ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক, ধানমন্ডি, ঢাকা।

ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক। ধানমন্ডি ৩ নাম্বার সড়কের মাথায় শ্বেত পাথরের লেখা এই সড়কের নাম। প্রায় প্রতিদিন ভোর আর সন্ধ্যায় এই রাস্তা দিয়ে আমার নিয়মিত যাতায়াত। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার অন্যান্য সড়কের মতো এই সড়কের মধ্যেও একটা স্নিগ্ধ ভাব আমি খুঁজে পাই। নীরব আর নিভৃত একটা সোজা রাস্তা। ঠিক যাঁর নামে এর নামকরণ তাঁর মতোন। মোহাম্মদ সুলতানকে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই চিনি না। এই নিভৃতচারী অথচ শক্তিশালী মনন আর মেধার এই মানুষটিকে এই প্রজন্মের যারা প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে যুক্ত তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে কিছুটা অনুসন্ধান আর কিছুটা ইন্টারনেট ঘেটে পড়াশোনা করে আমার এই লেখা। তবে আমি মনে করি ব্যক্তি মোহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে আরো অনেক পড়াশোনার প্রয়োজন আছে। এই লেখাটা শুধু মাত্র তাঁর লড়াই আর সংগ্রামী জীবনের একটা সারসংক্ষেপ মাত্র।

 

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম মস্তিষ্ক ছিলেন তিনি। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সেখান থেকে মাঝ রাতে যে এগারোজন ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি তাঁদের একজন। তেপান্ন সালের মার্চে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারির’ প্রকাশক তিনি। বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ত্ব তিনি। নিজের জীবনীশক্তির পুরোটাই ব্যয় করেছেন সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে।

তাঁর সহযোদ্ধা অনেকেই পেয়েছেন একুশে পদক সহ অসংখ্য স্বীকৃতি। বামপন্থী আন্দোলনের তাঁর অনেক সহযোদ্ধা বুর্জোয়া চরিত্র ধারণ করে এখন সরকারের এমপি-মন্ত্রী । তিনি তো এসবের কিছুই পাননি। তবে কী তিনি ব্যর্থ?

ব্যক্তিগত প্রাপ্তির চিন্তা তিনি কখনো করেননি। এই পরিমাপক দিয়ে মাপাও যাবে না তাঁর কর্মময় জীবনকে। তিনি মোহাম্মদ সুলতান। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির সদস্য ও একসময়ের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন তিনি। পুলিশের বড় অফিসারের ছেলে সুলতান প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই মাকে হারান। প্রবেশিকা পাশ করেন যশোর জিলা স্কুল থেকে। স্নাতক করেন রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে। তারপর ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে করেন স্নাতোকোত্তর।

পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন প্রগতিশীল সমাজের স্বপ্ন দেখে, সংসারের খবর রাখেননি, ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে উদ্বেগ ছিলো না কখনো। সুলতানের বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমানের পরিশ্রমে ১৯৫৩ সালে প্রকাশ ভাষা আন্দোলনের অনবদ্য সাহিত্য দলিলের। এই বইয়ের প্রকাশক ছিলেন সুলতান। বইটি প্রকাশের সাথে সাথে বাজেয়াপ্ত করে সরকার ও মোহাম্মদ সুলতানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এই সময়ে আত্মগোপনে চলে যেতে হয় মোহাম্মদ সুলতানকে। আইয়ূব খানের স্বৈরশাসনের পুরো দশকটিতে আত্মগোপনে থাকতে হয় তাঁকে। এ সময় বাংলাবাজারের নর্থব্রুক হল রোডে শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের বাড়িটি ছিলো তাঁর নিরাপদ আশ্রয়। ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা তৈরি করে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। বিনা বিচারে এক বছর জেলে থাকতে হয় সুলতানকে।

সুলতানের রাজনৈতিক জীবনের শুরু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে বামপন্থী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি যুগ্ম সম্পাদক হন তিনি। বায়ান্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলনকারী ১১ ছাত্রের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের। মোহাম্মদ সুলতান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন।  ১৯৫৬-তে তিনি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। তার পরের বছরেই ন্যাপ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।

১৯৫৮-তে সামরিক শাসন জারি হলে সুলতান গ্রেফতার হন। বিনা বিচারে চার বছর ঢাকা কারাগারে বন্দী হিসেবে রাখা হয় তাঁকে। সত্তর সাল থেকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে প্রগতিশীল প্রকাশনার কাজে যুক্ত হন তিনি।

মোহাম্মদ সুলতান প্রগতিশীল প্রকাশনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রকাশনার সাথে যুক্ত হন।  তিনি এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রয়কেন্দ্র পুঁথিপত্র প্রতিষ্ঠা করেন। প্রগতিশীল প্রকাশনার জন্য এক গঠনমূলক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সহ-সভাপতি ও বাংলা একাডেমী আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি।

১৯৮৩ সালের শেষ দিনটিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জীবনশক্তির পুরোটা সমাজতান্ত্রিক, প্রগতিশীল সংগ্রামে ব্যয় করে নিজের জন্য রেখে যেতে পারেননি তিনি কিছুই। জুরাইন কবরস্থানে তাঁর সাড়ে তিন হাত শেষ আশ্রয়ের টাকাটাও জোগাড় করতে হয়েছিলো তাঁরই এক ছাত্রের কাছ থেকে। নিজের জন্য কিছু রেখে যেতে না পারলেও এই ভূখন্ডে প্রগতির আন্দোলনের ব্যাটনটি অনেক শক্তিশালী করে রেখে গিয়েছিলেন উত্তরসূরীদের কাছে।

সূত্রঃ জাহীদ রেজা নূরের প্রবন্ধ    ও বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস – মুহাম্মদ হান্নান

 

Loading

1 thought on “ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক, ধানমন্ডি, ঢাকা।”

  1. আমার বাবা মোহাম্মদ সুলতানকে মনে করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

    Reply

Leave a Reply to Chandana Sultana Cancel reply