হাতুড়-কাস্তে-মনিব ও একটি দিবসের গল্প

“চিমনির মুখে শোনো সাইরেন শঙ্খ গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য জীবনকে চায় ভালোবাসতে।” -সুভাষ মুখোপাধ্যায় (মে দিনের কবিতা) 
মে মাসের এক তারিখ। দিনপঞ্জিকায় যা থাকে লাল কালিতে লেখা। কীসের ছুটি? যখন সবেমাত্র ক্যালেন্ডার দেখতে শিখেছি তখন প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতো। পহেলা মে হলো ‘মে দিবস’। তবে, এপ্রিল দিবস বা জুন দিবস নেই কেন? প্রশ্নের উত্তরে জানলাম দিনটা নাকি আসলে শ্রমিক দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এর পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। যে ইতিহাস শ্রমজীবীদের,তাঁদের আত্মত্যাগের, অধিকার আদায়ের। যে ইতিহাস শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ইতিহাস, শ্রমজীবীদের জীবন দেয়ার ইতিহাস। তাই তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য এই দিনটি পালন করা হয়। বছরের এ দিনটি তাই শ্রমজীবীদের জন্য, তাঁদের কথা বলার জন্য। এই দিনটি তাঁদের অবদানকে-আত্মত্যাগকে স্মরণ করার দিন। মে দিবস-প্রাচীন উৎসব : মে দিবস, যা কিনা ইউরোপ ও এর আশেপাশের দেশগুলোতে পালিত হয়ে থাকে,তার গল্পটি বেশ পুরনো। যীশুখ্রিষ্টের জন্মের আগে থেকেই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। তখন সেই অঞ্চলের মানুষ বছর গণনা শুরু করতো পহেলা নভেম্বর থেকে। আর তাই অর্ধবছর অর্থাৎ, এক বছরের অর্ধেক সময় পার হতো ঠিক এই পহেলা মে তে এসে। তাই এই দিনটি পালন শুরু করে বৃটিশ ও আইরিশ জাতি। আর রোমানরা বৃটিশদের রাজ্য দখল করার পর তারা পয়লা মে কে পরিণত করে তাদের ফুলের দেবী ফ্লোরার পূজোর উৎসবে। এরপর খ্রিষ্টধর্মের আবির্ভাব ঘটলে মানুষ সেই ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। আবার বছর গণনাও শুরু হয় পহেলা জানুয়ারি থেকে। তখন রোমানদের এই উৎসবটি হারিয়ে না গিয়ে বরং মর্মার্থ পালটে ফেলে। বর্তমানে দিবসটি মে দিবস হিসেবে পরিচিত, যা ইংল্যান্ডে ঘটা করে পালিত হয়। ইংল্যান্ড ছাড়াও আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, সুইডেন সহ নানান দেশে এটি পালন করা হয়। এখন ইউরোপীয় দেশগুলোতে মে দিবস পালিত হয় “ঐতিহ্যবাহী বসন্তকালীন ছুটি” হিসেবে। এই দিনটির অর্থ আরো একবার পাল্টে গেলো ১৮৮৬ সালের পর। বর্তমানে এটি সারা বিশ্বের জন্য একটি লাল কালিতে লেখা দিন। যা আজও সাক্ষ্য দেয় শ্রমজীবীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সেই আন্দোলনের, সাক্ষ্য দেয় সেই ইতিহাসের। শিকাগো হে মার্কেট অ্যাফেয়ার: আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের প্রেক্ষাপট তৈরী হয় ১৮৮৬ সালে। যা কিনা পরিচিত শিকাগো হে মার্কেট অ্যাফেয়ার হিসেবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষের কাজ করার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। মানুষ কলকারখানার যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন ব্যবস্থায় নিয়োজিত হতে থাকে,এই ব্যবস্থায় উৎপাদনও আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পায়। সৃষ্টি হয় বিশাল শ্রমিকশ্রেণির, উদ্ভব ঘটে মালিকশ্রেণির। যত বেশি উৎপাদন, ততই মুনাফা,তাই মালিকদের আগ্রহও শ্রমিকদের ঘন্টার পর ঘন্টা খাটাবার দিকেই গেছিলো। শেষমেশ অবস্থা দাঁড়ায় এমন যে, আরো বেশি লাভের আশায় মালিকেরা একই মজুরির (যা ছিল নামমাত্র) বিনিময়ে শ্রমিকদের কারখানায় অনেক বেশি সময় ধরে কাজ করাতে লাগলো। এমনকি দিনে আঠারো থেকে বিশ ঘন্টাও একটানা কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। এজন্যই শ্রমিকদের জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে খুবই করুণ, ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়েও পড়তো। এই যখন অবস্থা, তখন শ্রমিকরা এই শোষণ, এই নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে নিজেদের দাবি পেশ করে। দাবী আদায়ের জন্য বাধ্য হয়ে শুরু করতে হয় প্রতিবাদ। ১৮৮৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এই দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত। ‍‍‍দাবী একটাই- একজন মজুরের কর্মঘন্টা ৮ ঘন্টার বেশি হওয়া চলবেনা। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই অর্থলিপ্সু কারখানা মালিকগণ এ দাবী মেনে নিল না। উপস্থিত হলো ১৮৮৬ সালের ১ মে। শুরু হলো ধর্মঘট। তাই ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় মিছিলের উদ্দেশ্যে শ্রমিকগণ জড়ো হন। মালিকদের সিদ্ধান্তে পুলিশকেও পয়লা মে থেকে শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে শ্রমিকদের হেনস্থা করতে পাঠানো হয়। সেদিন, আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। ঠিক সেই সময়ে কোন এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া বোমায় এক পুলিশ নিহত হয়। এই ঘটনা আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। স্পষ্টতই তা ছিল সাজানো। এই ছুঁতোয় পুলিশবাহিনী তৎক্ষনাৎ শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। ৪ মে চারজন নিহত হন,আহত হন অনেকে। ৫ মে পুনরায় ধর্মঘটকারীদের উপর গুলি চালালে সেদিন ৭ জন নিহত হয়। 

৪ মে’র ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় ১৬ জন শ্রমিককে, যাদের বিচার শুরু হয় ১৮৮৭ সালের ২১ জুন। পুলিশ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে। প্রহসনমূলক সেই মামলার রায় দেয়া হয় ৯ অক্টোবর। এতে ৬ জনকে ফাঁসি ৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়। লুইস লিং নামে একজন ফাঁসির একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। আর আগস্ট স্পীজ ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”। এরপরের কাহিনী কেবল জ্বলে ওঠার। শিকাগোর শ্রমিকরা কঠোর আন্দোলন জারি রাখেন। তাদের সাথে একাত্ম হয়ে বিশ্বের সকল দেশের শ্রমিকরা প্রতিবাদ শুরু করে। আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। এতেই টনক নড়ে মালিকশ্রেণির। এই ক্রমবর্ধমান আন্দোলনই মালিকপক্ষকে বাধ্য করে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের দাবি। দৈনিক সর্বোচ্চ আট ঘন্টা কাজের বিধান রেখে আইন পাশ হয়। পরে ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা করেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয়? না, তা কখনোই প্রকাশ পায়নি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস-আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা: ১৮৮২ সালে নিউইয়র্কের কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবারকে শ্রমিক দিবস করার প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাব করেন এর তৎকালীন সচিব। আমেরিকায় এখন এটিই পালিত হয়। ১ মে কে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রথম প্রস্তাব দেয়া হয় ১৮৮৯ সালে প্যারিসে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সংঘের (সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল) প্রথম সম্মেলনে। এটি করা হয় ৪ মে ১৮৮৬- এর স্মৃতি ও শ্রমিকদের আত্মত্যাগের উদ্দেশে। প্রস্তাবটি রাখেন রেমন্ড লাভিনে। আর তারপর ১৮৯১ সালে, এর দ্বিতীয় সম্মেলনে এই প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। তবে এর কয়েক বছর পরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। তাই ১৯০৪ সালে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের প্রতি আহবান জানানো হয়। আমস্টারডামের এই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে’র ১ তারিখে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার” সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অনেক দেশে মে মাসের ১ তারিখ সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণার প্রস্তাব শ্রমজীবীদের দাবীর মুখে কার্যকরী হয়। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। সেসব দেশে এই দিনটিতে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজনও করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতেও এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯২৩ সালে ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম মে দিবস পালিত হয়। তবে আমেরিকা ও কানাডাতে শ্রম দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বর-এ। হে মার্কেটের সেই হত্যাকান্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড আশঙ্কা করেন পয়লা মে তারিখে যুক্তরাষ্ট্রে যে কোন ধরণের আয়োজন করা হলে সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। তাই জন্য তিনি ১৮৮৭ সালেই সেপ্টেম্বর মাসে মে দিবস পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই হলো আজকের মে দিবসের গল্প। যা কিনা শ্রমিকদের রক্ত দিয়ে লেখা। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জয়ী হোক মানুষ,পৃথিবী যাদের কর্মের ওপর ভর দিয়ে আজ এতদূর এসেছে তাদের কথা যেন ইট পাথরের দালান বা দামী পণ্যসামগ্রীর স্তূপে ঢাকা পড়ে না যায়- আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আমাদের এটিই মনে করিয়ে দেয়। দিবসমুখী কেন্দ্রিকতা বাদ দিয়ে আমাদের শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে সচেষ্ট হতে হবে। কাজের ন্যায্য মূল্য,আয়বৈষম্য রোধ,শ্রম নিরাপত্তা,মালিকশ্রেণির দুর্নীতি হ্রাস এবং যথাযথ ও কার্যকর শ্রম নীতিমালা প্রয়োগ -এই কথাগুলো মনে করিয়ে দিতে যেন আর কোনো রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিকে আমাদের চোখের সামনে আসতে না হয়। যাঁদের শ্রমের বিনিময়ে আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে,তাদের ভুলে যাওয়া এক চরম অপরাধ। অধিকার আদায়ে সোচ্চার হোক শ্রমিকশ্রেণি,তাদের ন্যায্য সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে অগ্রসর হোক সমাজ ও রাষ্ট্রের সকলেই। বরাবরই সব শেষে স্বপ্ন থেকে যায় একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজের। ভালো থাকুক শ্রমজীবী মানুষেরা!

লেখকঃ শিক্ষার্থী, এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় 

Loading

Leave a Comment