মানুষটা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে এক জায়গায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে ধ্যানের মত করে। তার চারপাশে বিশাল ধ্বংসস্তূপ - এটাই তাদের বসতি। সে চেষ্টা করছে মন দিতে, তার নিজের কাজে। কিংবা যেই কাজকে তার নিজের কাজ বলে ভাবতে শেখানো হয়েছে সেই কাজে। কিন্তু একটা ধ্বংসস্তূপে বসে আবার নিজের কাজ হয় নাকি? এই জঞ্জালগুলো তো আগে সরাতে হবে। তবে একটা কাজ সে খুব মন দিয়েই করে আজকাল। তার একটা লুকোনো বাগান আছে, সেই বাগানের গাছগুলোর যত্ন নেয়। এ বসতিতে আবার গাছপালা নিষিদ্ধ, কোনো লতাগুল্ম দেখলেই উপড়ে ফেলা হয়। সে তাও লুকিয়ে লুকিয়ে চারা বোনে, মাটিতে জল দেয় রোজ। রাস্তা করে দেয় আলো হাওয়া আসবার। ফাল্গুনের অপেক্ষায় থাকে - আসছে ফাল্গুনে তার চারাগুলো দ্বিগুণ হবে। এই বসতির শিশুদের সে শেখায় কী করে গাছেদের যত্ন নিতে হয়, শেখায় প্রাণের মানে। যদি সে না-ও থাকে, তাও যেন গাছগুলো জলের অভাবে মারা না পরে, যেন বাড়ে, যেন শেকড় গজায় বহুদূর অব্দি, যেন ছায়া দেয় ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষকে। এই বসতিতে কিছু লিখে রাখা নিষিদ্ধ। সে তাই এই শিশুদের গল্প শোনায়, যাতে সে না থাকলেও কথাগুলো থেকে যায় শিশুদের মস্তিষ্কে। যেন শিশুগুলো হয়ে ওঠে কিংবদন্তির জলজ্ব্যান্ত বইমানবদের মত, যারা বই পুড়িয়ে ফেলবার যুগে নিজেরাই হয়ে উঠেছিল একেকখানা চলন্ত বই। কাগজ পুড়িয়ে ফেলা যায়, জ্বালিয়ে দেয়া যায় মলাটও। মাটিতে মিশে যায় মৃত মানুষের শরীর। কিন্তু কথাদের কি কখনো মেরে ফেলা যায়? মেরে ফেলতে পেরেছিল কেউ কোনোদিন? মানুষটা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে এক জায়গায়, চোখ বন্ধ করে রেখেছে ধ্যানের মত করে। তার চারপাশে বিশাল ধ্বংসস্তূপ - এটাই তাদের বসতি। সে চেষ্টা করছে মন দিতে, তার নিজের কাজে। কিংবা যেই কাজকে তার নিজের কাজ বলে ভাবতে শেখানো হয়েছে সেই কাজে। কিন্তু একটা ধ্বংসস্তূপে বসে আবার নিজের কাজ হয় নাকি? মানুষটা তাই মন দিতে পারে না, একেবারেই পারে না। বসতির টহলদারেরা মানুষটার দিকে এগিয়ে আসে। তারা জানে এই ধরনের মানুষ বিপদজনক এই ধরনের বারুদের মত মানুষেরা - খুউব বিপদজনক। এরা নিজেরা একলা একলা জ্বলবে না, চারপাশের শুকনো ঘাস-খড়কুটো-ডালপালা সবকিছু নিয়ে জ্বলবে। এরা নিজেরা একলা একলা জ্বলবে না, চারপাশের সব মানুষকে নিয়ে জ্বলবে। তাই এমন বারুদের আভাস পেলেই - তাদের নিভিয়ে দেওয়ার নিয়ম। তাই তারা এগিয়ে যায়, চারপাশ থেকে মানুষটাকে ঘিরে ধরে। মানুষটা প্রস্তুত ছিল, সে অনেক আগেই শুনেছিল এইসব টহলদারের গল্প। সে জানে এই টহলদারদের ভয়। টহলদারেরা বারুদ ধরে নিয়ে যায় কারণ তাদের আগুনে ভয়, আর ভয় - শিরদাঁড়া সোজা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষে। মানুষটা উঠে দাঁড়ায়, তার নিজের কাজ ফেলে। কিংবা যেই কাজকে তার নিজের কাজ বলে ভাবতে শেখানো হয়েছে সেই কাজ ফেলে। উঠে দাঁড়ায় আশেপাশের সব মানুষ - তারাও চোখ বন্ধ করে বসেছিল এতক্ষণ, তারাও আগুন হবার কথা ভাবছিল মনে মনে। একে একে তারা বের করে তাদের লুকোনো বাগান - যে বাগানে লুকিয়ে লুকিয়ে তারাও চারা বুনে আসছিল, যে বাগানে তারাও শিশুদের গল্প শুনিয়ে আসছিল। একদল ভীতু মানুষ হইহই করে ওঠে, এই নিয়ম ভাঙা তাদের ঠিক ধাতে নেই। তবে এত এত আগুন-মানুষের ভীড়ে একসময় তারা চুপ করে যায়। তাদের চুপ করে যেতেই হয়। সূর্যের উত্তাপে স্যাঁতস্যাঁতে মাটি - না শুকিয়ে যাবে কই? হাজার হাজার সূর্য-মানুষ উঠে দাঁড়ায়, টহলদারেরা পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা ভীত হয়ে। বারুদ নিভিয়ে দেয়া তাদের কাজ, সূর্যের তেজ কমাবার উপায় তো তারা জানেনা। সূর্যকে অস্তাচলে পাঠাবার উপায় তো তারা জানেনা। হাজার হাজার সূর্য-মানুষ হেঁটে চলে সামনের দিকে, আজ তারা এই বসতির জঞ্জাল সরাবে। আজ তারা খুঁজে নেবে, বুঝে নেবে - নিজেদের কাজ।
এই বসতিতে কিছু লিখে রাখা নিষিদ্ধ….লাইন টা বার বার মাথায় ঘুরতেসে,সেই সাথে সূর্য-মানুষ শব্দটা!