পিসি মা

ভোরবেলা রোদের তাপে টিনের ঘর গরম হয়ে উঠেছে। মতি মিয়া গা থেকে লেপ সরিয়ে অপরপাশে কাত হয়। কিন্তু এইভাবে আর ঘুম হয়? খাটে উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙে ঘরের চারপাশে তাকায় সে। চারদিকে কেমন ধোয়া ধোয়া। হঠাৎ তার মনে হয় ঘরে আগুন লেগেছে। আগুন! আগুন! না না। আগুন না। রাহেলা রান্না বসিয়েছে, ভাতের ডেকচি থেকে মার উতলে চুলোয় পড়েছে তাই এত ধোয়া। কি কাণ্ড! যদি সত্যিই আগুন লাগে। গতরাতে মিরাজ আলীর বাড়ি থেকে ফেরার সময় সে সোহাগপুর বাজার দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখেছে। মিরাজ আলী এ অঞ্চলের শান্তি কমিটির হেড। তার বিশ্বস্ত চাকর বাকরের বাড়িতে আগুন দেবে কে!

বাড়ির সামনে মতি মিয়া পায়চারী করে। ভাবে আর ভাবে। তার স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা। মিলিটারিরা শালা এত বজ্জাত। কাউকে ছাড়বেনা। দেশে যুদ্ধ! বিপদের সময়। দুটো ভাত খেয়ে সে আবার কাজে যায়। মেম্বার বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই মতিকে দেখতে পায় মিরাজ আলী। কাছে ডাকে, মতি এদিকে আয় একবার।
-কইন সাইব।
-আজকে পিছনের ঘরটা ভাল করে পরিষ্কার করবি। মিলিটারির বড় অফিসার আসতেছেন।
-জ্যা। তয় এক খান কতা কইবার লাইগা আইছি।
-বল।
-বউডার তো আবু অইবো। বাফের বাড়ি যাইতো চায়। আউজ্জা বিহালে রাইক্কা আই? ফরশুদিন আমি আয়োরাম।
-সে তো ভাল কথা। বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপার। রেখে আয়। তবে পরশুর পর এক দিনও দেরী করবিনা।
-জ্যা।
মতি পেছনের ঘরের দিকে যায়। জায়গাটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। ঝাট দিয়ে সব পরিপাটি করে। দুপুরের দিকে আসে মিলিটারি কমান্ডার। গাড়ি ভর্তি লোক নিয়ে আসে সে সাথে। তাদের খাওয়াদাওয়া, সেবা দেবার দায়িত্ব সব মতির। মতি এ বাড়ির পুরনো বিশ্বস্ত চাকর, আল্লাহ্’র নেক বান্দা। তার প্রতি মিরাজ আলীর আস্থার কমতি নেই। মিলিটারী তার সামনেই মিরাজ আলীর সঙ্গে নানান কথাবার্তা বলে। সব শুনে ও সারমর্ম বোঝে, ওরা গ্রামের হিন্দু পাড়া নিয়ে কথা বলছে। আজ রাতেই হিন্দু মেয়েগুলোকে ধরে আনার ব্যবস্থা করা হবে। বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ও শোনে এবং নির্বিকারে কাজ করে। ওর এসবে কি আসে যায়! অবশ্য মেয়েদের কথা উঠতেই ওর বড়বাড়ির কথা মনে পড়ে। পিসিমা’র ডাক মনে পড়ে। পিসিনাকে সবাই কি ভীষণ মানে! এই যে দুর্ধর্ষ রাজাকার মিরাজ আলী, সেও এখনো পিসিমাকে দেখলে আদাব সালাম দেয় বাধ্য ছেলের মতোন। পিসিমা যেন এক মূর্তিমতী দেবী, তার কোনো ভয়ডর নেই। মিশকালো চেহারায় অপূর্ব এক লাবণ্য। খুব অল্পবয়সে পিসিমা’র স্বামী মারা যান। তারপর পিসিমা বাপের বাড়ি চলে আসেন। পিসি তার মৃত ভাইয়ের ছেলেমেয়েদেরকে নিজের সন্তানের মতোন মানুষ করেন। পিসির ভাইয়ের মেয়ে ঝর্ণা, জবা। কি সুন্দরী! দুজনেরই বিয়ে ঠিক হয়েছে কলকাতায়। দেশের গণ্ডগোল না লাগলে এত দিনে বিয়েও হয়ে যেত। আর আছে দুজন ভাতুষ্পুত্র। তারা শহরে থাকতো, মাসখানেক আগেই ভারতে চলে গেছেন। বড় ছেলের স্ত্রী এখানেই থাকেন।

মতিমিয়ার তখন বয়স কম। তার এক বন্ধু ছিল, ছামছু মিয়া। ছামছু মিয়া কিছুদিন ইশকুলে গিয়েছিল। তাই সে কিছু লিখতে পড়তে জানতো।
একদিন সন্ধ্যাবেলা সে বড়বাড়ির লেট্রিনের পথে একটা কাগজ ফেলে আসলো। তাতে লেখা,’ভমরা ফুলের মধু খায়।’ ছামছু এসে ঘটনাটা মতিকে বললো আর লাজুক লাজুক হাসলো। মতি ওর কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে না পেরে ছামছুর দিকে বোকার মতন তাকিয়ে রইলো।
পরদিন মতি গরু নিয়ে বড়বাড়ির মণ্ডপের সামনের মাঠে গেছে, সাথে গেছে ছামছু। পিসীমা বাড়ির সামনে অড়হরের গাছ পুতছিলেন৷ ছামছুকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘কিরে ছামছু, ভমরা ফুলের মধু খায় ভালা কতা। কিন্তু ভমরা গু খাইতে গেসিল কেরে?’
মতি পিসিমার সামনে বেয়াদবী হয়ে যাবে ভেবে হাসি আটকানোর প্রাণপণে চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয়না। হেসে গড়াগড়ি খায় মাটিতে।
সেও বহুদিন আগেকার কথা। সুন্দর দিনগুলো ছিল তখন। ঝর্ণা আর জবা ওকে মতি ভাই ডাকে। আজ তাদের সর্বনাশের পরিকল্পনা হচ্ছে তারই সামনে। তবুও! ওর কী?

মতি তাড়াতাড়ি কাজ শেষে বাড়ি ফেরে। রাহেলা আর জেসমিন সব ব্যাগ বোচকা বেঁধে ফেলেছে। অন্ধকার প্রায় হয়ে এসেছে, ওদের যাবার সময় হয়ে এলো। ওরা বাড়ির সামনের খালের ঘাটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। একটা বড়ো নৌকা এসে দাঁড়ায় ঘাটে। মাঝির গায়ে একটা শাল জড়ানো। শীত পড়েছে ভালোই। ওরা ধীরে ধীরে উঠে পড়ে নৌকায়। শিউলী এসে কোলে ওঠে ওর। ফিসফিস করে ওর কানে কানে বলে,’মতি কাকা, দেশে যুদ্ধ লাগছে যুদ্ধ। আমরা কই যাই জানো? ইন্ডিয়া!’ নৌকার ছইয়ের ভেতর বসে আছে পিসিমার ভাইয়ের পুত্রবধু, বড়বাড়ির বড়বৌ, সৌদামিনী বৌদি। তার স্ত্রীর মতোন সেও পোয়াতি। শিউলী তারই মেয়ে। তার ছোট মেয়ে বকুল মায়ের পাশে ঘুমায়। কি সুন্দর ফুটফুটে চেহারা দুটি মেয়ের। ঝর্ণা আর জবা বৌদির বিপরীত পাশে বসে ফিসফিস করছিলো, মতির বৌকে দেখে ওরা জায়গা করে দেয়। মাঝি বিড়ি ধরায়। নৌকা চলতে থাকে। নৌকা গ্রামের মাথায় আসতেই সবার বুক ঢিপঢিপ করে। অন্ধকারে পুরনো লণ্ঠনের আলোয় মাঝি আর মতি মিয়ার মুখ ঝাপসা দেখতে পায় মিরাজ আলীর ছেলে। মতিমিয়ার যাওয়ার কথা ছিল আজ সে জানে।। ওরা ওকে যেতে দেয়।
মাঝি নরসুন্দায় এসে চাদর খুলে মিষ্টি নারীকণ্ঠে গান ধরে, বনমালী গো….
চাঁদ উঠেছে।
চাঁদের আলোয় কি সুন্দর দেখায় পিসিমার মুখ।

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, সরকারি মহিলা কলেজ, কিশোরগঞ্জ। 

Loading

2 thoughts on “পিসি মা”

Leave a Reply to Agastha Cancel reply