ভুবন মাঝি : সিনেমা রিভিউ

ড্রামের আওয়াজ,পরমব্রতের মুখে মুক্তিযুদ্ধের আবেগময় কথা। ট্রেইলার দেখে ভিতর থেকেই ছবিটা দেখার একটা অন্যরকম টান অনুভব করলাম।
খারাপ লাগে আমার যুগের টিনএজ ছেলেমেয়েদের দেখলে। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানে হলিউডের লোমহর্ষক কোনো মুভি যা দেখতে রোমাঞ্চকর হলেও মুভি শেষ হওয়া মাত্র সবই গ্রাফিক্স এর খেলা মনে করে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার বিষয় মাত্র। তাদের আর কি দোষ বলুন? একাত্তরের আবেগের জায়গাটা যে আমরা দেখিনি। আগের কিছু চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারিতে যাও ছিল তাও এখন বিলুপ্তপ্রায়।
বলছিলাম, সরকারি অনুদানে তৈরী “ভুবনমাঝি” চলচ্চিত্রের কথা। ফাখরুল আরেফিন নামের এক তরুণ পরিচালকের অনেক এক্সপেরিমেন্টের ফলাফলই বলা যায় মুভিটাকে। নজরকাড়া পোষ্টার, মিউজিক,দূর্দান্ত কালার গ্রেডিং এক কথায় অসাধারণ। আর প্রধান দুই আর্টিস্ট পরমব্রত ও অপর্ণা আমার অসম্ভব পছন্দের।
এই সিনেমার আরেকটি অভিনব দিক হল প্রেক্ষাপট পরিবর্তন, হাল আমলে অনেক সিনেমাতেই এরকম গল্প বলার স্টাইল চোখে পড়ে। এই সিনেমাটি তিনটি ভিন্ন সময়ের কাহিনী নিয়ে তৈরি। তিন সময়ের তিনটি আলাদা আলাদা সিনেমার মতই অনেকটা উপভোগ করেছি। এই দিকটি সিনেমায় মেখেছে অন্য এক রঙ।  একজন সংস্কৃতিকর্মীর অনিশ্চয়তা, নির্ভরতা, জড়তা, দোদুল্যমান মানসিকতা বাউল নহিরের চরিত্রে পরম এর চেয়ে নিখুঁতভাবে কেউ করতে পারতো কিনা আমার জানা নেই। গল্পের মূল কাহিনী কুষ্টিয়ার বাউল নহির এর জীবনী থেকে নেয়ায় আমি পরিচালককে না, পরমকেই বাহবা দিবো নহির বাউল কে ধারণ করবার জন্য।

অপর্ণার অভিনয়ে বরাবরের মতই মুগ্ধ হলাম। মুভিতে সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার। গড়াই নদীর তীরে বসে ফরিদাকে বলা “মরতে খুব ভয় করে ফরিদা। যেখানে কিচ্ছু নেই, সেখানে যেতে আমার ইচ্ছে করে না।” কিংবা চিঠিতে লেখা “এই প্রথম মনে হল বাংলা আমার দেশ, এই পতাকা আমার। যেমনটা তুমিও।” এছাড়াও ট্রাকে নহিরের ভাষণ দেবার কালে হাজার জনতার মাঝে লাল শাড়িতে ফরিদার হেঁটে যাওয়া এক কথায় অনবদ্য।
ছবির প্রতিটা গান সুন্দর, কিন্তু সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে “আমি তোমারই নাম গাই”। সদ্য প্রয়াত কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্যের সুর করা “আমি তোমারই নাম গাই”- গানটি বারবার শুনতে ইচ্ছে করে এমন একটি গান! এছাড়া খুব পরিচিত “ধন্যধান্য পুষ্পে ভরা”- নতুন করে শুনতে বেশ ভালোই লেগেছে।
এত কিছুর পরেও বলব প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির একটু ঘাটতি ছিল আমার কাছে। যুদ্ধের সামগ্রিক দৃশ্যের অতি সাদামাটা ভাব ওই সময়ের ভয়াবহতা টা কেন যেন ফুটাতে পারছিলো না। আর ১৯৭১-২০১৩ কে তিন ভাগে দেখানো দৃশ্যে মাঝে মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। কখনো কখনো পার্শ্ব চরিত্রের অভিনয় খুব কাঁচা লেগেছে।

এতটুকু ছাড়া সামগ্রিক বিবেচনায় চলচ্চিত্রটি আসলেই অসাধারণ। তাই অপ্রাপ্তিটুকু না হয় পদ্মানদীর নৌকায় চড়ে হুগলী নদীর তীরে ভেসে যাক। ইতিহাসের দরজায় বারংবার এভাবেই কড়া পড়ুক। কৃষ্টি যে শিকড় ছাড়া বাঁচে না।

বি.দ্রঃ চলচ্চিত্র মূল্যায়ন করার ধৃষ্টতা আমার নেই।এখানে শুধু আমার একান্তই নিজের অনুভুতিটুকু বলা……

চরিত্রায়নেঃ পরমব্রত চ্যাটার্জি (নহির), অপর্ণা ঘোষ (ফরিদা), শুভাশীষ ভৌমিক (আসলাম রাজাকার) কাজী নওশাবা আহমেদ (এলি), মামুনুর রশিদ (বড় হুজুর), ওয়াকিল আহাদ (সোহেল) মাজনুন মিজান (মিজান) সুষমা সরকার (নার্স), লালিম হক (বাউল নহির সাঁই)
পরিচালকঃ ফাখরুল আরেফিন খান।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

Loading

Leave a Comment