বৃহস্পতির কতো চাঁদ!

বৃহস্পতি – সৌরজগৎ এর সবচেয়ে বড় গ্রহ। মোট ৬৭ টি চাঁদ বৃহস্পতিকে আবর্তন করছে।এদের মধ্যে সালফার ও লাভার স্তরযুক্ত রঙিন লো, বরফাচ্ছাদিত ইউরোপা, সৌরজগৎ এর সর্ববৃহৎ উপগ্রহ গ্যানিমেড এবং পাথুরে ক্যালিস্টো- বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

৭ জানুয়ারি, ১৬১০। সাড়া জাগানিয়া একটি দিন। গ্যালিলিও গ্যালিলি ঠিক এই দিনেই বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ আবিষ্কার করেন। তবে, গল্পের শুরুটা বলতে গেলে আরও একটু পিছিয়ে শুরু করতে হয় ১৬০৯ সাল থেকে। পাডুয়া ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত প্রফেসর গ্যালিলিও গ্যালিলি একটি নব্য আবিষ্কৃত দূরদর্শন যন্ত্রের কথা শুনতে পান। কৌতূহলী গ্যালিলিও নানান ধরনের লেন্স ও কাঠের নলের ব্যবহার করে কাজে লেগে পড়লেন। সফলও হলেন। তৈরি করলেন টেলিস্কোপ। যদিও তিনি সর্বপ্রথম টেলিস্কোপের আবিষ্কারক নন তবুও তিনিই সফলভাবে টেলিস্কোপ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।

আবার ফিরে আসি ১৬১০ সালে। গ্যালিলিও নিত্যদিনের অভ্যাস বশে টেলিস্কোপে চোখ রাখলেন। বৃহস্পতির খুব কাছেই তিন তিনটি নক্ষত্র তার চোখে পড়লো, যার মধ্যে দুটি ছিল বৃহস্পতির পূর্বে আর একটি পশ্চিমে। পরদিন একই সময়ে তিনি একটু অবাক হয়েই লক্ষ্য করলেন নক্ষত্রগুলোর অবস্থানের বেশ খানিকটা পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যাপারটা তাহলে কী? গ্যালিলিও বুঝতে পারলেন এই ঘূর্ণায়মান নক্ষত্রগুলো আসলে বৃহস্পতির চারিদিকে আবর্তনকারী চাঁদ। ১৩ জানুয়ারি তিনি চতুর্থ চাঁদ আবিষ্কার করলেন। তার এই আবিষ্কার বিশ্ববাসীকে জানানোর তাগাদা অনুভব করে ১৬১০ এর মার্চে তিনি Sidereus Nuncius -এ তার পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করেন। প্রথমে গ্যালিলিও তার এই আবিষ্কৃত চাঁদের নাম দেন Cosmica Sidera. পরবর্তীতে জানা যায়, Simon Marius ঠিক এই সময়ে বৃহস্পতির চাঁদ আবিষ্কার করেছিলেন। সিমন ম্যারিয়াস নাম দেন লো, ইউরোপা, গ্যানিমেড, ক্যালিস্টো। গ্যালিলিওর আবিষ্কার বিরোধিতা করলো ‘বিশ্বজগতের কেন্দ্র পৃথিবী ‘ এই প্রাচীন ধারণাকে। সারা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।

১৬৩৩ সালে তাকে হুমকি দেওয়া হলো এই ধারণা মিথ্যে তা স্বীকার করতে। রাজী না হওয়ায় গ্যালিলিওকে বাকি জীবন বন্দিদশায় কাটাতে হয়েছিল ফ্লোরেন্সের এক পাতালঘরে। শারীরিক অবনতির কারণে এবং দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে ১৬৪২সালে ৭৭ বছর বয়সী গ্যালিলিও মারা যান। কিন্তু রয়ে যায় তার পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল, যা পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের জন্য পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করে। ১৯৭৯ সালে ভয়েজার-১ এর তোলা ছবিতে লো উপগ্রহে আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। লো বৃহস্পতির চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তিত হওয়ায় বৃহস্পতির মহাকর্ষ বলের প্রভাবে লো এর পৃষ্ঠে ১০০ মিটার (৩০০ ফুট) উঁচু লাভার প্রবাহ সৃষ্টি হয়।

১৯৭৯-২০০০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মহাকাশ অভিযানের পর ভয়েজার এবং গ্যালিলিও স্পেসক্রাফট হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপার বরফের আচ্ছাদনের নিচে রয়েছে সুবিশাল সমুদ্র। ফলে বিজ্ঞানীরা ইউরোপাতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার ধারণা করছেন। পাথুরে ক্যালিস্টো সৌরজগৎ এর সুপ্রাচীন ইতিহাস বহন করে। বৃহস্পতির চারদিকে ইউরোপার আবর্তনকাল লো এর আবর্তনকালের দ্বিগুণ। আবার গ্যানিমেডের আবর্তনকাল ইউরোপার আবর্তনকালের দ্বিগুণ। ২০০৩ সালে গ্যালিলিও স্পেসক্রাফট এর মিশন শেষ হয় এবং বৃহস্পতিতে স্পেসক্রাফটটি ধ্বংস করা হয়। গ্যালিলিওর মৃত্যুর পরও তার গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানীদের পথ দেখিয়েছিল। তেমনি গ্যালিলিও স্পেসক্রাফট এর কাজ শেষ হলেও গবেষকরা থেমে নেই। ইউরোপাতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা এত বেশি যে, বিজ্ঞানীরা ২০২০ সালে আরও একটি মহাকাশযান প্রেরণ করবেন, যা ইউরোপা সম্বন্ধে আরও তথ্য সংগ্রহ করবে। ইউরোপায় প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া হবে মানবজাতির জন্য একটি অসাধারণ মাইলফলক। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

Loading

Leave a Comment