পিচঢালা রাস্তার গান

(হাসনাইন ইকবাল) 
দুপাশে ঝরে পড়ে আছে কিছু পাখির পালক, কটা পঁচে যাওয়া বেড়ালের দেহ, কয়েকটা মরা মানুষ। আমি হেঁটে যাই মাঝের পিচঢালা দিগন্তবিস্তৃত পথ ধরে। যার কোনো শেষ নেই। অনন্তকাল যে চলেছে দুধারের এই জঞ্জালাদি ধারণ করে।
রাস্তার পাশে বিবস্ত্র মানুষ, যাদের দেহে প্রাণ আছে, তাদের খাবার জোটেনা; যাদের দেহে প্রাণ নেই তারা শকুনের খাবারও হয়না। কারণ এ পিচঢালা সর্বগ্রাসী পথ একটা শকুনকেও বাঁচতে দেয়নি।
ধ্বংসপ্রায় বাড়িঘর দেখা যায়, যে বাড়ির দেয়ালে দেয়াল একদিন রঙিন ছিল আলোয়, উঠোনের গাছটা শরতের সকালে শিউলী ফুলে ভরে যেত। সে বাড়ির চাল নেই আজ, রোদ জল কিছু বাঁধ মানে না। আর, শিউলী ফুলের গাছটা মরে গেছে সস্তা মানুষের মতই।
এ বাড়ির ভেতরে খিদেগুলোর বিস্ফোরণ হয়েছে। বাড়ির জানালায় জানালায় ছিটেফোটা খিদে লেগে আছে তাই। মানুষের খিদে, মাটির খিদে, রংচটা দেয়ালের খিদে। খাবার নিয়ে গেছে পিশাচে।
সামনে এগোলে দেখা যায় এক শিশুর নিথর শরীর, তাকে ধরে এক মৃত দাদুভাই গল্প শোনায় সমানে। দূরে দেখা যায় এক বড়সড় লোক খুঁটির গায়ে বাধা, মাথা ঝুলে আছে, বিচ্ছিন্ন কিনা বুঝে ওঠা দায়। তারই পাশে এক বিবস্ত্র রমণী, যৌবন যার রক্তে রক্তে ভেজা। শরীর ভেসে গেল রাস্তায়, আর রক্ত ভেসে গড়ালো পাশের নর্দমায়।
যায় আসলো না বেঁচে থাকা পাখিদেরও। সমানে মাথার ওপরে চক্কর কাটে। মাটির কাছে ঘেঁষেনা বিধায় ভয় নেই মৃত্যুর। নিচে মরে থাকে রাস্তাধারের সবাই, বেঁচে থাকে শুধু নর্দমার কীট, রক্ত গিলে গিলে।
আমি হেঁটে যাই অফুরান পথ দিয়ে; দূরে, অসীমের কাছে আলপনা দেখা যায়, সাদা সাদা রঙ, লাল লাল রঙ, ফোয়ারার মত ঝলসায়, দূর থেকে দেখা যায়।
এগিয়ে গেলে হায়, সে সাদা রঙ দেখি কাফনের, লাল হল রক্তের। মানুষে মানুষ মরল, শুধু দাম হল ভক্তের। ভক্ত যারা এ পিশাচঢালা রাস্তার, যারা মাঝ বরাবর এঁকে দেয় দুটো লম্বা লম্বা সাদা দাগ, যে দাগের শেষে তারা নিজেরাই মরে পড়ে থাকবে রাস্তার পাশে, বিবস্ত্র, রক্তাক্ত। এ তারা ভেবেও দেখেনা!
আমি হেঁটে যাই, আমি হেঁটে যাই, পাশে বাকি মৃতপ্রায় মানুষের চিৎকার, ওদের কেউ নেই, প্রকৃতির কেউ নেই। বিধাতা একঘরে হল, তার লেখা বান্ডিল বান্ডিল কাগজ ছিড়ল মানুষে। থেকে গেল এক পিচঢালা রাস্তা আর ছড়ানো গ্যালনে গ্যালন রক্ত।

Loading

Leave a Comment