বিবর্তন ও ত্বক

দু’শ বছরের কিছু বেশি সময় আগে চার্লস রবার্ট ডারউইনের জন্ম। ইংল্যান্ডে জন্ম নেয়া শ্বেতাঙ্গ এই ভদ্রলোক ছিলেন বেশ উঁচু মাপের প্রকৃতিপ্রেমী। তাঁর আগ্রহের জায়গাতে পরিবারকেও তিনি সঙ্গে পান, এতে করে আরো তুঙ্গে ওঠে তার আগ্রহ। ২০ বছর বয়সে, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময় তিনি H. M.S. Beagle নামের এক জাহাজে প্রকৃতিবিদ হিসেবে চাকুরি গ্রহন করেন এবং সেই সুবাদে বিশ্বের অনেক স্থান ভ্রমন করেন। সেই অভিজ্ঞতা ছিল অভিনব আর দুর্লভ। তাঁর অভিজ্ঞতায় তিনি দেখতে পান এ পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় রূপ। উদ্ভিদের মাঝে বৈচিত্র্য, প্রাণীদের মাঝে বৈচিত্র্য আর সেই সাথে মানুষের মাঝের দারূন বৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করার অভিনব অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেন। যা তিনি পরবর্তীতে তার কালজয়ী গ্রন্থ “On the Origin of Species” এ তুলে ধরেন।

এখানে মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর এই বইয়ে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কিত কেবলমাত্র একটা লাইন ছিল- Light will be thrown on the origin of man and his history. সে কথামত পরবর্তীতে তিনি লিখেছেন মানুষের (Homo sapiens) বিবর্তনের ইতিহাস। বিগল নামক জাহাজের ভ্রমন অভিজ্ঞতা আর অন্যান্য ভ্রমনপিয়াসু আর প্রকৃতিপ্রেমী মানুষদের কাছ থেকে শোনা তথ্য থেকে তিনি মানব বৈচিত্র্যের বিভিন্ন দিক নিয়েই সচেতন হয়েছিলেন।

এর মাঝে অতি গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি দিক ছিল মানুষের গায়ের রঙ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ত্বকের রঙ, মানুষে মানুষে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম একটি উপাদান। বৈচিত্র্যের এই দিকটি তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বুঝতে পারেন যে যাদের গায়ের রঙ ছিলো গাঢ় অতিরিক্ত গাঢ় (কৃষ্ণাঙ্গ বা কাছাকাছি) তাদের বসবাস ছিল বিষুব রেখা হতে কাছাকাছি এলাকায়। আর যাদের গায়ের রঙ ছিল অপেক্ষাকৃত হালকা বা অতিরিক্ত হালকা (শ্বেতাঙ্গ বা কাছাকাছি) তাদের বসবাসের এলাকা ছিলো মেরুর নিকটবর্তী অঞ্চলে। এ সম্পর্কে তাঁর আরেকটি গ্রন্থ, The Descent of Man -এ তিনি বলেন- “Of all the differences between the races of man, the color of the skin is the most conspicuous and one of the best marked…” এর সাথে তিনি আরেকটি অতি জরুরি মন্তব্য প্রকাশ করেন। মানুষের ত্বকের রঙের উপর পরিবেশের কোনোরূপ প্রভাব তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর বিরাট ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় তিনি বিভিন্ন পরিবেশে আর বিভিন্ন জলবায়ুতে বিভিন্ন মানুষ দেখতে পান যাদের গায়ের রঙে এক প্রকার নিয়মিত বৈচিত্র্য ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি মানুষের এই অভিনব বৈশিষ্ট্যের উপর জলবায়ুর কোনো প্রভাব অস্বীকার করেন। কিন্তু কেন? যদি ডারউইন এখন বেঁচে থাকতেন ? তবে কি তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটুট থাকতেন ? সম্ভবত নয়। বর্তমানে আবিষ্কৃত তথ্য নিশ্চিতভাবেই তাকে বিব্রত করতো , এ কথা হলপ করে বলা যায়।

তাঁকে বিচলিত করার মত উপাত্ত বলতে পৃথিবীতে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব লক্ষ্য করা যাক। পৃথিবী পৃষ্ঠের সকল অংশে অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব সমান নয়। যেখানে পৃথিবীর অনেক অংশে এর প্রভাব খুব বেশি সেখানে এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে এর প্রভাব খুবই নগণ্য। এ বিষয়ে আরো গাঢ় দৃষ্টি দিলে আমরা চমকপ্রদ এক তথ্যের মুখোমুখি হই। পৃথিবী পৃষ্ঠের যে অংশে অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব সবচেয়ে বেশি সেখানে বসবাসকৃত মানুষের গায়ের রঙ সবচেয়ে গাঢ় অর্থাৎ কালো। অন্যদিকে অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব কমার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় বাস করা মানুষের গায়ের রঙ হালকা থেকে প্রবল হালকা বা শ্বেতধর্মী হয়ে থাকে। এখানে মজার ব্যাপার হচ্ছে বিশ্বের সকল মানুষই ঐতিহাসিকভাবে গাঢ় অর্থাৎ কালচে ত্বকের অধিকারী। কেননা মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের শুরুর দিকে তাদের বসবাস ছিল এমন এমন এলাকায় যেখানে অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব অত্যন্ত বেশি, যেমন- বিষুব রেখার নিকটবর্তী আফ্রিকা অঞ্চল। সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির তিনটি অংশ – UVA , UVB , UVC এর মাঝে কেবল UVA এবং UVB ই পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌছাতে পারে। বিষুব রেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে UVA এবং UVB এর প্রভাব অনেক বেশি। UVB বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে ধ্বংসাত্মক, এটি মানবদেহের DNA-এর ক্ষতি সাধন করতে পর্যন্ত সক্ষম যা মারাত্মক ক্যান্সারের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে এর উপকারী দিকও রয়েছে। UVB রশ্মি মানবদেহে ভিটামিন ‘ডি’ উৎপন্ন করে যা আমাদের দেহে হাড় গঠনে খুবই জরুরি ভূমিকা পালন করে।

একই সাথে প্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর এই রশ্মি কে বশে আনার জন্য প্রকৃতি এক আশীর্বাদ দিল মানবজাতিকে । সেই আশীর্বাদের নাম ‘মেলানিন’। এই মেলানিন নামক পদার্থ সুরক্ষা দেয় UVB এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে। এতে করে অতি বেগুনী রশ্মির সংস্পর্শে এসেও দারুন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় মানুষ আর সেই সাথে লুফে নেয় এর প্রয়োজনীয় ও উপকারী দিক। তাই বিবর্তনের স্বার্থে দক্ষ কর্মীর মত কাজ করে মেলানিন। আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি, এই মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থের কারনেই আমাদের গায়ের রঙ গাঢ় অর্থাৎ কালো বা কালচে হয়।

সূর্যের সাথে যুদ্ধে আমরা জিতে যাই মেলানিনের কল্যাণে। কিন্তু তারপর কি হল? তারপর আমরা, মানুষরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করি পৃথিবীজুড়ে। বিষুবরেখার নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকা মানুষ দ্রুতই পৌঁছে যায় মেরুর কাছাকাছি। সেখানকার অবস্থা ছিলো অন্যরকম। জলবায়ু ঠান্ডা আর শুষ্ক এবং সেই সাথে সেসব অঞ্চলে অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব ছিল খুবই অল্প। এটি একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। খুবই অল্প পরিমাণ রশ্মি থেকে মানবদেহ প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘ডি’ উৎপন্ন করতে পারেনা যাতে করে মানুষের স্বাস্থ্য ভীষণ হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু বুদ্ধিমান আর দারুণ অভিযোজন ক্ষমতার অধিকারী প্রাণীটি সেই হুমকির অন্ধকার ছেড়ে ঠিকই বেড়িয়ে আসে। সময়ের সাথে সাথে তাদের ত্বক মেলানিন উৎপাদন এমনভাবে কমিয়ে দেয়, যাতে করে খুব সহজেই UVB রশ্মি গ্রহনে সক্ষম হয় মানুষের ত্বক, প্রায় কোনো রকম সুরক্ষাবলয় ছাড়াই । আর এতে করে অল্প রশ্মির প্রভাবেও যথেষ্ট ভিটামিন ‘ডি’ উৎপাদনে সক্ষম হয় মানবদেহ । চমৎকার অভিযোজনে তাই সমাধান আসে।

আমরা অনেকেই এমন পরিবেশে বাস করি যা আমাদের ত্বক গ্রহণ করতে পারেনা। এটি একটি বিরাট সমস্যা হলেও অনেকেই তা এড়িয়ে যায়। যাদের গায়ের রঙ অনেকটা হালকা বা শ্বেত ধর্মীয়, তারা যদি অতি বেগুনী রশ্মির উচ্চ প্রভাব বিশিষ্ট অঞ্চলে বাস করে তবে তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণে। অন্যদিকে যাদের গায়ের রঙ গাঢ় অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গরা যদি এমন পরিবেশে বাস করে যেখানে অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব খুবই কম, তবে তাদের দেহ প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘ডি; উৎপাদনে ব্যর্থ হবে এবং গুরুতর শারীরিক সমস্যায় পড়তে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া খুবই জরুরি।

বিবর্তন, বর্তমান সময়ের আলোচিত আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত এক বিষয় । যখন আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করবে বিবর্তনের প্রমাণ কি? তার উত্তর আপনার শরীরেই সগৌরবে বিরাজমান। বিবর্তনের জলজ্যান্ত প্রমাণ আপনার ত্বক, আপনার গায়ের রঙ।

কখনো ভেবে দেখেছেন কি, মানুষের বিবর্তনের প্রমাণ আপনার শরীরেই মাথা উঁচু করে আছে। ভেবে দেখুন, একে স্পর্শ করুন, এর প্রশংসা করুন, একে উদযাপন করুন। আপনিই বিবর্তনের প্রমাণ এটা ভাবুন। শিহরিত হবেন তা আমি হলপ করে বলতে পারি।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়

Loading

Leave a Comment