করতে বসেছে, এটা দেখে বাবা-মা বললো – এসব কাজে সময় নষ্ট(!) না করে বইয়ের পড়া পড়ো। এক জায়গায় হয়তো একটা বিতর্ক কর্মশালা হচ্ছে। ছেলেটা বা মেয়েটা যেতে চাইলো। প্রথম প্রশ্ন যেটা আসবে সেটা হল – এটা পড়াশোনা রিলেটেড তো!

আচ্ছা, সবকিছুতে কেন এত শর্ত জুড়ে দেয়া? কেন আমরা সবকিছুতে এত হিসেব কষি? হিসেব যদি করতেই হয় তো চলো না একটা গণিতের সমস্যার সমাধান করি। পরীক্ষায় আসবে না হয়তো, কিন্তু যতক্ষণ সমস্যাটা নিয়ে ভাববে, কীভাবে সমস্যাটার সমাধান করতে হবে সেটা একটু একটু করে বুঝতে থাকবে এবং শেষমেষ সমাধান করেই ফেলবে- তখন একটা নির্ভেজাল আনন্দ পাবে – এইটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি! অংক করতে ভালো লাগে না? ব্যাপার না! সবার এক জিনিস ভালো লাগাটাও জরুরী না। কল্পনা করতে ভালো লাগে তো? তাহলে চল কল্পনা করি- মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্রহের মাঝে একটি ছোট্ট গ্রহে থাকে এক ছোট্ট ছেলে। একাই। অনেক কাজ তার। গ্রহটার দেখাশোনা করা, গাছগুলোকে পানি দেয়া, ফুলগুলোকে রক্ষা করা, আর ভয়াবহ গাবগাব গাছের চারা – যা দেখতে নিরীহ, কিন্তু বড় হয়ে শেকড় গজিয়ে পুরো গ্রহটাকে নষ্ট করে ফেলে – সেই গাবগাব গাছ খুঁজে বের করে সময়মত উপড়ে ফেলা। আর হ্যাঁ, ছেলেটির অনেক ভালো লাগে সূর্যাস্ত দেখতে। গ্রহটা ছোট তো! নিজের অক্ষে ঘুরতে বেশি সময় লাগে না। তাই অল্প সময়ের মাঝেই অনেকবার সূর্যাস্ত দেখতে পারে ছোট্ট ছেলেটি। ‘ দ্য লিটল প্রিন্স ‘ বইয়ের কাহিনী এটা। পড়ে দেখো। ভালো লাগবে।

অথবা কারো হয়তো কল্পনা করতে ভালো লাগে ভবিষ্যৎ সভ্যতার কথা – যার কর্তৃত্ব যন্ত্রের হাতে চলে গেছে কিংবা যে সভ্যতা ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেখানে হঠাৎ মানুষের মাথা তুলে দাঁড়ানো, অন্ধকার সময়ের অবসান নতুন করে বেঁচে ওঠা – ফিনিক্স পাখির মত! তাহলে একটা সায়েন্স ফিকশান পড়ে ফেলো না!
বই পড়তে আর ভালো লাগছে না? তাহলে বেরিয়ে পড়! ভোরবেলায় সবুজ ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা সাদা শিউলি গুলো ছুঁয়ে দেখো, পিচঢালা রাস্তায় পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া দেখো। এমনি দেখো, অকারণে দেখো, পরীক্ষায় আসবে না! তবুও দেখো!

অনেক তো দেখলে- এবার একটা ক্যানভাস নাও। রাঙিয়ে তোলো ইচ্ছেমত। কিছু আঁকতে হবে না, ছবি আঁকা পারতেও হবেনা। এমনি হালকা নীল, গাঢ় নীল, নীল অপরাজিতার মত নীল – রঙে রঙে ভরিয়ে তোলো! পরীক্ষার বেশি নম্বর পাবে কিনা জানিনা, কিন্তু ভালো লাগবে।

এত সাবধানে গা বাঁচিয়ে না চলে, শুধু পরীক্ষার নম্বরের কথা না ভেবে একটু অন্যভাবে ভাবো। বই পড়, গণিত কর, ছবি আঁকো, বিতর্ক কর, কবিতা পড়, ইতিহাস জানো। বইমেলা চলছে, বইমেলায় যাও। যা করবে মন থেকে কর। এ.পি.জে আবদুল কালাম কী বলেছেন জানো? ” যারা মন থেকে কাজ করে না, তারা আসলে কিছুই অর্জন করতে পারেনা। আর করলেও সেটা হয় অর্ধেক হৃদয়ের সফলতা। তাতে সবসময়ই একরকম তিক্ততা থেকে যায়।” তিক্ততা রেখে কী লাভ বল তো!

জোনাথন সুইফটের খুব সুন্দর একটা উক্তি আছে – May you live all the days of your life. তাই বাঁচার মত করে বাঁচো। খুব ছোট ছোট জিনিসেও মুগ্ধ হও; তীব্রভাবে মুগ্ধ হও। ছোট্ট একটা ঘাসফুলের জন্যে বাঁচো,একফোঁটা শিশিরের জন্যে বাঁচো, এক পশলা বৃষ্টির পর মেঘ-রোদ্দুরের খেলা আর বৃষ্টি – ধোয়া পাতার সতেজ সবুজ রং দেখার জন্যে বাঁচো- বাঁচো ছোট্ট অথচ অদ্ভুত সুন্দর একটা স্বপ্নের জন্যে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Loading

Leave a Comment