আলোকিত আঁধারে

“আপনার সমস্যাটা কি?”
ভদ্রলোক মাথা নুইয়ে ফেললেন যেন নিজের সমস্যার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন।
আমি জোর দিয়ে বললাম ,
“আপনার সমস্যাটা খুলে বলুন।”
এবার ভদ্রলোক আমতা আমতা করতে লাগলেন । আমি রীতিমত বিরক্ত হলাম ।
ভদ্রলোক বললেন ,
“আমি আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে পাই না।”
লোকটি এমন ভরাট গলায় কথাগুলো বললেন যে আমি চমকে উঠলাম । আমার চমকে উঠার কথা না । আমি প্রতিদিনই নানা উদ্ভট সমস্যার কথা শুনছি ।
“মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আপনি আয়নায় নিজেকে দেখতে পান না?”
“জি না।”
আমি ভদ্রলোককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। লোকটার উচ্চতা বেশি হবে না । খানিকটা মোটা বলা যেতে পারে । চেহারা ফর্সা । ঠোঁটের উপর গোঁফ আছে । চোখের দিকে তাকালে সর্বদাই তাকে অপ্রস্তুত মনে হয় ।
আমি তাকে বললাম ,
“আপনি কি আয়নায় কিছুই দেখতে পান না।”
“আমি সবই দেখি । শুধু নিজেকে দেখতে পাই না।”
“হুম । বুঝতে পেরেছি।”
মুখে যদিও বললাম বুঝতে পেরেছি আসলে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না । ভদ্রলোক মিথ্যা বলছেন না তো! তার কথা সঠিক হয় কিভাবে?
ভদ্রলোক একটা রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন ।
তারপর আস্তে আস্তে বললেন ,

“ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিষ্কার করার জন্য আপনাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন । এর জন্য আমার সময় প্রয়োজন। ”
আজকে আমি খুবই ব্যস্ত । কিন্তু এই ব্যাপারে আমি অন্যরকম এক আগ্রহ অনুভব করছি ।
আমি তৎক্ষণাৎ আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকে ফোন করে জানালাম আজ আমি আর কোনও রোগী দেখব না ।
“তাহলে আপনার গল্প শুরু করতে পারেন । ”
“জি।”
ভদ্রলোক একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর চোখ নামিয়ে গল্প শুরু করলেন।
“ছোটবেলায় মানুষের নানা রকম অভ্যাস থাকে । কিছু কিছু হাস্যকর হয় , কিছু কিছু হয় সিরিয়াস ধরনের । আমার অভ্যাস কি ছিল জানেন ? আমার অভ্যাস ছিল আয়নার সামনে বসে থাকা । আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নার সামনে বসে থাকতাম । এ নিয়ে সবাই অনেক হাসি ঠাট্টা করত । আমি নাকি মেয়েদের স্বভাব পেয়েছি , সারাক্ষণ নিজের চেহারা দেখি ইত্যাদি ইত্যাদি । আমি তাদের কথার কোনও জবাব দিতাম না । তার মানে এই নয় যে তাদের কথা ঠিক ছিল ।
আমাকে প্রায় সময় দেখা যেত চোখ বড় বড় করে আয়নার সামনে বসে আছি । প্রথম প্রথম সবাই এ নিয়ে হৈচৈ করলেও পরে সবাই এটা দেখেও না দেখার ভান করতে লাগল । আমার কাজ আরও সহজ হয়ে এল । কি কাজ আপনাকে বলি । আমি আয়নার মধ্যে একটা আলো দেখতে পেতাম । সূক্ষ্ম একটা আলো । জোনাকি পোকা ! হ্যাঁ , অনেকটা জোনাকি পোকার মত ছিল আলোটা । আলোটা স্থির ছিল না । গতিময় ছিল । খুবই ছন্দময় ছিল সেই গতি । সবসময় সামনের দিকে চলত আলোটা । মনে হত যেন আমাকে অনুসরণ করতে হবে আলোটাকে । একটা খেলার মত আরকি ! বেশ উপভোগ করতাম খেলাটাকে । পাগলের মত অনুসরণ করতাম আলোটাকে । এক অজানা মোহে আটকা পড়েছিলাম । যার থেকে বের হওয়ার কোনরূপ ইচ্ছা আমার ছিল না । এভাবে আমার প্রায় সারাটাদিন কাটত আলোটাকে অনুসরণ করে । আমার খুব প্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছিল এটি । আর খুবই গোপন ছিল খেলাটি । কেউই এ ব্যাপারে জানত না । আমার মনের অজান্তেই এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা যাবে না । তাই আমি কাউকেই কিছু বলার কোনরূপ চেষ্টা করিনি । বেশ ছিলাম এটা নিয়ে ! দিনকাল ভালই কাটছিল আমার । ছোট বয়স , দুঃখের গভীরতার বোধ তখনও জন্মায়নি । সব কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পেতাম বা খুঁজে নিতাম ।
ও , আপনাকে তো বলা হয়নি । আমাদের আয়নাটা ছিল আমাদের বৈঠকখানায় । বেশ বড় আয়না ছিল ওইটা ।
বুঝতেই পারছেন যে একটা না একটা সমস্যা বাঁধবে !
হ্যাঁ , সমস্যা হয়েছিল । যাকে বলে বিরাট সমস্যা !
আমাদের বৈঠকখানা ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল । এই জায়গা অন্য কাজে ব্যবহার করা হবে । তখন শুরু হল আমার কান্নাকাটি । সবাই আমাকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে আয়নাটা আমাদের ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে । কিন্তু তবুও আমার জানি কেমন একটা অনুভূতি হয়েছিল । মনে হচ্ছিল যেন কিছু হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে । কিন্তু তাকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার ছিল না ।
যেদিন আয়নাটা খুলে ফেলা হবে আমি আয়নাটার সামনে গেলাম ।
সবসময়ের মত আলোটাকে দেখতে পেলাম । গতিময় ছন্দ তুলছে । আর আমি অনুসরণ করতে লাগলাম আলোটাকে । এভাবে মোহে মোহে কিছুক্ষণ চলে গেল ।
হঠাত আমার বুকে ধাক্কার মত লাগল । আলোটার গতি কমে আসল । তারপর উল্টো গতি তৈরি হতে থাকল । মনে হল আলোটা আমার দিকে আসছে ।
হঠাত আমি আলোটাকে হারিয়ে ফেললাম । খুবই আচমকা ঘটল ঘটনাটা ।
আমি আলোটা খোঁজার কোনরূপ চেষ্টা করলাম না । কারণ আশ্চর্য এক শান্ত অনুভূতি হয়েছিল তখন আমার । মনে হচ্ছিল কেউ একজন বলছে সব ঠিক হয়ে গেছে । ”
ভদ্রলোক দেখলাম শিউরে উঠলেন ।
আমার নিজেরই লোম দাঁড়িয়ে গেল । আমি তাকে বললাম ,
“তারপর থেকেই কি আপনি …………”
“জি । তারপর থেকেই আমি আয়নায় নিজেকে দেখতে পাইনা । ”
আমি বলার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না । ঘড়িতে একটা বিরাট শব্দ হল । ঘণ্টার কাঁটা বারটায় পৌঁছেছে ।
ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন ,
“আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম । আরেকটা কাজ করতে পারবেন ? ”
“বলুন । ”
“বাতিগুলো একটু নিভিয়ে দিবেন ? ”
আমি বাতি নেভানোর কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না । কিন্তু উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলাম ।
তার পরের অনুভূতি আমি পাঠকদের কাছে কিভাবে প্রকাশ করব বুঝতে পারছিনা !
ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখি তার পুরো শরীর আয়নার মত পরিষ্কার হয়ে গেছে । আমি তার দেহ-আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম নিজেকে । আর দেখতে পেলাম একটা ক্ষুদ্র আলো । অনেকটা জোনাকি পোকার মত ! আলোটা স্থির নয় । গতিময় ছন্দ তুলছে প্রতিনিয়ত ।

Loading

Leave a Comment