অবেলার শঙ্খধ্বণি

আমি কবি নই – শব্দ শ্রমিক
শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে, চেতনায়
হৃদয়ের কালো বেদনায়।

                                        -রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

আশির দশকে কবি কণ্ঠে কবিতা পাঠে যে ক’জন কবি বাঙালি শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন তাদের মধ্যে একজন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করা রুদ্র আজও পরিচিত “প্রতিবাদী রোমান্টিক ” কবি হিসেবে। ১০ ভাই-বোন এর মধ্যে সবার বড় হওয়ায় নানা বাড়িতে স্নেহ-মমতায় কাটে তার শৈশব। স্কুল জীবনে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পাঠ ও কবিতা আবৃত্তির প্রতি তার ঝোঁক ছিলো। নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি তার কাছে যেন নেশা হয়ে দাঁড়ায়। মামাতো ভাইদের সাথে নিয়ে নানির ট্রাংক চুরির টাকা দিয়ে গড়ে তোলেন “বনফুল” লাইব্রেরী। কাঁচা হাতে শান দেয়ার শুরুটা এখান থেকেই। খেলাধুলার আগ্রহ থেকে গড়ে তোলেন মংলার প্রথম ক্রিকেট দল। ৬৯ – এর উত্তাল সময়ে কিশোর রুদ্র হরতাল, মিছিল, মিটিংয়ে ছিলেন সক্রিয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাবাকে হারানোর বেদনা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা তার ভাবনাজগৎ কে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচ.এস.সি পাশ করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। কলেজ থেকে শুরু হয় তার সাহিত্যের অনন্ত ক্ষেত্রে পদচারণা। পরবর্তীতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৯ সালে ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্য ” উপদ্রুত উপকূল “। ৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতায় তিনি ছিলেন দৃঢ়। তার কবিতায় রাজনীতি, সমাজ বাস্তবতা তথাপি সমকালীন সকল বিষয়ের বলিষ্ঠ উপস্থিতি পাওয়া যায় । মাটি ও মানুষের প্রতি চির দায়বদ্ধ এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাকে দিয়েছে সত্তরের অন্যতম কবির স্বীকৃতি। ক্ষণজন্মা এই কবি তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ে কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ, প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। সাহস ও স্বপ্নে, শিল্প ও সংগ্রামে আপাদমস্তক সমর্পিত এই কবি তার দৈর্ঘ্যের হিসেবে ক্ষুদ্র জীবনক সঁপেে দিয়েছিলেন তারুণ্যের দীপ্র সড়কে। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন আপামর নির্যাতিত মানুষের আত্মার মাঝে। হয়ে উঠেছিলেন তাদেরই কন্ঠস্বর। ” জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন” – এই নির্মম সত্য অবলোকন এর পাশাপাশি তিনি উচ্চারণ করেছেন – “ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই “। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান রুদ্র কে পরিনত করেছে ” তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক “-এ। একই সঙ্গে তার কাব্যের অপর প্রান্তে স্বপ্ন এবং প্রেমের উপস্থিতি, সুন্দরের মগ্নতা। ৩৪ বছরের জীবনে এই ক্ষণজন্মা কবি ৭ টি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও অসংখ্য গল্প, কাব্যনাট্য ও গান রচনা করেছেন। ছিলেন ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক। ব্যক্তিজীবনে তিনি নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন কে জীবনসঙ্গিনী করলেও বছর পাঁচেক এর বেশি সে বন্ধন টেকেনি।
এভাবেই রুদ্র আজো বেঁচে আছেন তার চেতনার মধ্য দিয়ে, লেখনীর মধ্য দিয়ে, সকল প্রতিকূলতায় উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাঙালীর হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বেঁচে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বাঙালী হৃদয় কোঠরে। “এতটা নিভৃতে জেগে থাকা যায় না। তবু জেগে আছি……আরো কত শব্দহীন হাঁটবে তুমি,আরো কত নিভৃত চরণে……”
লেখকঃ জান্নাতুল ফেরদৌস রিমু
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

Loading

Leave a Comment