২৫শে বৈশাখের গল্প!

আপনি রবীন্দ্রনাথ কে তো চেনেন? সেই রবীন্দ্রনাথ , জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী সেই শিল্পী রবীন্দ্রনাথ যার খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
আজ ২৫শে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। ১৮৬১ সালের এই দিনে জন্ম হয়েছিল এই মহাপুরুষের। তিনি জন্মগ্রহন করেন জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত জমিদার পরিবারে। জমিদার পরিবারের আদুরে ছেলে রবীন্দ্রনাথের দারুণ অনীহা ছিল স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে কোনোভাবেই তাঁর আগ্রহ জন্মেনি এ বিষয়ে। তিনি সফলতার সাথে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে। এতে তাঁর প্রতিভা নামক জাদুর কাঠির বিন্দুমাত্র ক্ষতি সাধিত হয়নি। খুব অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথের মাঝে প্রকাশ পায় তাঁর কাব্য প্রতিভা। সবাইকে চমকে দিয়ে কিশোর বয়সেই পুরোদমে কাব্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন তিনি। তাঁর কিশোর বয়সে রচিত “বনফুল” কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রতিভার অভিনবতার স্বাক্ষর আমরা পাই।
ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। প্রকৃতি তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভাবাতো । লোকে যা দেখেও না দেখার ভান করত বা দেখতে পেত না, রবীন্দ্রনাথ তাই দেখতেন। তাই তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় প্রকৃতির রুপবান মূর্তির ছাপ দেখা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন কিন্তু নিষ্ক্রিয় ছিলেন না কোনো ক্ষেত্রেই। সাহিত্য,রাজনীতি,দর্শনসহ নানা ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল অভাবনীয়। তাঁর আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল , তিনি একজন সুবক্তা ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ছিল সকল প্রশংসার অধিকারী, সে বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকবার কথা নয়। কিন্তু যে কারণে রবীন্দ্রনাথ অভিনব, সে কারণটি হচ্ছে তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা। একজন মানুষের পক্ষে এত অসংখ্য বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করা সম্ভব, তা বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ কে না দেখলে অনেকেই বিশ্বাস করতে দ্বিধা করতেন। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভায় ভর করে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বজুড়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ত্ব।
রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সাহিত্যিক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিক অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথকে এক “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” ও “গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিক” হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কবিতা, ছোটগল্প,উপন্যাস,নাটক ইত্যাদি সকল শাখায়ই তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ দেখা যায়। এসব শাখায় তাঁর অবদান স্পষ্ট বোঝা যায় রবীন্দ্র পরবর্তী বিভিন্ন সাহিত্যিকদের লেখায় বিশেষ নজর ফেললে। তাদের লেখায় স্পষ্টতই ধরা পরে রবীন্দ্রনাথের ছাপ। বিশেষ করে বলা যায় তাঁর ছোটগল্পের কথা। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পে বিপ্লব আসে এই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। ছোটগল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনোভাব প্রকাশ করেছেন এভাবে,
“ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা. নিতান্তই সহজ সরল,. সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি. তারি দু’চারিটি অশ্রুজল । নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘন ঘটা. নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ । অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে. শেষ হয়ে হইল না শেষ ।”
খুব অল্প কথায় পরিপূর্ণ বক্তব্য যাকে বলে।
রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে যেকোনো লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে তাঁর গানের প্রসঙ্গ না তুললে। রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম গানটি হল ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’।রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল এই গান রচনা ও প্রকাশের ইতিহাস সম্পর্কে লিখেছেন:
“ …ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের পাক্ষিক মুখপত্র ধর্মতত্ত্ব পত্রিকার ১ ভাদ্র ১৭৯৪ শক [১২৭৯; 1872] সংখ্যার [৪ । ১৪] ৭৩৮ পৃষ্ঠায় নানকের ভজনটি প্রথম বঙ্গাক্ষরে প্রকাশিত হয়। এর পরই তত্ত্ববোধিনী-র ফাল্গুন সংখ্যার ১৯১-৯২ পৃষ্ঠায় ‘সংবাদ’ শিরোনানায় ২৪ ভাদ্র লাহোর সৎসভার দ্বিতীয় সাংবাৎসরিক প্রসঙ্গে গদ্যানুবাদ-সহ গানটি মুদ্রিত হয়। পদ্যানুবাদটি সুর-সংযোজিত [‘রাগিণী জয় জয়ন্তী – তাল ঝাঁপতাল] হয়ে ১১ মাঘ ১২৮১ [শনি 23 Jan 1875] তারিখে আদি ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চচত্বারিংশ সাংবাৎসরিক সায়ংকালীন উপাসনায় গীত হয় ও পরবর্তী ফাল্গুন সংখ্যায় তত্ত্ববোধিনী-র ২০৯ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়। …আমাদের অনুমান পদ্যানুবাদটি রবীন্দ্রনাথেরই কৃত। ফাল্গুন সংখ্যায় অনুবাদ-সহ মূল অংশটি প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে বোলপুর হয়ে অমৃতসরে আসেন। খুবই সম্ভব যে, তিনি তত্ত্ববোধিনী মারফত রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। অমৃতসরে পিতার সঙ্গে যখন গুরু-দরবারে উপস্থিত থাকতেন, তখন অন্যান্য শিখ ভজনের সঙ্গে এই গানটিও তিনি শুনেছিলেন, এমন সম্ভাবনার কথা সহজেই ভাবা যেতে পারে। আর এই যোগাযোগের অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথ ভজনটির বঙ্গানুবাদ করেন। …আমাদের এই আনুমানিক সিদ্ধান্ত যদি বিদগ্ধজনের সমর্থনযোগ্য হয়, তবে এটি-ই রবীন্দ্রনাথ-রচিত প্রথম ব্রহ্মসংগীত বলে গণ্য হবে। …তবে আমাদের মত গ্রাহ্য হলে সেখানে বয়স ও সালটি সংশোধনের প্রয়োজন হবে, লিখতে হবে – ‘বয়স ১১। ১২৭৯। ১৮৭৩’। ”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনকালে অসংখ্য গান রচনা করেছেন। তিনি কেবল গীতিকার বা সুরকার ছিলেন না। তিনি তাঁর গানের শরীর রাঙাতেন অভিনব উপায়ে। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত কাব্য আর সুরের অপূর্ব এক মিশ্রণ।
রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যাক্তি ছিলেন। যদিও তাঁর রাজনৈতিক দর্শন যথেষ্ট জটিল ছিল, তবে তাঁর লেখায় আর বক্তব্যে আমরা সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষপাতিত্ব দেখতে পাই। তাঁর মাঝে আমরা প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার প্রকাশ বরাবরই দেখতে পাই।
একজন সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ,অভিনেতা,গায়ক,সুরকার,গীতিকার ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচয়ে আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর মৃত্যুর বহু বর্ষ পরেও তাঁকে স্মরণ করা হয় প্রতি মুহূর্তে। যেন তিনি এখনও আছেন। তিনি এমনি ব্যাক্তি। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে চলা রবীন্দ্রনাথ। যিনি এখনও হেঁটে চলছেন আমাদের মাঝে। হয়ত হেঁটে চলবেন আরো কয়েক শতাব্দী বা সময়ের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত!

Loading

Leave a Comment