দেজাভু রহস্য

দেজা ভু তখনই ঘটে যখন আমাদের কোন একটা সিচুয়েশন বা কোন মানুষকে পরিচিত মনে হয় কিন্তু তা আমরা ঠিক মনে করতে পারি না, মেমোরিগুলো ধোঁয়াশে থাকে। দেজাভু নিয়ে কাকাড্ডা ডট কমে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাহসিন অর্থী। 

 

ধরুন, আপনাকে একটি সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় নিয়ে আসা হলো। যেখানে আপনি আগে কখনো আসেন নি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আপনার মনে হলো আপনি এখানে আগে এসছেন, এই জায়গাটি আপনার পূর্ব পরিচিত অথচ কখন, কিভাবে এসেছেন তা মনে করতে পারছেন না। তথ্যগুলো ঝাপসা। এই মিস্টিরিয়াস অনুভূতি সাধারনভাবে পরিচিত déjà vu (দেজা ভু) নামে। আমরা প্রায় সবাই কখনো না কখনো এই অনুভূতির স্বীকার হয়েছি। দেজা ভু তখনই ঘটে যখন আমাদের কোন একটা সিচুয়েশন বা কোন মানুষকে পরিচিত মনে হয় কিন্তু তা আমরা ঠিক মনে করতে পারি না, মেমোরিগুলো ধোঁয়াশে থাকে। কিছুটা ভৌতিক মনে হচ্ছে তাইতো? অপরিচিত জিনিস আবার পরিচিত লাগে কিভাবে? জ্বীন ভূতের আছড় নাকি? অনেকটা সময় ধরে দেজা ভু বিষয়টাকে মানুষজন প্যারানরমাল কোন বিষয়ই ভেবে থাকতো, কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বলে বিজ্ঞান থেমে থাকেনি। বিজ্ঞান এর উত্তর খুজে বের করেছে। এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের মেমোরিতে!

সাম্প্রতিককালে এই বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। যেগুলো কিনা প্রায় প্রত্যেকটিই ওই হিউম্যান মেমোরিকেই দায়ী করেছে। আরো স্পেসিফিকেলি বলতে গেলে বলতে হয় রিকগনিশন মেমোরি। এখন রিকগনিশন মেমোরি জিনিসটা কি?

সোজা বাংলায় এর অর্থ স্বীকৃত মেমোরি! এটা মেমোরির এমন একটা অংশ যা কিনা আমাদের পূর্বে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা আবার ঘটলে তা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।যেমন রাস্তায় হঠাত পুরোনো কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়া কিংবা অনেক আগে শোনা কোন গান হঠাৎ করে আবার শুনলে তা মনে পরে যাওয়া ইত্যাদি সব রিকগনিশন মেমোরির উদাহরণ। কিন্তু আমরাতো বলেছি যে ঘটনা ঘটে নি আগে অথচ তা পরিচিত মনে হওয়া হলো দেজা ভু।তাহলে সেটা রিকগনিশন মেমোরি হয় কিভাবে?

এর উত্তর নিহিত রয়েছে রিকগনিশন মেমোরির দু’টি অংশের একটির মধ্যে। রিকগনিশন মেমোরি দুইভাবে কাজ করে- রিকালেকশন এবং ফ্যামিলিয়ারিটি।
রিকালেকশন ভিত্তিক রিকগনিশন মেমোরি ঘটে থাকে যখন আমরা আমাদের সামনে উপস্থিত ঘটনাটি পূর্বে আমাদের সাথে কখন কিভাবে ঘটেছিল তা মনে করতে পারি। যেমন আপনি রাস্তায় একজন মানুষকে দেখলেন, আপনার তাকে পরিচিত মনে হলো। এবং আপনি মনে করতে পারলেন তাকে আপনি এর আগে বাসে দেখেছেন।

ফ্যামিলিয়ারিটি বেইজড রিকগনিশন মেমোরি রিকালেকশনের মতই। পার্থক্য হচ্ছে আপনি এখানে মনে করতে পারেন না বর্তমানের যে ঘটনাটি আপনার সাথে ঘটছে সেটা পূর্বে কখন-কিভাবে ঘটেছিল। যেমন উপরের উদাহরণ অনুযায়ী বাসে দেখা মানুষটাকে রাস্তায় আবার দেখলেও তাকে ঠিকভাবে মনে করতে না পারলে সেটা হয়ে যাবে ফ্যামিলিয়ারিটি বেইজড রিকগনিশন।

(এখন কিছুটা মিল পাচ্ছেন কি? দাড়ান সামনে আরো পরিষ্কার করা হবে)
দেজা ভুকে এই ফ্যামিলিয়ারিটি বেইজড রিকগনিশনের একটা অংশ হিসেবে ধরা হয়। যেখানে ব্যাক্তি পুরোপুরি নিশ্চিত থাকে তার বর্তমানে তার সাথে ঘটা ঘটনাটি পূর্বে ঘটেছিল, কিন্তু তার বিস্তারিত তথ্য সে মনে করতে পারে না।

দেজা ভুর সাথে ফ্যামিলিয়ারিটি বেইজড রিকগনিশনের সম্পর্ক আছে কিনা দেখতে যেয়ে এর উপর বেশ কিছু গবেষনা করা হয়। সাম্প্রতিককালে কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজিস্ট Anne. M. Cleary-এর একটি গবেষনা উল্লেখযোগ্য। এখানে পারটিসিপেন্টদের কিছু সেলিব্রিটির নাম সম্বলিত একটি তালিকা পড়তে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের কিছু সেলিব্রিটির ছবি দেখানো হয়, যার মধ্যে কিছু পূর্বের তালিকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর কিছু সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। পারটিসিপেন্টদের বলা হয় সেলিব্রিটিদের নাম বলতে আর আগের লিস্টে নামগুলো ছিল কি ছিল না তা বের করতে। ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। পারটিসিপেন্টরা কিছু কিছু সেলিব্রিটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারে নি। এদের মধ্যে কয়েকজন সেলিব্রিটিকে তাদের পরিচিত মনে হলেও সঠিক নামটি তারা মনে করতে পারছিল না।অথচ পূর্বের লিস্টে সেই নামটি ছিল! অর্থাৎ তারা তাদের ফ্যামিলিয়ারিটির সঠিক উৎস খুজে পাচ্ছিল না। 

Cleary এই ব্যাপারে আরো কিছু পরীক্ষণ চালায়। যেমন কোন অবস্থার ঠিক কোন উপাদান বা বৈশিষ্ট্য ফ্যামিলিয়ারিটি অনুভূতিটি আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করে? পারটিসিপেন্টদের এখানে কিছু র্যানডম শব্দের তালিকা পড়তে দেয়া হয়। একটি শব্দ চিহ্নিতকরণের টেস্টে ব্যাবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে কিছু আবার আগের সেই শব্দ তালিকার অংশ ছিল কিন্তু শুধুমাত্র সাউন্ডের ক্ষেত্রে (e.g: Lady’র সাথে EightY’র, Cat এর সাথে Bat এর মিল এরকম)। দেখা যায় যেসকল শব্দ আগের লিস্টে ছিল না কিন্তু সাউন্ডের দিক থেকে কিছুটা একই সেগুলোকে পারটিসিপেন্টরা চিহ্নিত করতে পেরেছিল যদিও বা সেটার সোর্স তাদের স্মৃতিতে পুরোপুরি ছিল না। অর্থাৎ এখানে ফ্যামিলিয়ার সাউন্ড এই ফ্যামিলিয়ারিটি রিকগনিশন করতে সাহায্য করেছে। এরকম ভাবে একইরকম জ্যামিতিক আকৃতির বস্তুও এধরণের রিকগ্নিশন করতে পারে।

এই ফলাফলগুলো থেকে এটা বোঝা যায় কোন ঘটনা বা পর্বের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মস্তিষ্কে হালকা ফ্রেগ্মেন্ট বা একক উপাদান হিসেবে জমা থাকে। দেজা ভু তখনই ঘটে যখন বর্তমানের কোন বিশেষ একটা ঘটনার সাথে পূর্বের অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত কোন ঘটনার কিঞ্চিৎ মিল থাকে। যদি সেই দুইটি ঘটনার মধ্যে অন্য কোন ঘটনা এসে বাগড়া না বাধায় তাহলেই দেজা ভু নামক সেই প্যারানরমাল বিষয়টা অনুভূত হয়। তবে এখনো এই বিষয়টা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। প্রায়ই ২টা ঘটনার মধ্যে ওভারল্যাপিং বিষয়টা চলে আসে। তবে গবেষকরা বিশ্বাস করেন ফ্যামিলিয়ারিটি বেইজড রিকগনিশন মেমোরির মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেজা ভুর উত্তর। সুতরাং রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এই দিকেই আমাদের কাজ নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত।

লেখকঃ তাহসিন অর্থি, শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Loading

Leave a Comment