চিরঞ্জীব সঞ্জীব

দায়বদ্ধতা, শব্দটি কেবল নির্দিষ্ট কিছু পেশার মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু দায়বদ্ধতার দিক থেকে সৎ এমন মানুষের সংখ্যা হয়তো হাতে গোনা। একজন শিল্পীর সমাজের প্রতি দায় কেবল গান গাওয়া হতে পারে না। গানে প্রেরণার উপাদান রেখে যাওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রেরণা এবং উদ্দীপনা সবচেয়ে বেশী পাওয়া সম্ভবত গান থেকে। আশির দশকে দেশের উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনে যে শিল্পী তার গানে-কথায়-কবিতায় মানুষের আন্দোলনের প্রেরণা, হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন- তিনি সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীব চৌধুরী নামটি শুধুই একজন শিল্পীরই নয়, একজন যোদ্ধার, একজন পথিকৃতের।

সঞ্জীবের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৫ই ডিসেম্বর, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে। ঢাকা কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে । বাংলাদেশে ফিচার সাংবাদিকতার জনক বলা চলে তাকে। গান গাইতেন। ছাত্র জীবনে ব্যান্ডের নাম ছিলো ‘শঙ্খচিল’, পরে ছিয়ানব্বইয়ে করেন ‘দলছুট’। কবিতা লিখতেন, সুর করতেন। যতোটা না গায়ক তার চেয়ে বেশী পরিচিত ছিলেন গীতিকার হিসেবে। ছোট গল্প লিখেছেন, নাটকের স্ক্রিপ্ট করেছেন, অভিনয় করেছেন। আর হ্যাঁ সঞ্জীব জোর গলায় স্লোগান দিয়েছেন। সঞ্জীব তারকা ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি তার তারকা সত্ত্বাকে দূর আকাশে নিয়ে যাননি, হয়েছেন মুক্তিকামী মানুষের বুকের ভেতর জ্বলজ্বলে এক তারা। সত্তরের দশকের অসামান্য মেধাবী ছাত্র, ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী খান মুহাম্মদ ফারাবীর একটি কবিতা সঞ্জীব চৌধুরী প্রায়ই আবৃত্তি করতেন। “আমি তো তাদেরই জন্য, সূর্যের দিকে চেয়ে থাকবার অভ্যাসে যারা বন্য, আমি তো তোমারই জন্য, কপাল রাঙ্গানো যে মেয়ের টিপ রক্তের ছোপে ধন্য!” আটাত্তরে মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে সঞ্জীব ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ক্লাসের ফাঁকে ক্যান্টিনে তাকে পাওয়া যেতো কবিতার বই হাতে। গণিতে দারুন সঞ্জীবের পরিবার চাইতো, সে ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু সঞ্জীবের সিদ্ধান্ত ছিলো সমাজ প্রগতির লড়াই সংগ্রামে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে। সঞ্জীব চৌধুরী তার স্বপ্নবাজি গানে বলেন- আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া, সন্ধান করিয়া স্বপ্নের ঐ পাখি ধরতে চাই, আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।

সঞ্জীব ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সক্রিয় ছিলেন ছাত্র রাজনীতিতে। ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা কলেজ সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মার্ক্সবাদী সাহিত্যিক বিপ্লবী শহীদ সোমেন চন্দ, শহীদ কমরেড তাজুল ইসলাম ছিলেন সঞ্জীবের রাজনৈতিক আদর্শ। ১৯৭৮ থেকে ৯০ এর উত্তাল সময়ে সঞ্জীব পড়াশোনা, টিউশনির সাথে অবিরাম চালিয়ে গেছেন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। এ সময় প্রকাশিত হয় তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ রাশপ্রিন্ট। আর উত্তাল সময়ে মিছিল- সমাবেশ-কনসার্ট সব জায়গায় ছিলেন সরব। সেই কঠিন সময়ে কাজের ফাঁকে গান বাঁধেন তিনি, সে গানে কাঁপিয়ে তোলেন হাজারো সংগ্রামীর বুক। গান সঞ্জীবের নেশা ছিলো। তাঁর মূল পেশা ছিলো সাংবাদিকতা। শেষের দিকে তিনি সাংবাদিকতা নিয়ে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। জীবন দর্শনে সৎ, নির্ভীক, দলছুট সঞ্জীব চৌধুরীর গানের কথায় কোনো ভান লুকোনো থাকতো না। এটাই তার সার্বজনীন জনপ্রিয়তার রহস্য। তাঁর গান বলতো গণমানুষের কথা। তাঁর গানের কথা যেনো এক সাধারণ প্রেমিকের বুকে কান পেতে শোনা হাহাকার, মধ্য বয়সী যুবকের হতাশা-স্বপ্ন। তার গানে আছে , ডানা ভাঙ্গা শালিকের হৃদয়ের দাবী। আশির দশকে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সঞ্জীব নিয়মিত কন্ঠ তুলেছেন। তাঁর গানে এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে শহীদ কমরেড তাজুল ইসলামের মৃত্যুর কথা উঠে এসেছে। নব্বই এর আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে রূপ দিতে সঞ্জীবের গান টনিক হিসেবে কাজ করেছে। দমন- নিপীড়নের সময় তিনি বলেন- “আমাকে চুপ থাকতে হয়, আমাকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়।” তবু গানের শেষে তিনি সেই স্বপ্নের পাখিকে খুঁজতে চেয়েছেন। আজ আমরা কতোজন প্রতিকূলে নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে জানি? স্বপ্নবাজি করে বেড়ানো এই মানুষটির কর্ম আজও আমাদের ডাক দিয়ে যায় স্বপ্নকে ছোঁয়ার, দেয় ভাবনার খোরাক।

আরো অনেক প্রতিভাবান, সৃজনশীল মানুষের মতো সঞ্জীব চৌধুরী বেঁচে ছিলেন খুব অল্প কয়দিন। স্বল্প জীবনে তাঁর ব্যান্ড দলছুটের সাথে প্রকাশিত এলবাম সংখ্যা চারটি। আহ, হৃদয়পুর, আকাশচুরি, জোছনাবিহার। সঞ্জীবের একক এলবামের নাম স্বপ্নবাজি। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় কিছু গান- আমি তোমাকেই বলে দেবো, আমি ফিরে পেতে চাই, সাদা ময়লা রঙিলা, স্বপ্নবাজি, গাড়ি চলে না, বায়োস্কোপ, আমার বয়স হলো সাতাশ, সমুদ্র ইত্যাদি। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর ক্ষণজন্মা এই শিল্পী মাত্র ৪৪ বছর বয়সে বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই সাথে সমাপ্তি ঘটে একজন অভিযাত্রীর।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

1 thought on “চিরঞ্জীব সঞ্জীব”

Leave a Comment