ঠগী

সে অনেকদিন আগের কথা, এই মায়াময় ভারত উপমহাদেশ তখন কুয়াশায় ঘেরা এক স্থান। সেই কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়ায় বাধা ছিল না কারও।হারিয়েও যেত অনেকে। সৈনিক ছুটিতে গিয়ে আর ফিরত না, তীর্থ যাত্রী হারিয়ে যেত অহরহ, আত্মীয়স্বজন বুকে পাথর বেঁধে নিশ্চিত স্বর্গ প্রাপ্তির সান্ত্বনা দিত নিজেকেই। আর এই হারিয়ে যাওয়ার সিংহ ভাগের জন্য যারা দায়ী ছিল তারা হল ঠগী, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নিখুঁত আর নির্দয় খুনি সম্প্রদায়। তাদের হাতে নারী-পুরুষ -শিশু কেউ রেহাই পেত না, রেহাই পেতনা এমনকি জমিদার রাও।তাদেরকে সবচেয়ে দুধর্ষ আর নিখুঁত কি অস্ত্র ছিল এই দুর্ধর্ষ খুনিদের? ঢাল তলোয়ার কামান?  না, তাদের অস্ত্র ছিল নির্দোষ চেহারার রেশমি রুমাল! এই রুমালে মোটামুটি মাঝের দিকে বাঁধা হত একটি এক পয়সা বা দুটি আধুলি। ব্যাস, হয়ে গেল ভয়ঙ্করতম এক অস্ত্র। এই অস্ত্র কোমড়ে পেঁচিয়ে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় ঘর থেকে বের হত তারা। সকল ঠগীই ছিল সনাতন দেবী কালীর উপাসক।
এমনকি ঠগীদের মাঝে ছিল মুসলমান রাও, তাদের জিজ্ঞাসা করলে বলত – ধর্ম কি? মুসলমান দেবী কে? কালী (!) ঠগীদের মতে তাদের উদ্ভবের গল্প অনেকটা এরকম –
একবার দেবী কালী অসুরদের সাথে যুদ্ধ করছিলেন, কিন্তু অসুরদের প্রতি ফোঁটা রক্ত থেকে জন্ম নিচ্ছিল আরও সহস্র অসুর। তাই দেবী তার ঘাম থেকে জন্ম দিলেন ঠগীদের, আর হাতে তুলে দিলেন নিজের রুমাল। সেই থেকে ঠগীরা হত্যা করতে নামল। ঠগীদের তাই হত্যা করার প্রধান উদ্দেশ্য লুট করা ছিল না, বরং এটা ছিল তাদের কাছে পবিত্র ধর্মীয় আচার। তাই তারা খুন গুলো করত ফ্যানাটিক দক্ষতার সাথে। আর লুটের সম্পত্তি ছিল তাদের নিকট দেবীর উপহার। যেহেতু লুটপাট প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না, তাই ভিক্ষুক থেকে আরম্ভ করে সম্পদশালী  জমিদার কেউই রক্ষা পেত না। এদের খুনের ধরন ছিল এরকম, প্রথমে দল বেঁধে তারা টার্গেট করা দলের সাথে ভিড়ে যেত। বিপদসঙ্কুল পথে সাথী পেয়ে টার্গেট দল ও বেশ খুশি হোত। আর ঠগী দলের সর্দার পাঠিয়ে দিত নিজ দলের কাউকে আগেই গিয়ে রাস্তায় সুবিধাজনক জায়গা ঠিক করতে। সেই সময়ে ঠগীদল আন্তরিক আচরণে হয়ে ঊঠত টার্গেট দলের বন্ধু। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছনোর পর ঠগী সর্দার সেখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিত, সাধারণত টার্গেটও খুশি মনে রাজি হত। রাত গভীর হলেই শুরু হত আসল “খেলা “। টার্গেট দলের সবার উপর একসাথে আচমকা আঘাত টা আসত। একজন ধরত পা, একজন পা, আর একজন গলায় পরাত সেই বিখ্যাত রুমাল। ঠগীদের আক্রমণ থেকে কেউ কখনো বেঁচে ফিরেছেন এমন টা শোনা যায় না।ঠগীরা সুযোগ মত নিঃসঙ্গ পথচারীদের ও হত্যা করত। হত্যার পর লাশগুলো গোলাকৃতি কবরে কবর দেয়া হত। সেই কবরদেয়ার প্রক্রিয়া ও রীতিমতো বিশাল নিয়ম অনুসারে হত। সময় পেলে অন্য কোনদিন লিখব। ওহ আর একটা কথা না বললেই নয়, এই ঠগী দের ধ্বংস করেছিল স্লীমান নামক এক ইংরেজ।তিনি শুধু ঠগীদের এই ভয়াবহ পেশা থেকে সরিয়েই আনেন নি, তাদের পুনর্বাসন ও করেছেন। ঠগীদের হাতে নির্মিত একটা কার্পেট এখনো ইংল্যান্ড এর রাজপ্রাসাদে  আছে। ঠগীদের ইংরেজ রা বলত Thuggee, এখান থেকেই ইংরেজি শব্দ Thug এর উৎপত্তি। এছাড়া Confession of a Thuggee  নামক একটি বিখ্যাত উপন্যাস আছে, উপন্যাস টা খুবই সুখপাঠ্য, তবে বাস্তবতা বিবর্জিত ও লেখকের কল্পনা প্রসূত। সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ঠগীরা, ব্যতিক্রম ছিল না বাংলাও। আরও ভাল করে বলতে গেলে, কলকাতার কালীঘাট ছিল সমস্ত ঠগীদের তীর্থক্ষেত্র। লুটের মাল থেকে কিছুটা অংশ সব সময় সরিয়ে রাখা হত কালীঘাটে নিবেদনের উদ্দেশ্যে। এছাড়া বাংলার ঠগীরা ছিল বাকিদের থেকে আলাদা। কারণ তারা শিকার ধরত নদীপথে। ফাঁস দেয়ার জন্য তারা রুমালের পাশাপাশি দড়িও ব্যবহার করত। আগেই আলোচনা করেছি, মানুষ হত্যা ছিল ঠগীদের পবিত্র ধর্মীয় আচার। তাই মৃতদেহ কবর দেয়ায় ছিল নানা আচার অনুষ্ঠান। কিন্তু বাংলার ঠগীদের এসবের বালাই ছিল না। তারা মৃতদেহ পানিতে ভাসিয়ে দিত। তাদের বিশ্বাস ছিল, বাকি কাজ মা কালী নিজেই করবেন। তারপরও বাংলার ঠগীরা ঠগীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কারণ, তারাও ঠগীদের নিজস্ব সাংকেতিক ভাষা “রামসী” ব্যবহার করত। তাদেরও দেবী ছিল মা কালী। আর প্রতিনিয়ত মাটির ঠগী মিশে যেত পানির ঠগীদের সাথে, নিপুণ দক্ষতায় এক সাথে খুন করত। ঠগীরা সব সময় ছোট ছোট দলে বেড়িয়ে যেত। দলের সবচেয়ে বয়স্ক আর দক্ষ ঠগী হত দলনেতা। যখন তারা কোন টার্গেট ঠিক করত তখন দলনেতা দল থেকে দুই  তিন জনকে টার্গেট এর উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য পাঠাত। রামসীতে এদের বলা হত তিলহাই। তারপর মূলদল মিশে যেত টার্গেটের সাথে। কোন এক অসতর্ক মূহুর্তে দলের সরদার “ঝিরণি” অর্থাৎ খুন শুরু করার আদেশ দিতেন। এরপর মিনিট খানেকের মাঝে সব শেষ। আরও বিস্তারিত নাহয় বলব অন্য কোন দিন। শেষ করছি বুকুত জমাদার নামে এক দূধর্ষ ঠগীর জবানবন্দি থেকে কিছুটা অংশ নিয়ে-
“শরৎকালের কথা। আমরা পাঁচজন বেড়িয়েছি। আমি, ঠাকুরি, ধোকুল, পান্ডে আর মোকলাল। ঝাঁসি, ভিলসা, রোলি হয়ে আমরা ভূপাল চললাম। কিন্তু ভূপাল গেলাম না। শহর ডানে রেখে নর্মদা পার হলাম। চীপানেরে গাঁয়ের পাশে নদী, গাঁয়ের ধারে মস্ত পাকুড় গাছ। হঠাৎ চোখে পড়ল কিছুদূরে অনেক লোক জটলা পাকিয়ে আছে। আমাদের একজন খবর নিয়ে এল, ওরাও আমাদের মতোই, দেবীর সন্তুষ্টির জন্য পথে নেমেছে। কিন্তু  আমাদের মত ওরাও এখনো কোন শিকার পায় নি। সে দলে প্রায় তিন কুড়ি । কিছু ছিল রোসন  জমাদারের লোক, কিছু গুলাব খাঁয়ের, কিছু মাদারি শেখের, কিছু মুরলি ঠাকুর এর। আমরাও জুটে গেলাম। নাগপুর আর জব্বলপুরের মাঝখানে পেলাম প্রথম শিকার, মুন্সী শেখের দল। সংখ্যায় তারা দু কুড়ির কিছু কম। মুন্সীর অনুমতি নিয়ে তাদের সাথে চলতে লাগলাম। দুদিন পর খবর এল, সেপাই আসছে। সাথে গোরা সাহেব। শুনে ঘাবড়ে গেলাম, সিদ্ধান্ত হল, আজ রাতেই ঝিরণি উঠবে। সন্ধ্যার দিকেই সেপাই চলে এল। সন্ধ্যা হতেই সাদি খানকে মুন্সীর তাঁবুতে পাঠানো হল সাদি খান কে। সে ভাল সেতার বাজাতো, কারণ মুন্সীর বিবির গানবাজনা র শখ ছিল। শুরু হল গান। আমরা মুন্সীর কোমড়ের তলোয়ারটা একটু দেখব বলে কথায় কথায় চেয়ে নিলাম। মুন্সীর বিবি আর ছেলেমেয়েরা তখন সেতারে মশগুল। এই সময় রোসন জমাদার ঝিরণি দিল। কি করে যেন মুন্সী মুহূর্তে সব বুঝে গেল। সে আমাদের ঠেলে ফেলে খুন খুন বলে দে ছুট। কিন্তু দু পা যাওয়ার আগেই তাকে শুইয়ে দেয়া হল। মুন্সীর বিবি আর চাকরগুলো অবশ্য গলায় রুমাল ধরার আগ পর্যন্ত কিছু টের পায় নি। এছাড়া যখন এসব হচ্ছিল তখন গুলাব খাঁয়ের লোকজন চেঁচিয়ে গান ধরেছিল, যাতে সিপাইরা টের না পায়। আমরাও মাঝেমধ্যে ফাঁক পেলে গাইছিলাম বৈ কি। এছাড়া দুটো ঘোড়া ইচ্ছে করে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সেপাইদের তাঁবুর আশেপাশে কয়েকজন চেঁচামেচি করতে করতে তাদের পিছু ছোটাছুটি করছিল। এই তালেগোলে সেপাইরা কিছু টেরই পায় নি। সেপাইদের কথায় মনে হল, একবার ফিরিঙ্গিয়ার দলের সাথে চার সেপাই আর এক ইংরেজি সাহেবের ঝিরণি দিয়েছিলাম। শুনবেন না কি সে ঘটনা? “
( বিঃদ্রঃ উল্লেখিত জবানবন্দিতে কোন কল্পিত অংশ নেই। পুরোটাই আদালতে ঠগীদের বিচার চলার সময় এক ঠগীর নিজ মুখে দেয়া জবানবন্দি।)
ফিরিঙ্গিয়া ছিল সমগ্র ভারতের সবচেয়ে দুধর্ষ আর হিংস্র ঠগী। হাজার হাজার খুন করা ঠগীদের মাঝেও সে ছিল কিংবদন্তী। তাকে ইংরেজরা কখনোই ধরতে পারে নি। তাই শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা ফিরিঙ্গিয়ার মা ও স্ত্রীকে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালায়। এখবর পেয়ে ফিরিঙ্গিয়া স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে।

লেখকঃ মাহিম জুবায়ের
শিক্ষার্থী, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Loading

Leave a Comment