ফরাসী বিপ্লবের গল্প

· ফরাসি বিপ্লবের জন্ম কোথায়?
· মানুষের অধিকারগুলো কী কী?
· অধিকারগুলোর উৎস কোথায়?
· সবার জন্য সিদ্ধান্ত কে নেয় এবং কিসের ভিত্তিতে?
· মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য সমাজব্যবস্থা কেমন হবে?

এ প্রশ্নগুলো একটা পুরো জাতির বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের উত্থান পর্বে। অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাপ্তিতে গোটা ইউরোপ একটা বিরাট সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জোয়ারে ভেসে যায় (Enlightenment)। বিভিন্ন প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির চেয়ে যুক্তি এবং মানুষের অধিকারকে অধিক প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা প্রকাশ পায় তখন। সেই সাথে মধ্যবিত্তের উত্থান আর ছাপাখানার উল্লেখযোগ্য বিস্তার আর উন্নতিতে মানুষের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতার একটা বোধ জাগতে শুরু করে। অন্যদিকে আমেরিকা তখন আর ব্রিটিশদের উপনিবেশ নয় , স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স তখনও পুরোনো ঘুণে ধরা এক শাসন ব্যবস্থা, তিনটি সামাজিক শ্রেণী দ্বারা পরিচালিত(Estates)। প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায় ছিল খ্রিষ্টান ধর্মযাজক এবং অভিজাত (Of Noble Birth) পরিবার। আর তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী শ্রমিকসহ, নিম্নবিত্ত শ্রমিকদের। শতকরা প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ ছিল প্রায় ক্ষমতাহীন। এবং সেই ক্ষমতাহীন সম্প্রদায়ই ছিল একমাত্র সম্প্রদায়, যাদের কাছে আদায় করা হত কর (Tax)। শুধু রাজার কাছে নয় , অভিজাত(!) জমিদারদের জন্য আলাদা করের অংশ থাকতো। কোনো কোনো বছর যখন মন্দার ঝড় বয়ে যেত দেশ জুড়ে, করের চাপে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের যেখানে না খেয়ে মরার অবস্থা, তখন অভিজাতেরা বেঢপভাবে ফুলে ফেপে ওঠা সম্পদের উপরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তখন রাজা ষোলতম লুই ( Sixteenth Of His Name) রাজত্বে। ব্রিটিশদের সাথে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ আর আমেরিকার বিপ্লবে সহযোগিতাসহ অন্যান্য কারণে অর্থনৈতিক মন্দার একটা তীব্র ছায়া তাড়া করে বেড়াচ্ছিল ফ্রান্সকে। পরিবর্তন হয়ে উঠেছিল জরুরি। এ ব্যাপারে রাজা পরিকল্পনা করলেন, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও সচিব হিসেবে নিয়ে এলেন জেকস নেকারকে (Jeques Necker)। তিনি করধার্য সম্বলিত বিষয়াবলী পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্গঠন করলেন। তিনি সরকারি অর্থনৈতিক নকশার অনেকটা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরলেন। লোকে তাকে বেশ পছন্দ করল বলে মনে হল। কিন্তু রাজার উপদেষ্টারা নড়েচড়ে বসল। তাদের ক্ষতি হচ্ছে না তো আবার? তারা জেঁকে বসল রাজার উপর, কানে কানে বলল তিনি বোকামী করছেন, ডেকে আনছেন বিপদ। নানা চিন্তাভাবনার পর রাজা নিলেন এক অভিনব পদক্ষেপ, তিনটি সম্প্রদায়কে ডেকে নিয়ে এলেন এক টেবিলে,দেশ শাসনের নামে(!) (Estates General), সেটি ছিল ১৭৫ বছরের মাঝে প্রথম এমন ঘটনা। যদিও তৃতীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি, প্রায় ৯৮ শতাংশ, কিন্তু ভোটের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য ছিল না কারন সেখানে সব লোকের আলাদা আলাদা ভোট নয়, প্রতিনিধিত্বমূলক ভোট গণনা করা হত। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মুখে স্পষ্ট চুনকালি মেখে দেয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অভিজাত শ্রেণী নিজেদের সুযোগসুবিধা ঊর্ধ্বে রেখে কথা বলে চলল। ‘ক্ষমতাহীনদের’ বুঝতে আর বাকি ছিল না যে তাদের প্রাপ্য তারা পাবে না, অন্তত এভাবে না। তাই মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তরা দ্রুত দূরে সরে গেল আর নিজেদের “ন্যাশনাল এসেম্বলি”( Assemblee Nationale) ঘোষণা করল। বলাই বাহুল্য, এটি কোনো সামাজিক শ্রেণির বহিঃপ্রকাশ ছিল না বরং ছিল সর্বস্তরের মানুষের বিস্ফোরণ। তাদের লক্ষ্য ছিল নতুন শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা ( La constitution ), পরিবর্তনের মাধ্যমে অথবা গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে। চিন্তিত লুই অন্যদিকে নেকারের চাকরি নট করে দিয়েছে আর চাইছে ন্যাশনাল এসেম্বলির সাথে সমঝতায় আসতে। তার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না বরং প্যারিসের উত্তাল জনগন ও সহানুভূতিশীল সৈনিকদের সাথে মিলে “Bastille Prison” এ হামলা চালায়, যা ছিল রাজকীয় ক্ষমতার আর অস্ত্রশস্ত্র এর বিরাট গুদাম ঘর। বিপ্লব তখন পথে নেমে গেছে, ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশ জুড়ে। বিপ্লবের মারের চোটে কোমর ভাঙ্গা জমিদারিপ্রথা মৃত্যুপ্রহর গুনছে। এসেম্বলির ঘোষণায় নাগরিকদের অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু, শাসকের অবস্থানের অর্থ কেবল অধিকার রক্ষা। এমন তাড়া খেয়ে অভিজাতেরা দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করল আর প্রতিবেশী রাজতন্ত্রীদের উৎসাহ দিতে লাগল এই বিপ্লবের লাগান টানতে। অন্যদিকে রাজা লুই নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে রয়েছে ফ্রান্সে। ভবিষ্যতের সে তার পরিবারসহিত দেশত্যাগের চেস্টা করে ধরা পড়ে এবং রাজা নিজেই রাজদ্রোহের আসামি হিসেবে চিহ্নিত হয়। রাজপরিবারকে বন্দি করা হয়। পরবর্তীতে রাজার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। এর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে হাজার বছরের রাজতন্ত্রের, ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষণা হয় প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্রের, যার মূলনীতি ছিল স্বাধীনতা , সাম্য আর ভ্রাতৃত্ব (Liberté, égalité, fraternité)। এতেই সকল নেতৃত্ব সন্তুষ্ট ছিল না, তারা আরো পরিবর্তন চাইছিল। অন্যান্য দলের মাঝে চরমপন্থি “জেকবিনস” এক ত্রাসের সঞ্চার করে ( Reigh of Terror)। তারা কারণে-অকারণে-সামান্য কারণে অসংখ্য লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। প্রতি বিপ্লবের একটু হাওয়া পেলেই তারা হত্যার জন্য উদ্যত হয়। অবশেষে জনগণের অসন্তুষ্টিতে জেকবিনসদের নিজেদের পতন ঘটে দ্রুতই। এর মাঝেই ২০ হাজারের বেশি লোক প্রান হারায়। এদিকে প্রতিবেশী রাজতন্ত্রীরা বিপ্লব দমাতে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এতসব বিশৃঙ্খলার মাঝে ক্ষমতা দখল করেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তার একনায়কতন্ত্রকে তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে প্রকাশ করার দাবি করেন। তার দাবি কতটুকু সত্য? আর ফ্রান্সে কি অবশেষে এক নায়কের যুগে আবার ফিরে গেল কিনা? সে নিয়ে বিস্তর কিছু বলার আছে। সেসব আপাতত নেপলিয়নের ঝুলিতে জমা থাক। যে মৌলিক প্রশ্নগুলো ফরাসি বিপ্লবের জ্বালানি জুগিয়েছিল, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আজও আমরা দিশা হারাই। দুশ বছরেও আমরা মাথা উঁচু করতে পেরেছি কিনা সেটা ভাবার বিষয়।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়

Loading

Leave a Comment