হলুদ প্রশান্তির দিন

আমি ওর ঊরুতে হাত বুলোচ্ছিলাম। এভাবে কেটে যেতে পারতো আরো সহস্র বিকেল। ওর কানের কাছে একটা মদের মত গন্ধ। খুব চেনা মদ। বাবা খেতেন। বাবা যখন মদ খেতেন তখন তাকে খুব সুপুরুষের মতন লাগত। এমনিতে বাবা ছিলেন বাই সাইকেল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালে এমনই মনে হত। বাবা মাঝে মাঝে গান গাইতেন। সে গানের সুর অনেকটা সাইকেলের বেলের মত। একঘেয়ে আর কর্কশ। হাসলে সামনের পাটির দাঁত বেড়িয়ে আসতো অনেকখানি। আমার সেই বাবা এক ভর দুপুরে মারা গেলেন। বাবা সাইকেলের মতই মারা গেলেন। হোঁচট খেয়ে মাথা মটকে পড়ে থাকেন পুকুর পাড়ে। অনেকে বাবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। কেউ লক্ষ্য করলেন না, মৃত এক ভদ্রলোক উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। সবার আগে বুঝতে পারল এক ছিচকে চোর। সে বাবার মানিব্যাগ হাতিয়ে নিতে চাচ্ছিল। মানিব্যাগ হাতে নিতেই সে দেখল, বাবা মরে পড়ে আছে, মানিব্যাগের গা বেয়ে ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে।

বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় ওদিন থেকে জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আর কী।
তারও আগের কথা। অফুরন্ত বাতাসের ভেতরে আমার বাবা দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে আমি, ছোট আর চঞ্চল। বাবা আমাকে ছোট্ট ভালুক ডাকতেন। বলতেন আমি নাকি ভালুকের মত ঘুমুই। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতাম, চোখ দিয়ে জানতে চাইতাম, ভালুকের মত ঘুম জিনিসটা কি? তিনি হাসতেন। এখন মনে হয়, তিনি হাসতেন কোনো এক সম্রাটের মত বা দার্শনিকের মত। আমার বাবা, একই সাথে একজন সম্রাট, দার্শনিক আর বাই সাইকেল। তাঁর পিঠে চড়ে আমি এই মনোরম শহুরে বাতাসে ঘুরে ঘুরে বড় হয়েছি। আমার সেই বাবা সেদিন আমার হাত ধরে হাঁটছিলেন। ছোট আর চঞ্চল আমি, কি শান্ত আর নিবিড় হয়ে দেখছিলাম বাবাকে। সম্ভবত বাবা একটা গান ধরেছিলেন। সেই অফুরন্ত বাতাসে বাবার আনকোরা গলা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আমার সেই বাবা গাইতে গাইতে সেই অফুরন্ত বাতাসের মাঝে লুটিয়ে পড়লেন। বাবা সেদিন মারা গেলেন। কিন্তু কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারল না। লক্ষ্যই করল না। এমনকি আমিও না। বাবার হাত ধরে আমি সেদিন অনেকটা পথ হেঁটেছি। আরও অনেকদিন পর, এরকম এক অফুরন্ত বাতাসের দিনে আমি বুঝতে পারি, বাবা মরে পড়ে আছেন মুখ থুবড়ে।
হয়ত সেদিন থেকেই বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আর কী।
আমি আমার বাবার নাম জানতাম না। ক্লাসে টিচার জিজ্ঞেস করলে হা করে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। রাস্তায় লোকে জিজ্ঞেস করলে মুখ টিপে হাসতাম। আমার বাবা, আমাকে কখনো তাঁর নাম বলেন নি। আমিও কিভাবে যেন একটা মানুষের সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়ে গেলাম বছরের পর বছর, যাঁর নাম পর্যন্ত আমি জানিনা। বাবার কোনো বন্ধু ছিলনা। দুধওয়ালা বাবাকে ডাকতো সাহেব বলে। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক, যাঁর ছেলে এখন বিরাট বড় ইঞ্জিনিয়ার, তিনি বাবাকে ডাকতেন মশাই বলে। বাবা বলতেন, তাঁর অফিসের বস, মাঝেমাঝে তাকে স্টুপিড বলে ডাকতেন। আর আমি ডাকতাম বাবা বলে। আমার সেই বাবা, যিনি আমাকে কোনোদিন তার নাম পর্যন্ত বলেননি, একদিন আমার সামনে অনর্গল বলতে লাগলেন তাঁর ছোটবেলার কাহিনী। জমিদার বাড়ির দেয়ালে যে একটা আলাদা গন্ধ থাকে, বাবার কাছ থেকেই আমি সেদিন জানতে পারি সে কথা। আমার সেই বাবা, তার বাবার কথা বলতে গিয়ে কি অঝোরে কেঁদেছিলেন সেদিন সে কথা ঈশ্বর জানেন। আমার বাবার বাবা, লোকটা নাকি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। এক দুরন্ত ঝড়ের দিনে দুরন্ত সেই লোকটা বজরা নিয়ে মিশে গিয়েছিলেন বিলাস বহুল এক বাতাসে। বাবা বলেন সেই লোকটা আর ফিরে আসেনি। আমি সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি যে মা ফিরে না আসায় কেন বাবা কেঁদেছিলেন। কিন্তু আমার সেই বাবা, যিনি একই সাথে ছিলেন সুদর্শন আর মদ্যপ, তিনি যে আমার সামনে মরে পড়ে আছেন আমি তা বুঝতে পারিনি।
কিন্তু সেদিন থেকেই বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আর কী।
আমি যেদিন প্রথম সেলারি পাই সেদিন বাবার জন্মদিন ছিল। আমার বাবার জন্য কি উপহার কিনব সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। আমার সেই বাবার জন্য, যিনি প্রতিবছর আমার জন্মদিন ভুলে যেতেন, আর বার বার লজ্জিত কন্ঠে ক্ষমা চাইতেন। বাবার জন্য উপহারের খোঁজে গায়ে রৌদ্র মেখে আমি হেঁটে চললাম কোনো সমুদ্রের দিকে। আমার সেই বাবার জন্য, আমি যার নাম পর্যন্ত জানিনা। আমার বাবা এভাবেই সমুদ্রের দিকে হেঁটে যেতেন আমাকে পিঠে চড়িয়ে। কখনো মধ্যবিত্ত বাতাসের মাঝে একঘেয়ে লাগলে আমাকে নিয়ে যেতেন আরও দূরে , কোনো এক বিলাস বহুল বাতাসে। আমার সেই বাই সাইকেল বাবা সে সময়টায় তার আনকোরা কর্কশ কন্ঠে গান গাইতেন। আমি, ছোট আর চঞ্চল আমি কি শান্ত আর নিবিড় হয়ে বাবার পিঠে ঝুলে থাকতাম। দারুণ অফুরন্ত বাতাসে আমার মদ্যপ বাবার চুলের গন্ধে আমার মাতাল সময় কাটত। আমার সেই বাবার জন্য আমি উপহার খুঁজতে খুঁজতে বোকা বনে গেলাম। একই সাথে আমার সম্রাট, দার্শনিক আর বাই সাইকেল বাবার জন্য আমি সেদিন পাগলের মত খুঁজে এক উপহার পেয়েছিলাম। এখন মনে নেই, হয়ত একটা সস্তা হাতঘড়ি ছিল, বা এক বোতল বিদিশি মদ। আমার বাবা, যার জন্য আমি আমার সেলারি থেকে সামান্য উপহার তুলে এনেছিলাম, আমার সেই বাবা সেদিন রান্নাঘরে চায়ের কেটলির সামনে মুখ থুবড়ে মরে পড়েছিলেন।
সেই সেদিন থেকেই বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আর কী।
মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর বাবা আমার সামনে আর কখনও মায়ের প্রসঙ্গ তোলেননি। মাঝেমাঝে আমার বাবা ফটো এ্যালবাম খুলে বসে থাকতেন উঠোনে। আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম দূর থেকে। মনে হত কোনো দেবতা বসে আছেন প্রবল আয়েশে। আমি তাঁর কাছে যাবার সাহস পেতাম না। বাবা মাঝে মাঝে হাত তুলে ডাকতেন। দূর থেকে দেখতাম ধুলোমাখা সেই উঠোনে বসে আমার ভদ্রলোক বাবা তালে তালে মৃদু হাসির সাথে কাঁদছেন। তার শত ডাকা সত্ত্বেও আমি তখন আমার সেই দেবতা বাবার কাছে যেতাম না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। হলুদ প্রশান্তির কোনো এক দিনে আমার সেই বাবা, ফটো এ্যালবামে মাথা গুঁজে মারা গেলেন। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম আমার সেই প্রেমিক বাবা কোনো এক ফটোতে চুমু দিচ্ছেন।
ঠিক সেদিন থেকেই বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরা শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যা হয় আর কী।
এক মেজেন্ডা রঙের বিকেলে মাকে দেখেছিলাম, কাঁদছেন। আমার মা, যার নাম-ধাম-পরিচয় সবকিছু আমার মুখস্ত ছিল। তার আঙুলের ঘ্রাণ, শাড়ির আঁচলের মিষ্টি শব্দ, রিনরিনে হাসির দৃশ্য আর আমাকে চুমু খাবার মুহূর্ত সবকিছু আমার মুখস্ত ছিল। মা কোথাও বাইরে গেলে প্রথমে চুমু খেতেন আমাকে, তারপর বাবাকে। আমার সেই মা, যাকে আমি কোনো ঈশ্বরী ভাবতাম, তিনি আমাকে প্রাণভরে সেদিন চুমু খেলেন একবার, তারপর কয়েকবার। আমার সেই মা যিনি বাবার হাত ধরে সহস্র বছর ধরে, বিকেলের পর বিকেলে অফুরন্ত বাতাসের মাঝে হেঁটেছেন সমুদ্র পর্যন্ত, তিনি সেদিন দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়লেন অফুরন্ত বাতাসে, একা। আমার মা সেদিন বাবাকে চুমু পর্যন্ত খেলেন না। সেদিন আমার বাবা জীবনে দ্বিতীয়বারের মত, আর আমার সামনে প্রথমবারের মত মুখ থুবড়ে মাটিতে মরে পড়ে রইলেন।
সেদিন থেকেই আসলে বাবার প্রিয় ছাইরঙা ছাতাটায় জং ধরতে শুরু করল। মানুষ মারা গেলে যেমন হয় আর কী।

লেখক: সম্পাদক, কাকাড্ডা ডট কম

Loading

Leave a Comment