প্রদোষ মিত্র, প্রফেসর শঙ্কু ও একজন মানিকবাবু

২১ রজনী সেন রোড
ব্যালিগাঙ্গে, কলকাতা।।

কি? কিছু কি মাথায় এলো? না এলে আরেকটা কলু দেওয়া যায়।

প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। বাঙ্গালি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আর এই ইনভেস্টিগেশনে তার সবসময়ের সঙ্গী তাপস রঞ্জন মিত্র ওরফে তপসে।
এবার হয়তো অনেকেই ধরে ফেলবে। হুম। কথা হচ্ছিল বাংলার শার্লক হোমস ফেলুদা কে নিয়ে।১৯৬৫ সালে শিশু পত্রিকা সন্দেশে যার প্রথম আবির্ভাব।
ছেলেবেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে ফেলুদা সিরিজ পড়েনি এমন কিশোর বাংলায় খুঁজে পাওয়া দুস্কর। সোনার কেল্লা, কৈলাসে কেলেঙ্কারী কিংবা বাক্স রহস্য। নামগুলো শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ছ ফুট দু ইঞ্চির এক তেজি, সত্যান্বেষী যুবক। ফেলুদা । খুব সম্ভবত বাংলার ইতিহাসে ফেলুদাই একমাত্র চরিত্র যা ছেলে বুড়ো সকলের কাছেই সমান জনপ্রিয়। গল্প, সিনেমা, কার্টুন যাই হোক না কেন ফেলুদা মানেই যেন বাজিমাত।

এই ফেলুদার জনক বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণে যার খ্যাতি জগৎজোড়া। ১৯২১ সালের ২রা মে উত্তর কলকাতার গড়পার রোডে শিল্পসাহিত্যে সমৃদ্ধ এক পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা সুকুমার রায় ও মাতা সুপ্রভা রায়ের একমাত্র সন্তান সত্যজিতের স্কুলশিক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল বালিগঞ্চ গর্ভনমেন্ট হাইস্কুলে । ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সাম্মানিক স্নাতক শেষ করার পর শান্তিনিকেতনে কলাভবনে ভর্তি হোন । কিন্ত ১৯৪২ সালে সেখানকার শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসেন তিনি । ১৯৪১ সালে “আ্যবস্ট্রাকশন” নামে একটি ইংরেজি গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ । ১৯৪৩ সালে চাকুরীজীবনের শুরু হয় বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার এ। এর মধ্যেই বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ ও চিত্রাঙ্কনের জন্য লাভ করেন পুরস্কার।

একাধারে ফিল্মমেকার, গল্পলেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, মিউজিক কম্পোজার, গ্রাফিক ডিজাইনার, চলচ্চিত্র সমালোচক সত্যজিৎ রায়ের জন্য কোনো বিশেষণ ই যেন যথেষ্ট নয়। মোটমাট ছত্রিশটি ফিল্ম তৈরী করেছেন তিনি। এখানে বলে রাখা ভালো কমার্শিয়াল আর্টিস্ট থেকে স্বাধীন চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশের পেছনে রয়েছে তাঁর জীবনের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা । প্রথমটি জেয়ান রিনোয়ের সাথে সাক্ষাৎ আর দ্বিতীয়টি লন্ডনে ভিত্তোরিয়ো দে সিকারের ইতালিয়ান নিউরিয়ালিস্ট ফিল্ম “বাইসাইকেল থিভস” (১৯৪৮) দেখা। চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসার ফলস্বরুপ ১৯৫৫ সালে তাঁর হাত ধরে মুক্তি পায় “পথের পাঁচালী”। এগারো টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি কান ফিল্ম ফেস্টিভেলে পায় শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান। একে একে তাঁর হাত ধরে আসে কালজয়ী সব সৃষ্টি। অপরাজিত (১৯৫৬), অপুর সংসার (১৯৫৯), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮) ইত্যাদি।

আর তাই অসামান্য কর্মের পুরস্কার হিসেবে তিনি পেয়েছেন ভারতরত্ন, আনন্দ বিদ্যাসাগর, ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (৩২টি), লিজিওন অফ অনার (ফ্রান্স), গোল্ডেন লায়ন (ভেনিস), সিলভার বিয়ার (২টি) গোল্ডেন বিয়ার এবং লাইফটাইম আ্যচিভমেন্ট এর বিশেষ অস্কার সহ আরো অনেক সম্মাননা।

ও হ্যাঁ, প্রফেসর শঙ্কুর কথা মনে আছেতো ? সত্যজিতেরই সৃষ্ট আরেক চরিত্র। ইনোভেটিভ ক্যারেক্টার হিসেবে অনায়াসে প্রফেসরের নাম বলা যায়। এই শঙ্কুকে নিয়ে তাঁর প্রথম গল্প “ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী”। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত “প্রফেসর শঙ্কু” তাঁর প্রথম গ্রন্থ যা শিশুসাহিত্য হিসেবে আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। এক ই বছরে ফেলুদা সিরিজের সূচনা গল্প “ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি” প্রকাশিত হয় । এই সিরিজেই বেরোয় সোনার কেল্লা, বাক্স রহস্য, জয় বাবা ফেলুনাথ, সমাদ্দারের চাবি, কৈলাসে কেলেঙ্কাকারী, বাদশাহি আংটি প্রভৃতি।

সোনার কেল্লায় মুকুলের নিজেকে জাতিস্মর ভাবার পেছনের রহস্য বের করা বা বাক্স রহস্যে বয়স্ক দীনানাথ লাহিড়ীর ট্রেনের কামড়ায় বদলে যাওয়া মূল্যবান ম্যানুস্ক্রিপ্ট সহ স্যুটকেস খুঁজে বের করা। কিংবা সমাদ্দারের চাবিতে রাধারমণ সমাদ্দারের রেখে যাওয়া গুপ্তধন বা কৈলাসে কেলেঙ্কারীতে প্রাচীন ভারতীয় মূর্তি অনুসন্ধান। ফেলুদার কাছে সব ই যেন বাঁ হাতের খেল। তথাকথিত হিরোদের মতো মারপিট ছাড়াই বুদ্ধির জোরে শত্রুকে করেছেন কুপোকাত। বের করে ফেলেছেন সব প্রশ্নের উত্তর। গল্পে গল্পে এ সব ই জানিয়ে দেন তাঁর ভাগ্নে তপসে। আর পর্দায় তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন নামকরা সব অভিনেতারা। সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায় , সব্যসাচী চক্রবর্তী বা হালের আবীর চ্যাটার্জী। ফেলুদা যেন সবসময়ই তরুণ। আর ফেলুদার সাথে সাথে সত্যজিৎ ও তাই এখনো রঙ্গিন। বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাণবন্ত।

১৯৯২ এর ২৩ শে এপ্রিল মৃত্যুবরণ করলেও শিল্পসাধক সত্যজিৎ তাই এখনো আমাদের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে বেঁচে আছেন। থাকবেন যুগ যুগ ধরে। শিশু কিশোর দের শৈশবকে করে তুলবেন আরো আকর্ষণীয়। আরো সজীব। ভারিক্কি চালে কৈশোরের ফেলুদা যেন তাই বারবার ফিরে আসে। ভরাট গলায় যেন বারবার বলে উঠে “কি হে..??”
সবশেষে শুভ জন্মদিন সত্যজিৎ রায়। বিশ্বদরবারে বাংলাকে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। ফেলুদার জন্যও রইল অভিনন্দন।

লেখকঃ কর্মী, কাকাড্ডা পাঠচক্র

Loading

1 thought on “প্রদোষ মিত্র, প্রফেসর শঙ্কু ও একজন মানিকবাবু”

Leave a Comment