ছাপাখানার ইতিহাস

“A printing press is a device for applying pressure to an inked surface resting upon a print medium (such as paper or cloth), thereby transferring the ink. Typically used for texts, the invention and spread of the printing press was one of the most influential events in the second millennium.”

উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞানুসারে এই হলো ছাপাখানা!

ছাপাখানা কী তা আমরা সবাই জানি। আজকের আধুনিক যুগে যখন ইবুক-স্মার্টবুকের ছড়াছড়ি, তখন ছাপাখানার কথা আমরা সাধারণত মনে রাখিনা। এই ছাপাখানা আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এই গুরুত্বটা আজকের ছাপাখানার সহজলভ্যতার যুগে আমরা বুঝে ওঠার সুযোগ পাই কম।

প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারের কাহিনী ঘাঁটলে জানা যায় এটি আবিষ্কার করেন গুটেনবার্গ। গুটেনবার্গ পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। ১৪৪০ সালের দিকের রোমান সাম্রাজ্যে ছাপাখানার আবিষ্কার। গুটেনবার্গ তখনকার সহজলভ্য জিনিসগুলো দিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করেছিলেন যা টাইপ করতে সক্ষম,যা ছিল ছাপার যন্ত্রের প্রাথমিক রূপ। এই ছাপাখানাই কয়েক দশকের মাঝে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর দুইশটিরও বেশি শহরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। বলাই বাহুল্য,বর্তমানের আধুনিক ছাপাখানা যেই পরিমাণ কাজ করতে সক্ষম,এর চেয়ে অনেক অনেক গুণ কম ছাপার কাজ করতে পারত সেইসময়ের ছাপাখানা। শুরুর দিকে ১৫০০ টি ছাপাখানা মিলে উৎপাদন করতে পারতো ২০ মিলিয়ন কপি, পরে ষোড়শ শতাব্দীর দিকে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০-২০০ মিলিয়ন কপিতে।

গুটেনবার্গ দক্ষতার সঙ্গে ছাপার এই পদ্ধতিকে উন্নত করেছিলেন। এক্ষেত্রে ছাপার মূল দুটি কাজকে আলাদা করা হয়েছিল। একটি হলো টাইপসেটিং, অপরটি হলো প্রিন্টিং। ১৪৫৫ সালে তিনি টাইপ পিস হিসেবে সীসার তৈরি ধাতব ব্লক ব্যবহার করেছিলেন,যা আজও অনুসৃত হয়। মুভেবল টাইপ বা অক্ষরভিত্তিক টাইপ এর ধারণা চীনদেশে আবিষ্কৃত হয়েছিল song রাজবংশীয় সময়ে। এছাড়াও এটি প্রচলিত ছিল কোরিয়ায় Goryeo রাজবংশীয় সময়ে,যেখানে ১২৩৪ সাল থেকে ধাতব মুভেবল টাইপ গড়ে তোলার কাজ চলছিল। টাইপ করার এই রীতিটি গুটেনবার্গ পূর্ববর্তী ইউরোপেও প্রচলিত ছিল দ্বাদশ শতাব্দী বা ধারণা করা হয় এরও আগে থেকেই!

ছাপার জন্য সহায়ক আরেকটি কারণ হিসেবে রোমানীয় সময়ে যা উদ্ভুত হয় তা হলো পুঁথি। এটিকে বই পূর্ববর্তী ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে ধরা হয়। এই পুঁথি মধ্যবর্তী যুগের প্রাচীন তফসিল কে সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়। পুঁথি অনেক বেশি সুবিধাজনক ছিল কেননা এটি পড়তে সহজ,খরচ কম,গোঁটাতে হয়না এবং এর ডান-বাম উভয় পার্শ্বেই লেখা যায়।

আরেকটি সহায়ক উপায় হিসেবে ছিল মধ্যযুগের কাগজ উৎপাদন ও সরবরাহ। চীনা এবং মুসলিমদের হ্যান্ডমেড কাগজ তৈরিকে সরিয়ে ১২৮২ সালে সেই জায়গা দখল করে নেয় পানির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চলা পেপার মিল। পেপারমেকিং সেন্টারগুলো দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেইসাথে কাগজের দামও কমে আসে। আর এভাবেই ছাপার কাজও দ্রুতই চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে।

প্রেসের আবিষ্কারক গুটেনবার্গ কিন্তু সবসময়ই কাজ চালিয়ে গেছেন। গুটেনবার্গ ৪২ লাইনের একটি বাইবেল ছাপানোর কাজ করেন। যা পুরনো কাগজের পুঁথির সাথে তখনও ছিল অনেকটা সংগতিপূর্ণ। প্রচুর পরীক্ষণ শেষে,অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে গুটেনবার্গ পানি দিয়ে তৈরি কালির বদলে তেল দ্বারা প্রস্তুত কালি দিয়ে ধাতব টাইপের মাধ্যমে উচ্চমানের ছাপার কাজ সাফল্যের সাথে করেছিলেন। এটিকে ছাপার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়।

এটি বলার অপেক্ষা থাকেনা, ছাপাখানার আবিষ্কার ছিল সভ্যতার জন্য একটি বড় ব্যাপার। বিশেষত বই মুদ্রণের বিষয়টি। ছাপাখানার আবিষ্কার তৎকালীন সময়ে জ্ঞান ও মেধার চর্চা অনেক বাড়িয়ে দেয়। সেইসাথে সমাজে পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষেই যুগান্তকারী এক আবিষ্কার। যার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয় জার্মান জোহানেস গুটেনবার্গ কে!

ছাপার কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হত কাঠের প্রেস। আস্তে আস্তে সেই রীতি পাল্টাতে থাকে। যদিও পদ্ধতিটি ছিল সবসময়ই বেশ শ্রমসাধ্য! ছাপাখানায় একটা লোহার কল থাকতো,যাকে বলা হত প্রেস। এর পাশেই থাকতো কালি মাখার জন্য একটা টেবিল আর আরেকটা টেবিলে থাকতো কাগজ। লোহার তক্তায় অক্ষরগুলো বসানো থাকতো আর মোটা ‘রুল’ দিয়ে কালি নিয়ে অক্ষরে মাখানো হত। তারপর তক্তায় আঁটা ফ্রেমের উপর কাগজ মুড়িয়ে সেই অক্ষরের উপর ফেলে দিয়ে হাতল ঘুরিয়ে একবার প্রেসের ভেতর ঢুকিয়ে আরেকটা হাতল টানা হত । তারপর আবার সেই হাতল ছেড়ে তক্তা বের করা হত। এভাবেই আবার কাগজ খোলা হত,আবার কালি মাখা হত। এভাবেই ছাপার কাজ চলতো,যা বেশ অবাক হয়ে দেখার মত একটা ব্যাপারই ছিল বলা যায়!

এরপর আসা যাক আরেকটু সামনের দিকে। ১৭৯৬ সাল। জার্মান অভিনেতা এবং লেখক অ্যালোয়িস সেনেফেল্ডার কম খরচে ছাপার আরেকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন,যার নাম হলো ‘লিথোগ্রাফি’। লিথোগ্রাফি হলো লিথোগ্রাফিক পাথরের উপর বিশেষ ধরণের রঙ,তেল, মোম বা তৈলাক্ত জিনিস মাখিয়ে টাইপ এর কাজ করার পদ্ধতি। লিথোগ্রাফি চুনা পাথরের উপরই সবচেয়ে ভালোমত করা যায়। এরপর সময় ছিল কেবলই সামনে যাওয়ার! এই লিথোগ্রাফির মাধ্যমেই এসেছে আধুনিক ছাপাখানা। ইউরোপীয়দের হাত ধরেই আধুনিক ছাপাখানার উদ্ভব। ইংরেজি ভাষায় প্রথম গ্রন্থ মুদ্রন করেন উইলিয়াম ক্যাক্সটন। আর যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রণযন্ত্রের কাজ শুরু হয় ১৬৩৮ সাল থেকে।

বর্তমানে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ছাপার কাজ করা হয়, পেপার ছাপানোর ছাপাখানা গুলো সবচেয়ে মজার। প্রতিদিন লাখ লাখ কপি ছাপার কাজ হয় একটি ছাপাখানাতেই! ছাপাখানা­র কথা বললেই মনে পড়ে যায় সুকুমার রায়ের কথা। তাই তাঁর লেখা ‘ছাপাখানার কথা’ থেকে কিছু লাইন তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছিনা!

“ছাপাখানা কী ভয়ানক ব্যাপার হতে পারে তা যদি তুমি দেখতে চাও তবে খুব বড় কাগজওয়ালাদের কাছে গিয়ে দেখ। সেখানে প্রেসের ঘরে ঢুকতেই মনে হবে যেন কানে তালা লেগে গেল। প্রেসের ভনভন শব্দে নিজের চেঁচানি নিজেই শুনতে পাবে না। কল এত তাড়াতাড়ি চলে যে,কখন কি করে ছাপা হচ্ছে কিছু বুঝবার জো নেই। এমন প্রেসও আছে, যাতে বারো পৃষ্ঠা খবরের কাগজ প্রতি ঘন্টায় এক লাখ করে ছাপা হয়। যদি প্রেসটার ভিতর ভাল করে তাকিয়ে দেখ, দেখবে একদিকে একটা লোহার ডান্ডার প্রায় ৪/৫ হাত চওড়া কাগজের ফিতে জড়ান-ফিতাটা লম্বায় হয়ত ২/৩ মাইল হবে। প্রেসের মধ্যে পরপর কতগুলো প্রকান্ড লোহার চোঙা ভয়ানক জোরে বনবন্ করে ঘুরছে-আর সেই সঙ্গে হুড়হুড় করে কাগজের ‘ফিতে’ টেনে নিয়ে,তার উপর ছেপে যাচ্ছে। মাইলকে মাইল কাগজ চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিলাতের একটা বড় খবরের কাগজ (Daily Mail) ছাপতে প্রতি সপ্তাহে ৩০০ মণ কালি আর দশ হাজার মাইল কাগজ খরচ হয়।”

বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি ডিজিটাল আর অফসেট প্রিন্টিং এর ছড়াছড়ি। ১৮৭৫ সালে অফসেট প্রিন্টিং এর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন রবার্ট বার্কলে। এটি তিনি করেন টিন ব্যবহার করে। বর্তমানে সিটিপি বা ‘কম্পিউটার টু প্লেট’ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রিন্টার নামের যন্ত্রটা তো ঘরের ভেতরেই আমাদের সামনে হাজির করতে পারে ঝকঝকে ছবিও! প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে কত বই,ম্যাগাজিন,পত্রিকা­ সহ আরো কত কী! লেজার প্রিন্টার,প্লটার দিয়ে কত কী যে করা যায়, তার সাক্ষী আমরা সবাই-ই। এগুলো দেখলে কি ভাবা যায়, একসময় কত কষ্ট করেই না ছাপতে হতো একেকটা পৃষ্ঠা!

লেখক: শিক্ষার্থী, হলিক্রস কলেজ।

Loading

1 thought on “ছাপাখানার ইতিহাস”

  1. ছাপাখানা কী ভয়ানক ব্যাপার হতে পারে তা যদি তুমি দেখতে চাও তবে খুব বড় কাগজওয়ালাদের কাছে গিয়ে দেখ। সেখানে প্রেসের ঘরে ঢুকতেই মনে হবে যেন কানে তালা লেগে গেল। প্রেসের ভনভন শব্দে নিজের চেঁচানি নিজেই শুনতে পাবে না।

    Reply

Leave a Comment