ড. নরম্যানের সবুজ বিপ্লবের গল্প

ড. নরম্যানের সবুজ বিপ্লবের ফলে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পায় ভারত ও পাকিস্তানের মত দেশ। ভারতের ১৯৬৫ সালের গম উৎপাদন ছিল ১২.৩ মিলিয়ন, ১৯৭০ সালে দাঁড়ায় ২০.১ মিলিয়নে ও ২০০০ সালে ৭৬.৪ মিলিয়ন। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিপুল বৃদ্ধির ফলে উপকৃত হয়েছে এশিয়ার বাকি দেশগুলো যেমন ফিলিপাইন, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশ। কাকাড্ডা ডট কমে সবুজ বিপ্লবের গল্প শুনিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরহাদ হৃদয়। 

 

বিংশ শতকে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি মানবজাতিকে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল তা হল খাদ্য সমস্যা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের কল্যাণে বাড়ছিল মানুষের গড় আয়ুষ্কাল, ফলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল উর্ধ্বমুখী। অথচ দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছিল না খাদ্য উৎপাদন। যার ফলশ্রুতিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো ভুগছিল দুর্ভিক্ষ অথবা দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে।

এমনই এক পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাবে আক্রান্ত দেশগুলোর কাছে আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল একটি নাম। ড. নরম্যান আর্নেস্ট বোরলগ। যার সবচেয়ে বিখ্যাত পরিচয় “সবুজ বিপ্লবের” জনক হিসেবে।
১৯৪২ সালে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোরলগ উদ্ভিদের জিনগত রোগ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। আর ১৯৪৪ সালে তিনি মেক্সিকোয় শুরু করেন রোগ প্রতিরোধী ও উচ্চফলনশীল গমের জাত উদ্ভাবনের কাজ। এর ফলেই আমূল পরিবর্তন আসে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায়, যাকে বলা হয় সবুজ বিপ্লব।

বিপ্লবটি বদলে দেয় মেক্সিকোকে। ১৯৪৩ সালে মেক্সিকো যেখানে প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেক শস্য বিদেশ থেকে আমদানি করত, সেখানে ১৯৫১ সালের মধ্যেই দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এমনকি ১৯৫৪ সালে মেক্সিকো রপ্তানি করে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন গম। দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পায় ভারত ও পাকিস্তানের মত দেশ। ভারতের ১৯৬৫ সালের গম উৎপাদন ছিল ১২.৩ মিলিয়ন, ১৯৭০ সালে দাঁড়ায় ২০.১ মিলিয়নে ও ২০০০ সালে ৭৬.৪ মিলিয়ন। একইভাবে পাকিস্তানের গম উৎপাদন ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০০ সালে বেড়েছে ৪.৩ থেকে ২১ মিলিয়নে। এছাড়াও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিপুল বৃদ্ধির ফলে উপকৃত হয়েছে এশিয়ার বাকি দেশগুলো যেমন ফিলিপাইন, চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশ।

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে নরম্যান বোরলগ ব্যবহার করেছিলেন আধুনিক সমন্বিত চাষ ব্যবস্থা। যার মূল প্রেরণা ছিল ডারউইন প্রকাশিত বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্য এবং মেন্ডেলের উদ্ভাবিত বংশগতি স্থানান্তর সূত্র। খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানো এই সাফল্যের নামকরণ কিন্তু বোরলগ নিজে করেননি। ১৯৬৮ সালের ৮ মার্চ ইউএসএইড (USAID) এর পরিচালক উইলয়াম এস গাউড একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতির সম্মেলনে ভাষণ দেয়ার সময় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশলকে “সবুজ বিপ্লব” বলে আখ্যায়িত করেন। এর পর থেকে বোরলগ নিজেও এটি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন সময়। সাফল্যের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ড. বোরলগ পেয়েছিলেন ১৯৭০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে। পেয়েছেন ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ। এছাড়াও বোরলগকে সম্মানিত করে কৃতার্থ হয়েছে কানাডা, নরওয়ে, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ও পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান। সবুজ বিপ্লবের সাফল্যই ড. বোরলগকে স্মরণ করার একমাত্র কারণ নয়। নোবেল কমিটিকে কৃষি বিজ্ঞানে নোবেল প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে নিজেই ১৯৮৬ সালে শিল্পপতি জন রুয়ানের সহযোগিতায় প্রবর্তন করেন ‘বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার’। খাদ্য ও কৃষি গবেষণায় ক্ষেত্রে নোবেল বলে যা এখন বিশ্বজুড়ে পরিচিত।

কৃষির অগ্রগতিতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করাই এখন আর একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। যত দিন যাচ্ছে দিন দিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছে। বর্তমানে বরং খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার ফলে পরিবেশের উপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সেটাই একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষি ক্ষেত্রে নতুন নতুন গবেষণা আর সৃজনশীল কর্মকান্ডকে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে ড.বোরলগ প্রবর্তিত ‘বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার’। তাইতো বলা যায় শুধু সবুজ বিপ্লব নয় কৃষির যে কোন ধরণের অগ্রগতিতে শ্রদ্ধার সাথেই স্মরিত হবেন ড.নরম্যান আর্নেস্ট বোরলগ।

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। 

Loading

Leave a Comment