বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রোঃ সংগ্রামের নব্বই বছর

কিউবা। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম ও সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত দ্বীপ। দ্বীপটির আশেপাশের অনেকগুলি ছোট দ্বীপের সাথে মিলে দ্য কিউবা রিপাবলিক। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র যুদ্ধরূপে বিদ্যমান থাকা কিউবান বিপ্লবের কথা আসলেই যাঁর নাম আসে, তিনি হলেন ফিদেল কাস্ত্রো। পুরো নাম ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। ফিদেলের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার হলোগুইন রাজ্যের বিরেইন নামক গ্রামে। গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন কৃষক পরিবারের সন্তান ক্যাস্ত্রো ছিলেন কিউবান বিপ্লবের অন্যতম নেতা ও কিউবার রাষ্ট্র নায়ক।

কিউবান বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৫৯ সালের ১লা জানুয়ারী কিউবার একনায়কতন্ত্রী শাসক ফুলগেনসিও বাতিস্তার পরাজয় ঘটে এবং ফিদেল কাস্ত্রো নেতৃত্বে কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তিত হয়। কিউবার নবগঠিত কমিউনিস্ট সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বমুক্ত হয়ে ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে।

১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী কাস্ত্রো সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়। জানা যায় তাঁকে ৬৩৮ বার হত্যাচেষ্টাও হয়েছিল, কিন্তু তিনি প্রতিবারই রক্ষা পান। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কিউবার মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট। ২০০৮ এ তিনি রাউল কাস্ত্রোকে তাঁর দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত কিউবান কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে তিনি এর সূচনালগ্ন থেকেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় কাস্ত্রোর রাজনৈতিক জীবন শুরু। এরপর কিউবার রাজনীতিতে ফিদেল কাস্ত্রো একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাতিস্তা এবং কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সমালোচনা নিবন্ধ লিখে। ক্রমেই তিনি এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৫৩ সালে মনকাডা ব্যারাকে একটি ব্যর্থ আক্রমণ করে কারারুদ্ধ হন ও পরে ছাড়া পান।তখন তিনি বাতিস্তার সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়ার জন্য মেক্সিকো যান। ফিরে এসে ১৯৫৬’র ডিসেম্বরে সরকার উৎখাতে নামেন। তাঁর এই আন্দোলনে সঙ্গী ছিলেন আরেক মহান বিপ্লবী, আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।

১৯৭৬ সালে তিনি রাষ্ট্র ও মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি কিউবার সর্বোচ্চ সামরিক পদ Comandante en Jefe (“Commander in Chief”) -এ আসীন হন। একের পর এক নানান ষড়যন্ত্র হয় এই মহান বিপ্লবীর বিরুদ্ধে।কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা বেশির ভাগই হয় ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে। এ সময়ে পাঁচটি ভাগে সিআইএ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাঁকে হত্যার নানামুখী চেষ্টা চালায়।

তাঁকে কিউবার সিংহাসন থেকে নামাতে পরিকল্পনার নাম ছিল ‘অপারেশন মঙ্গুজ’। ফেবিয়ান এসকালান্তে ফিদেলের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। ৪৯ বছরের শাসনামলে পুরো সময় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর তথ্যমতে, ৬৩৮ বার কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করে সিআই,যার প্রতিটি ষড়যন্ত্র ছিল অভিনব। এসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে জটিল ছিল কাস্ত্রোর চুরুটের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা। নিউইয়র্কের এক পুলিশ কর্মকর্তা কাছ থেকে এই ফন্দি নেয় সিআইএ। সেইবার নাকি চুরুটের মধ্যে যে পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা হয়, তা তাঁর মাথা উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতো । এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন সময়ে তাঁর খাবারে বিষ রেখে, ব্যবহারের কলমে বিষযুক্ত সুচ রেখে ও পোশাকে জীবাণু ছড়িয়েও নানান চাল চালা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একের পর ষড়যন্ত্রের মুখে ১৯৮৮ সালে কাস্ত্রো বেশ মজা করেই বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রই আমাকে কিংবদন্তি করে তুলেছে।’

ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন দূরদর্শী এবং মহান এক নেতা, নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবী। সারাজীবন তিনি প্রতিবাদ করে গেছেন। দেখিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে মাথা তুলে বাঁচতে হয়। সবসময় তিনি কিউবাকে নিয়ে ছিলেন আশাবাদী, ১৯৫৩ সালে কারাবন্দী হয়েও তিনি দেখতেন বিপ্লবের স্বপ্ন।বলতেন, ইতিহাসই তাঁকে গ্লানিমুক্ত করবে।
কাস্ত্রোর মুখে সবসময়ই ছিল এই স্লোগান, ‘হয় সাম্যবাদ, নয় মৃত্যু’। কিউবার মূল স্লোগানও এমনই।হয় জন্মভূমি,নয় মৃত্যু! কাস্ত্রো ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, খুব দ্রুত সবকিছু শিখতে পারতেন। বেসবল খেলাতে ছিল তাঁর তুমুল উৎসাহ। কথিত আছে, ইউএস বিগ লিগে খেলার স্বপ্ন ছিল কাস্ত্রোর। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও এক ছবিতে দেখা যায় বেসবল খেলায় মগ্ন কাস্ত্রোকে।

কিউবার এই বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য সংগ্রামে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট বিরোধী সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্বে ও সাহসে তিনি হিমালয়।”

২০০৬ সালে এক অস্ত্রোপচারের পর থেকেই শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে গ্রাস করতে থাকে।আস্তে আস্তে জনসম্মুখে তাঁর উপস্থিতি কমতে থাকে। তাঁর নব্বই বছরের এই বৈচিত্রময় বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার রাতে (২৫ নভেম্বর ২০১৬) হাভানায়।

কাস্ত্রো ছিলেন মহান এক নেতা,সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তব করতে এক দৃঢ় চরিত্র। নিজ জন্মভূমিকে অন্যের কর্তৃত্বমুক্ত করে কাস্ত্রো দেখিয়েছেন যতবড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন, প্রতিবাদের সামনে কোনো কিছুই কিছু নয়।তিনি ছিলেন হাসিখুশি, মানুষের বন্ধু। তিনি বিপ্লবের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। বিপ্লবের এই চেতনা থেকেই ১৯৫৯ সালে তিনি বলেছিলেন-‘আমি ৮২ জনকে নিয়ে বিপ্লব শুরু করি। তা যদি আমাকে আবার করতে হয়, তবে আমি ১০ বা ১৫ জনকে নিয়ে করব এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে করব। সংখ্যায় আপনি কত কম, সেটা কোনো বিষয় নয়, যদি আপনার বিশ্বাস ও কর্মপরিকল্পনা থাকে।’

Loading

Leave a Comment