স্বপ্ন কথা

আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি। কখনো আনন্দের, কখনো বা ভয়ের। কিছু স্বপ্ন বিক্ষিপ্ত, অর্থহীন। কোনোটা আবার আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার অংশবিশেষ। আমরা স্বপ্ন কেন দেখি,স্বপ্নের মানেই বা কী? প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আসছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা তৈরী করে নিয়েছে। এদের মাঝে কিছু ব্যাখা ছিল ভিত্তিহীন, অমূলক। আবার কিছু ছিল যুক্তিসংগত। এই যুক্তিসংগত ব্যাখা গুলো পরবর্তী সময়ে স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার দ্বারা উন্মোচন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

স্বপ্নের উৎপত্তি, ব্যাখা, গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব ও ধারণা প্রচলিত। এদের মধ্যে সবার প্রথমে যে তত্ত্বের কথা মাথায় আসে,তা হল ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মনোবিজ্ঞানী সিগমান্ড ফ্রয়েড স্বপ্নের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রদান করেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী স্বপ্ন হল মানুষের অবচেতন মনের প্রতিফলন, অবচেতন মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থেকেই স্বপ্নের উৎপত্তি। কিন্তু সুইডিশ মনোবিজ্ঞানী কার্ল জাং, যাকে বিশ্লেষণমূলক মনোবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, ফ্রয়েডের তত্ত্বের অনেক অংশই প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে স্বপ্ন মানুষের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, যা আমাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমরা সারাদিনে যা কিছু দেখি, যেসব ঘটনার মুখোমুখি হই, সেগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখায় বা স্বপ্ন তৈরী তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জার্মান মনোবিদ ফ্রিটজ পার্লস এর মতে, স্বপ্ন হল আমাদের অবদমিত সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। সচেতন অবস্থায় আমাদের যেসব চিন্তা অবদমিত থাকে, সেগুলোই স্বপ্নে প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৭৬ সালে জে. এলান হবসন এবং রবার্ট ম্যাককার্লি সম্পূর্ণ নতুন এক তত্ত্ব প্রদান করেন, যা স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মানুষ বেশিরভাগ স্বপ্নই দেখে ঘুমের REM (Rapid Eye Movement) স্তরে। অন্যান্য স্তরে স্বপ্ন দেখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই স্বপ্ন গুলো মানুষ ভুলে যায়। REM স্তরে দেখা স্বপ্ন গুলোই দীর্ঘসময় মনে থাকে। হবসনের মতে, মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের যে অংশগুলো আবেগ, অনুভূতি ও স্মৃতি গঠনের সাথে জড়িত (যেমন এমিগডালা, হিপোক্যাম্পাস), REM স্তরে সেগুলো যখন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এক ধরনের সংকেত সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক তখন এই সংকেত গুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে,যার ফল হিসেবে আমরা স্বপ্ন দেখি।

হবসনের মতে, মস্তিষ্কের পশ্চাৎ ভাগ থেকে স্বপ্নের উৎপত্তি। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অফ কেপটাউন -এর প্রফেসর ও নিউরোসার্জন মার্ক সলমস দীর্ঘদিন জোহানেসবার্গের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করে অসংখ্য রোগীকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেন, মস্তিষ্কের প্যারাইটাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্বপ্ন দেখাও বাধাগ্রস্ত হয়। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মস্তিষ্কের পশ্চাৎ ভাগ নয়, বরং সম্মুখভাগ থেকেই স্বপ্নের উদ্ভব হয়।
পরবর্তীতে হবসনের তত্ত্ব এবং মার্কের পর্যবেক্ষণ এর ফলাফল সমন্বিত করে ‘জি ঝাং ‘ স্বপ্ন সম্পর্কে বলেন, স্বপ্ন হল ঘুমন্ত অবস্থায় চলমান একটি প্রক্রিয়া, যা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, সাজানো এবং তথ্য প্রবাহের সাথে জড়িত। তার মতে, স্বপ্ন দেখার সময় মূলত মস্তিষ্কে তথ্য প্রবাহিত হয় যা স্মৃতি গঠনে সাহায্য করে। কেন আমরা এক স্বপ্ন থেকে অন্য স্বপ্নে ঢুকে যাই, এর ব্যাখাও জি ঝাং এর তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়।

২০০১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বপ্ন মূলত আমাদের স্মৃতি গঠনে সাহায্য করে। সজাগ অবস্থায় আমরা যেসব সূক্ষ্ম জিনিস এড়িয়ে যাই, সেসব আমাদের অবচেতন মনে জমা থাকে। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক এই সূক্ষ্ম বিষয় গুলো বিশ্লেষণ করে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

মজার বিষয় হচ্ছে শুধু মানুষ নয়, সব স্তন্যপায়ী প্রাণীই স্বপ্ন দেখে। এদের মধ্যে ডলফিনের REM স্তরের ব্যাপ্তি সবচেয়ে কম, মানুষের ক্ষেত্রে যা আরেকটু বেশি। আর আর্মাডিলো, অপোসাম প্রজাতির জন্য এ ব্যাপ্তি সবচেয়ে বেশি।

স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার ফলে বেরিয়ে আসছে মজার সব তথ্য। মানবমস্তিষ্কের এই রহস্য উন্মোচন করতে মনবিদগণ ক্রমাগত গবেষণা চালিয়েই যাচ্ছেন। স্বপ্ন আমাদের কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়- এমন তথ্যও বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। আশা করা যায়, খুব দ্রুত মনোবিদগণ স্বপ্ন নিয়ে তাদের গবেষণায় সফল হবেন, আর তাদের গবেষণার ফলাফল স্বপ্ন সম্বন্ধে আমাদের সব কৌতূহল মেটাতে সক্ষম হবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment