মেজেন্ডা রঙের পরিচয়

আমি কি অসুস্থ? প্রশ্নটা এই পর্যন্ত অনেক জনকে করা হয়ে গেছে। একজন ছাড়া কেউই উত্তর দেয় নি। একমাত্র উত্তরদাতা বলেছে, ‘এই কথা এখন জিজ্ঞেস করছিস? তোকে প্রথম দেখেই বলেছিলাম তুই অসুস্থ!’ বলেই হাসতে লাগল। হঠাত থেমে গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল, ‘Actually it’s not the word I should use.’
– কি বলতে চাচ্ছিস?
– অসুস্থ না, তুই পাগল!
বলেই আবার খিল খিল হাসি। সবসময় এই রসিকতা উপভোগ করি। তখন পারলাম না। উঠে চলে আসলাম। আমার উঠে চলে আসা তাকে প্রভাবিত করল না। যথেষ্ট দূরত্ব পেরোনোর আগ পর্যন্ত তার হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। প্রশ্নটা নিজেকে করলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বরাবরের মতো উত্তর না পেয়ে ভাবলাম বাসায় যাব। রিকশা দরকার। হঠাৎ একটা রিকশা এসে সামনে দাঁড়াল। চালক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই যাইবেন মামা?’ বলে দাঁত বের করে হাসলেন। সৌজন্যমুলক হাসি নিশ্চয়ই। আমিও হাসার চেষ্টা করলাম। রিকশায় উঠে বললাম, ‘বাসায় যাব’। এখান থেকে আমার বাসা পর্যন্ত রিকশায় যেতে কমপক্ষে চল্লিশ টাকা লাগে। আমার কাছে পুরোটা নেই। চালককে বললাম, ‘আপনার কাছে দশ-পনেরো টাকা হবে না? আমার কাছে পুরোটা নেই।’ উত্তরে হাসি শুনতে পেলাম।
বাসার সামনে রিকশা থামল। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চালক অপেক্ষা করলেন না। ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন উল্টোদিকে। ভাড়া নিতেও আগ্রহ বোধ করলেন না। আমিও ভ্রূক্ষেপ না করে লিফটে উঠলাম। সেখানে দেখা এক ভদ্র মহিলার সাথে, নাম জানি না। নতুন উঠেছেন আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই। লিফটে সারাক্ষণ আমার স্বাস্থ্য নিয়ে তার হতাশার কথা জানালেন। এসব কথা বেশিরভাগ সময় শুনতে ভালো লাগে না। কিন্তু এই মহিলা মারাত্মক সুন্দর করে কথা বলেন। মন্ত্রমুগ্ধ বা এর কাছাকাছি কোনো অবস্থায় তার কথা শুনলাম।

ডাইনিং টেবিলে একটা চিরকুট রাখা ছিল। তাতে লেখা, “সকালে খেয়ে যাও নি। কোথায় চলে গেলে তাও জানি না। দেখলাম ওয়ালেট-ফোন কিছুই নাওনি সাথে। বাসায় এসে অবশ্যই আমাকে ফোন করবে। খাবার আছে ফ্রিজে। এক্ষুনি খেয়ে নিবে। আমি চিটাগং যাচ্ছি। পরশু ফিরব। ভালোবাসি।”

আমার মা। ফোন দিতে বলেছেন। খাবার ওভেনে দিয়ে ফোন আনার জন্য আমার রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকতেই আবার ঐ রাতের কথা মনে পরল। তিনি বলেছিলেন সবার কাছে চাইলে কথাটা শেয়ার করা যেতে পারে। কথাটা ওকে বলা উচিত। তখন কিছু না বলে এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। এভাবে হঠাৎ করেই ওর চিন্তায় আচ্ছন্ন হলাম। পাখি ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। থেমে থেমে। শব্দ কি আমার মাথার ভিতর হচ্ছে? শুনেছি প্রেমে পরলে মানষের অদ্ভূত সব অভিজ্ঞতা হয়। আমারও সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা হচ্ছে মনে হয়। প্রেমে পরেছি ভেবে আনন্দ বোধ করলাম।
ওর সাথে দেখা করাটা জরুরি। ক্যাম্পাসে গেলে দেখা হতে পারে। দরজার দিকে রওনা হলাম। একবারও মাথায় আসলো না যে একটা ফোন করে নিলেই হয়। দরজা খুলেই দেখি ও দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেও কলিং বেল চাপল। কলিং বেলের টিউন বদলানো হয়েছে। পাখির শব্দ শোনার রহস্য উন্মোচিত হল। হতাশ স্বরে বললাম, ‘ভেবেছিলাম তোর প্রেমে পরেছি।’ তার ভাবান্তর হল না। ও বলল, ‘বাসায় চলে আসলি কেন? আর এতক্ষণ ধরে বেল চাপছি!’
– কিভাবে বুঝলি আমি বাসায়?
– সালাম মামা বলল।
সালাম মামা, আমাদের বাসার নিচেই চা বিক্রি করত। বন্ধুরা মিলে সেখানে চা খেতাম। অনেক দিন হল তাকে দেখি না।
– মনে নেই সালাম মামার কথা? এখন রিকশা চালায়। বলল তোকে নাকি বাসায় নামিয়ে দিয়েছে মাত্র। আমাকেও নিয়ে এল। এত জোরাজুরির পরও টাকা নিল না।
– ও আচ্ছা।
– চল। সবাই বসে আছে। আজ তোর খাওয়ানোর কথা। বুঝি সব। এর জন্যই চলে এলি লুকিয়ে।
– চল।
ওর সাথে রওনা হলাম। ফোন-ওয়ালেটের কথা এবারো ভুললাম। বাসায় ফিরতে রাত নয়টা বাজল। তিনবার কলিং বেল চাপার পর মনে পরল যে বাসায় কেউ নেই। আমি একা। দরজা লক করেও যাইনি। আমার ঘরে ঢুকে ফোনটা হাতে নিলাম। ২৬ টা মিসড কল। সবগুলো মার কাছ থেকে। তাকে ফোন দেওয়ার কথা ছিল। মনে নেই। শেষ মিসড কল ৮ টা ১৭ তে। এখন মাকে ফোন করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুয়ে পরলাম। শুয়ার প্রায় সাথে সাথেই ঘুম। ঘুম ভাঙলো ২ টার পরে। উঠে আমার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল আমি কোথায় তা বুঝতে। ঘর খুবই অন্ধকার। এতই অন্ধকার যে আমি তাকিয়ে আছি না চোখ বুজে আছি বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু এটা খুব বুঝতে পারছি্লাম যে তিনি আশেপাশেই কোথাও আছেন।
-‘আপনি কি আছেন?’ জিজ্ঞেস করলাম।
– তোমার মা খুব চিন্তা করছিলেন।
– হু।
– তোমার মা খুব চিন্তা করছিলেন।
– জ্বী বুঝতে পেরেছি।
– বুঝতে পেরেছো?
– আপনি বলেছিলেন আপনি সব বুঝতে পারেন। আমি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি কিনা তা তো আপনার বুঝার কথা।
– আমি সব বুঝতে পারি না।
– পারেন না?
– না।
– আচ্ছা আমি এখন ঘুমাব। তারপর কোনো সাড়া পেলাম না। তার সাথে পরিচয়, এক সপ্তাহ হয়েছে। পরিচয় হয়েছে বললে ভুল হবে। তার নাম জানি না। তাকে এখন পর্যন্ত দেখতেও পাইনি। শুধু কথা হয়েছে। প্রথম দিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। মার সাথে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে এসে শুয়েছি। তিনি বললেন, ‘তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?’ কথাটা এতই স্পষ্ট যে মনে হল তা আমার মাথার ভিতর থেকে আসছে। খুব ভয় পেলাম। কিছুই বলতে পারলাম না। তিনিও আর কিছু বলেন নি। ‘তার’ থেকে হঠাৎ চিন্তা মুর ঘুরল ‘ও’র দিকে। ওর কথা খুব মনে পরছে। ফোন দেওয়া যায়। সেইসাথে নিজেকে প্রশ্নও করলাম, এখন কি ফোন দেওয়া ঠিক হবে? দেব না দেব না ভেবেও ফোন দিলাম।
– হ্যালো, ঘুমিয়ে পড়েছিস?
– না।
– এখনো ঘুমাসনি? কি করছিলি?
– ফোন করেছিস কেন?
– না এমনি।
– ফোন রাখ।
‘ফোন রাখ’ বলে আর অপেক্ষা করল না, কেটে দিল। ও এমনই। সবার সাথেই এমন। তবু ওর এসব আচরণ আমাকে খুব কষ্ট দেয়। মাঝে মাঝে নিজের উপরেও রাগ হয়। এত বেশী আশা করার কিছু নেই। তাও আশা করে বসে থাকি। কেন করি? ভালোবাসি? তাই হবে হয়ত। আজকে ওকে বললাম আমার কারো একজনের সাথে কথা হয়। ও হাসল খুব। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। অন্যদের সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে পরল। যেমন আমার কথা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছুনা। কিন্তু আড্ডার সময় ও বেছে বেছে আমার পাশে এসেই বসবে। স্বভাবমতো হাসতে হাসতে আমার উপরেই গড়িয়ে পরবে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পরলাম।

ক্যানটিনে বসে কফি খাচ্ছিলাম। মন এতটা ভালো না। সকাল থেকে ও আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। আশেপাশেই হাঁটছে, কিন্তু আমার কাছে আসছে না। ওকে পাগলের মত দেখাচ্ছে। কফি শেষ, আরেকটা অর্ডার দিলাম। হঠাৎ ও এসে বসল পাশে। লক্ষ্য করলাম ওকে সত্যিই পাগলের মতো লাগছে। এসে অন্য কিছু না বলে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি অসুস্থ?’ ওর দিকে তাকালাম ভালোভাবে। ও খুব সিরিয়াস মুডে তাকিয়ে আছে, উত্তরের অপেক্ষায়। আমি হেসে বললাম, ‘এই কথা এখন জিজ্ঞেস করছিস? তোকে প্রথম দেখেই বলেছিলাম তুই অসুস্থ!’ ও কথাটা শুনে কষ্ট পেল মনে হল। আমি বললাম, ‘Actually it’s not the word I should use.’ – কি বলতে চাচ্ছিস? – অসুস্থ না, তুই পাগল। এই কথা শুনে ও এমন ভাবে তাকাল যে না হেসে পারলাম না। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরলাম। ও খুব রাগ করল বোধয়। কিছু না বলেই উঠে চলে গেল। কফি শেষ করে বের হলাম ক্যান্টিন থেকে। ক্যাম্পাসে ওকে দেখতে পেলাম না। কেউ ওর কথা বলতেও পারল না। রাস্তায় এসেই সালাম মামার সাথে দেখা। সে এখন রিকশা চালায়। আগে চা বিক্রি করত। অনেক কথা হল মামার সাথে। বলল ওকে নাকি মাত্র বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসেছে। বেচারা রাগ করেছে আমার উপর। ওকে ওর বাসা থেকে নিয়ে আসলাম। রিকশায় আমার সাথে ও একটা কথাও বলল না। আমিও বললাম না। আমার কথা না বলার কারণ ছিল। তখন একটা কথাই আমার মাথায় ঘুরছিল। ওর বাসার দরজা খুলে প্রথমেই বলল, ‘ভেবেছিলাম তোর প্রেমে পড়েছি।’ মজা করেছে নিশ্চয়ই। ও এমনই। প্রায়ই এমন অদ্ভূত সব কথা বলে। ক্যানটিনে এসে হল আরেক ঘটনা। আজ ওর সবাইকে খাওয়ানোর কথা ছিল। খাওয়ার পর দেখা গেল ও ওয়ালেট আনে নি। শেষমেষ সবাই মিলে বিল দিলাম। সবাই এক হাত নিচ্ছিল ওর উপর। ও নির্বিকার। তখন কিছু খায়ওনি। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবসময় খুব মাতামাতি করলেও ওর সমস্যার কথা কাউকে বলতে চায় না। নিজের উপর রাগ হল খুব। আজ কি যেন বলতে চাচ্ছিল আমাকে। অদ্ভূত কথা। কে নাকি ওর সাথে কথা বলে। আমি হেসে উরিয়ে দিলাম। এটা ঠিক হয়নি একদম। বাসায় গেলাম রাত নয়টার কিছুক্ষণ আগে। এসেই ঘুমিয়ে পরলাম। ১২ টার দিকে ঘুম ভেঙেও গেল। বাড়ি ফেরার আগে ও আমাকে বলতে চেয়েছিল কিছু একটা। ফোন চেক করলাম। না, ও ফোন দেয় নি। রাগটা নিজের উপর থেকে ওর উপরে গেল। একটা বই নিলাম। রাত হয়েছিল অনেক, ভুলেও ভাবিনি ও ফোন করবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও ফোন করল। ফোন ধরলাম। কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছা করল না। বলতে গেলে ওর মুখের উপরেই ফোনটা রেখে দিলাম। কেন এমন করলাম বুঝলাম না। আমিও নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাচ্ছি।

তিনি প্রতিদিন রাতের বেলায় আসতেন। কথা বলতেন। দিনের বেলায় আসেন নি আগে। আজই প্রথম। বরাবরের মতো শুরু করলেন, ‘শুনতে পাচ্ছ?’ কথা টা দিয়ে। এখন আর চমকে উঠি না। মানুষ খুব অদ্ভুত। যা ঘটছে আমার সাথে তা মোটেও স্বাভাবিক না। কিন্তু আমার কাছে এখন তা মোটেও অস্বাভাবিক লাগছে না। –
শুনতে পাচ্ছ?
– হু।
– তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ?
– জ্বী। আমি শুনতে পাচ্ছি। আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
– তোমরা অনেক বোকা।
– আমরা মানে? কারা বোকা?
– মানুষরা অনেক বোকা।
– আপনার পরিচয় দিন। আপনি কে? অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। আপনি কিছু বলেন না। আপনি কি মানুষ?
– তোমরা জান না তোমরা কী।
– সত্যিই জানি না। আপনি দয়া করে জানান।
– তা আমি বলব না।
– কেন বলবেন না?
– আমি বলব না।
– আচ্ছা আপনার পরিচয় দিন। আপনার নাম কি?
– ……
– বলুন। আপনার নাম কী?
– তুমি খুবই সাহসী।
– কিভাবে বুঝলেন?
– তোমাদের মধ্যে কেউ আমার সাথে কথা বলতে পারেনি। তারা ভয় পেয়েছে।
– কারা ভয় পেয়েছে।
– অন্য মানুষ।
– কেউই সাহস করে নি?
– আমার সাথে কেউ না।
– আচ্ছা, আপনি দয়া করে আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আপনি কে?
– সৃষ্টি।
– কার সৃষ্টি?
– ……
–কার সৃষ্টি? বলুন।
– তিনি তোমাদের বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন।
– ঈশ্বরের কথা বলছেন?
– তোমাদের কিছু কাজ আমরা বুঝি না।
– যেমন?
– কিছু কাজ আমরা বুঝি না।
– আপনারা কারা? আপনি কে?
– ………
– আপনি কি জ্বীন?
– ………
প্রশ্নটা করে আমার হাসি পেল। আমি কার সাথে কথা বলছি? অবচেতন মন? তা হওয়ার সম্ভবনা কম। আমি সত্যিই অসুস্থ হয়ে পরছি। ফোন বেজে উঠল। মা ফোন করছে। ধরতে ইচ্ছা করল না। ফোন বেজেই চলেছে। একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম “I’m busy. Can’t talk now.”
– শুনতে পাচ্ছ?
এবার আমি কিছু বললাম না। কিন্তু তাতে তাকে চিন্তিত মনে হল না। তিনি বললেন, ‘তোমার মা খুব চিন্তা করছেন।’
– জানি।
– তোমাদের কিছু জিনিস আমরা বুঝিনা।
– কি বলুন তো?
– তোমরা অনেক সময় নিশ্চুপ থাক। কোনো কাজ কর না।
– হ্যাঁ তা করি। কি বুঝতে পারেননি বলুন।
– তখন তোমরা ঘুমাও না। তেমন নাড়াচাড়াও কর না।
– আপনি কি বুঝতে পারেননি বলুন।
– তোমরা তখন কি কর?
– তা তো বলা মুশকিল।
– কি কর?
– দেখুন, সবার কথা জানি না। কিন্তু ওরকম সময় আমি চিন্তা করি।
– কি কর?
– বললাম তো, চিন্তা করি।
– ………
– আপনি কি আছেন?
– ………
– আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
– কিভাবে চিন্তা কর?
– আগে আমাকে একটা কথা বলুন।
– কিভাবে চিন্তা কর?
– আমার একটা প্রশ্নের জবাব আগে দিন।
– ………
– আপনি আমাকেই কেন বেছে নিলেন?
– ………
– কেন?
– তুমি চিন্তা করতে পার।
– তা তো সবাই পারে।
– কিভাবে চিন্তা কর?
– দেখুন, তা বলা মুশকিল।
– আমাদের শিখাও।
– মানে?
– আমাদের শিখাও।
– আপনারা চিন্তা করতে পারেন না?
– আমাদের শিখাও।
– আমি শিখাতে পারব না। আমি জানি না কিভাবে শিখাতে হয়।
– আমাদের সাথে এস। আমাদের শিখাও।
– কোথায় আসব?
– আমাদের সাথে এস।
– আচ্ছা চলুন। বলুন কোথায় যাব।
– ………
– আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন।
– আমার সাথে চল।
– কোথায় যাব?
– যাবে? –
যাব। কিন্তু কোথায় যাব?
– ………
– আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
উনি কিছু বললেন না। কিন্তু তখন অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটল। আমি কিছু দৃশ্য দেখলাম। স্মৃতির মতো দৃশ্য। অনেকটা স্বপ্ন দেখার মত। একটি দৃশ্যে দেখলাম প্রচুর আলো। তাতে আমি ভালো করে তাকাতে পারছি না। কিছুই বুঝলাম না। তারপর আমার বাবাকে দেখলাম। মনে হল আমি তার কোলে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, আর কি যেন বললেন। আমার বাবকে আমি শুধু ছবিতেই দেখেছি। আমি ছোট থাকতেই তিনি মারা গেছেন। আরো কিছু দৃশ্য দেখার পর নিশ্চিত হলাম এগুলো আমার স্মৃতি। সব এখন মনে পরছে। আমার শরীর হালকা হতে শুরু করল। মনে হল আমি কোথাও তলিয়ে যাচ্ছি। এক অদ্ভূত প্রশান্তি আচ্ছন্ন করল আমাকে। মনে হল, আমি কোনো কিছুর গভীরে যাচ্ছি। যাচ্ছি, আরো যাচ্ছি। হঠাৎ সব থেমে গেল। আমি তখন কোথায় জানি না। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিছু শুনতেও পাচ্ছি না। আমার শরীরের কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু আমি আছি। অদ্ভূত একটা অনুভূতি হচ্ছে। হঠাৎ আমার মনে হল আমি এখন সব জানি! আমি আসলে কে, আমার কাজ কী, এখন আমি জানি!

গাড়ি এসে থামল বাসার সামনে। তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। লিফটে উঠার আগে দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলেন তার ছেলে কি বাইরে নাকি বাসায়ই আছে। উত্তর পেলেন তার ছেলে বাসায়ই আছে। এখন তিনি তার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনবার কলিং বেল চেপেছেন, পাখি ডাকার শব্দ হচ্ছে। কলিং বেলের এই টিঊন টা তার খুব পছন্দ। আগে তাদের কলিং বেলের টিউন ছিল অন্যরকম। ঢং ঢং আওয়াজ করত। তিনিই নতুন টিউনের কলিং বেল লাগানোর ব্যাবস্থা করেছেন। আবার বেল চাপা হল। তার ছেলে দরজা খুলছে না। দুপুর হয়ে গেছে। তিনি ভোরে রওনা দিয়েছিলেন চিটাগং থেকে। খুব ক্লান্ত। দরজা খোলা হচ্ছে না দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেন। আরো বিরক্ত হলেন এটা দেখে যে দরজা লক করা ছিল না। তিনি লক না করা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। ভিতরে ঢুকেই প্রথম গেলেন ছেলের ঘরে। সে তার খাটে শুয়ে আছে। এই অবেলায় ঘুমুচ্ছে নাকি? তিনি পাশে গিয়ে বসে ছেলের কপালে হাত রাখলেন। হাত রাখার সাথে সাথে শিউরে উঠলেন! শরীর বরফের মত ঠান্ডা। ছেলের হাত ধরলেন, তা শক্ত হয়ে আছে। তিনি এখন কি করবেন বুঝতে পারছেন না।

লেখক: শিক্ষার্থী, কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়

Loading

Leave a Comment