ছায়া কাহিনী

যেদিন স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমার ছায়াটা আমাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমার সঙ্গ ছেড়ে চলে গেল তখন কিছু একটা ঘটে গেল । কি সুন্দরভাবে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে চলে গেল! কিছু ফার্ন আর ছোটোখাটো উদ্ভিদের পাশে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম, মূর্তির মতো। অতিমানবীয় অক্ষমতা আমাকে পুরোমাত্রায় গ্রাস করেছিল। আমার সামনে দিয়ে ছায়াটা হেঁটে চলে গেল কিছুই করতে পারলাম না আমি। এমনকি চেষ্টাটাও করার সুযোগ পেলাম না। কেবল কিছু হতাশার দেয়াল আবির্ভূত হল চারপাশে। আমার দিকে ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে রইল। মনে হল ছায়াহীন আমার লজ্জায় হাসছে। আমি মাথা নিচু করেছিলাম, লজ্জায়, বেদনায়। তারা তবু তাকিয়েছিল। সেই থেকে আমার ছায়াহীন জীবনের সূচনা।

প্রথমে ভেবেছিলাম ছায়াহীন জীবনে এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যাব। ভাবনা পর্যন্তই। দেখা গেল মধ্যরাতে ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে উঠি, হাতড়ে হাতড়ে আমার অতি পরিচিত ছায়াটা খুঁজি। মাঝে মাঝে কি যেন দেখতে পাই। চমকে উঠি। পরবর্তীতে তা কেবল হৃদয় বেদনাই বাড়িয়ে দেয়। আমার কাজ শেষ হয় না। আমার চির অসমাপ্ত কাজ , খুঁজতে থাকা। একসময় ছায়াহীন নগ্নতাকে ঢাকার চেষ্টায় রত হলাম। এহেন চেষ্টা নেই যা করলাম না। সফলকাম হওয়া তবু সম্ভব হল না। উন্মত্ত নগ্নতা ক্ষণে ক্ষণে তীব্র উল্লাসে হর্ষধ্বনিতে লিপ্ত হয়। সাথে সাথে লজ্জারা এসে জড়ো। নিজেদের অস্তিত্বে নিজেরাই ছি ছি করে। অনেক কষ্টে মুখ লুকাই। লুকানোর ঠাই কেউ দেয় না। পাক পবিত্র হয়ে প্রার্থনায় বসি। “হে! আল্লাহ, আমার অস্তিত্বের প্রতীক, আমার চিরসুন্দর অভিমানী ছায়া আমাকে ফিরিয়ে দেও।”
কণ্ঠস্বর করুণ হয়ে আসে। গলা ভেঙ্গে যায়। এক সময় ফিস ফিস শব্দ বের হয়। নিজের কথা নিজেরই শুনতে কষ্ট হয়। তবে উচ্চ কণ্ঠের আড়ালে স্তব্ধ ইচ্ছের তুলনায়, ফিস ফিস কণ্ঠে তীব্র ইচ্ছা অনেকটাই শ্রেয়।
কিছুদিন নিজেকে ঘরবন্দি করি। শ্বেত-শুভ্র কামরাটায়। চোখের গোলকটা মনের অজান্তেই ঘোরাফেরা করে। পিপাসার্ত চোখে খুঁজে বেরায় একটা কালো রঙের অবয়ব! হতাশা চক্ষুগোলকের মাঝ থেকে জল হয়ে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসাই তো ভালো। কিছুক্ষণ যায়, আবার সেই হতাশাগ্রস্ত অশ্রু তৈরির প্রক্রিয়া চলে গহীনে।
বেশিদিন ঘরবন্দি হয়ে থাকা সম্ভব হল না। একসময় ঠিকই নগ্নতার চাদরে নিজেকে ঢেকে সবার সামনে উপস্থিত হতে হল। কাঁপা কাঁপা পায়ে আমি পথ চলা শুরু করলাম। চারপাশে বার বার তাকাই। কি সুন্দর মানুষের জীবন। সবাই পাশাপাশি একজন সঙ্গীকে নিয়ে চলছে। সেই সঙ্গী অপার্থিব! পার্থিবতার নোংরামি তাদের ছুঁয়ে যেতে পারে না। আমি যেন কেবল একা। নাহ মাঝে মাঝে আমার মতো কয়েকজন কে পেয়ে যাই। লজ্জায় যেন কুঁকড়ে আছে একেকজন। আমার দিকে কেউ কেউ তাকিয়ে থাকে। তাদের চোখ কেমন জানি জ্বলে ওঠে। ঠোঁট নড়ে ওঠে। কিন্তু তারা কিছু বলে যায়। তবে রেখে যায় কিছু বিচ্ছিরি অবয়বের দৃষ্টি। চুইঙ্গামের মতো তারা আমার পেছনে লেগে থাকে। সেই আঠালো ভাব দূর হতে সময় নেয়। আমি যেন পথভ্রষ্ট, ছায়াদেবতার খোঁজে পারি দিচ্ছি পথ।
আমি যখন তখন সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এ যে অসম্ভব! আমার সেই অভিমানী ছায়াটাকে ভুলে যাওয়া যেমন ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়াই ভুলে যাওয়া! আমার আশেপাশে ভাবনা মাকড়শারা জাল বুনে চলে। হাঁপাতে হাঁপাতে মাকড়শার জাল কাটতে উদ্যত হই। কি আশ্চর্য! হাত এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। জাল থেকে যায় অক্ষত। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আরেকবার হাত চালাই, কখনও দেখা যায় জাল আর খুঁজে পাই না। বোঝা যায় জালগুলোর বাস্তব কোনও অস্তিত্ব আদৌ ছিল না। এগুলো কেবলি আমার চোখের কোণে তৈরি হয়েছিল ।
কিছুদিন বাসে ওঠা ছেড়ে দিয়েছিলাম। লজ্জা ঢাকার এক প্রক্রিয়া। তবে পুনরায় বাসে ফিরে আসতে হল। লোকজনে ভরপুর দেখে একটা বাসে উঠে যাই । কাউকে দেখার সময় যেখানে কারো থাকে না। হয়ত জানালার দিকে মুখে ফিরিয়ে আনমনা ভাব নিয়ে বসে থাকি। না হয় ছদ্মবেশী পকেটমারদের ভিড়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মাঝে মাঝে পকেট কাটা পড়ে। আমার তেমন খারাপ লাগে না। যেখানে ছায়া হারিয়ে ফেললাম সেখানে এই সামান্য কারণে মন দূষিত করে কি লাভ! হ্যাঁ! মন তখন দূষিত হয়, যখন কেউ কেউ আমার দিকে নিবিড় চোখে তাকায়। তার চোখ জ্বলে ওঠে। একসময় লজ্জাময় হীন এক আচরণ করে। চোখে মুখে কৌতুকময় ঘৃণা ফুটে ওঠে। হয়ত তার অজান্তেই ঠোঁট বেঁকে যায়। তখন আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করি। একসময় বিপরীত মানুষটাও অন্যদিকে মনোযোগ দেয়। কিন্তু তার সেই দৃষ্টি আমাকে গুঁতোগুঁতি শুরু করে। সেই যন্ত্রণা মুখ চেপে সহ্য করি। ক্ষীণ আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে গিয়েও বের হয় না। হৃদয়ের কোনো এক কোণে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। একসময় বংশবিস্তার করে। আমি কিছুই করতে সক্ষম হই না। কেবল আরও কিছু আর্তনাদের উৎপাদক হিসেবে কাজ করি। দিন দিন আমার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। একলা একলা পড়ে থাকি। খাওয়া-দাওয়া মুখে রুচে না। অন্ধকারের সাথেই কথা বলতে ভালো লাগে। ভালো লাগে নির্জনতার সাথে বসে থাকতে।

বন্ধুদের আমার দূর অবস্থার কথা বলেছি। কেউ কেউ হা হুতাশ করে! কেউ কেউ নিজের কাহিনী শোনায়! কেউ আবার বলে, দোস্ত ঠিক হয়ে যাবে এতো চিন্তা করিস না। আহা ! কত সহজেই না বলে দেওয়া যায়! সেদিন বাইরে বেরুতে যাব, হঠাৎ কিছু ছদ্মবেশী ছায়া আমার পথ রোধ করল। আমি হন্যে হয়ে আমার নিজের ছায়াকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু ছায়ার যে কোনো চেহারা নেই, রঙ নেই! কিভাবে সেই ঘন কালো অবয়বকে চিনি! আমার চোখ দুটোর অস্থিরতা দেখে ছায়াগুলো হাসতে শুরু করল ।

আমার খুব রাগ হতে লাগল! ইচ্ছে হল দু একটা ঘা বসিয়ে দিই তাদেরকে। কিন্তু সুপ্ত ভয় মনে নাড়া দিয়ে উঠে। কি জানি আমার নিজের ছায়াকে আঘাত দিয়ে দিই! সেটা বড়ই দুঃখজনক হব! ভয়ে ভয়ে তাই দূরে সরে যেতে লাগলাম। তারা আমার পদক্ষেপে সচকিত হল।

আমি ভয়ে ভয়ে পেছনে যাচ্ছি। তারা হিংস্র জন্তুর মতো আমার দিকে এগুতে লাগল। যেকোনো সময় অসহায় আমাকে তীব্র আঘাত করবে তারা। আমি নিরুপায় হয় চোখ বন্ধ করতে গেলাম। ঠিক তখন কি যেন একটা ঘটে গেল! যেমন ঘটেছিলো আমার ছায়াটা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়। হুটহাট করে ক্ষুদ্র ঝড়ের মতন করে কালো অবয়বটা ঘরে প্রবেশ করে। বিশাল হাতে আমাকে ঘিরে দাঁড়ায়। ছদ্মবেশী ছায়াগুলো অপ্রতিভ হয়ে ওঠে। তাদের নিজ গোত্রের কাউকে তারা আঘাত করবে না।

তারা পিছু হটতে থাকে। আমার ছায়া আমার দিকে তাকানোর মতো ইচ্ছে পোষণ করল না। চুপচাপ কাছে এসে দাঁড়ালো। তার আগমনে আমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়েও করলাম না। যদি বিরক্ত হয়! তাকে নিরবে আশ্রয় দেই।

এখন আর আমি তেমন ভয় পাই না। ছায়ার পালিয়ে যাবার ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি না , তার যা ইচ্ছা করবে। তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে !

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ।

Loading

Leave a Comment