রক্তাশ্রু

তার চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে লাগল রক্তাশ্রু। যেন টকটকে লাল গোলাপের রঙ। ভালোবাসার রঙ। অসংখ্য রক্তাশ্রু কণা একত্রিত হয়ে তার গাল বেয়ে নিচে নামতে লাগল। খুব সুন্দর সে লাল রঙ! যেন বয়ে চলা জীবন। তার চোখগুলো লাল টকটকে। মাথার চুল রক্তভেজা। হাতে পায়ে মুখে রক্ত লেপন। তার প্রতিটি শ্বাসে রক্তাভা। বাতাসে বাতাসে লাল বিষন্ন জীবন ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার জামাকাপড় রক্তিম। তার লোমকূপ থেকে প্রতিটি ক্ষণে ফিনকি দিয়ে রক্তস্রোত বের হচ্ছে। তার মাথার উপরে রক্তলাল আকাশ। লাল মেঘে মেঘে ঢাকা আকাশ। তারা গর্জন করছে হিংস্র ভঙ্গিতে। এক্ষুনি হয়ত বৃষ্টি পড়বে। কেমন হবে সেই বৃষ্টি? খানিক পরে বৃষ্টি শুরু হল। লাল রক্তিম বৃষ্টি। দেখতে দেখতে লাল রক্তের পুরো একটা নদী সৃষ্টি হল। প্রতিটি ক্ষুদ্র বালুকণা রক্তলাল হল। এখন কেবল লাল রঙ দেখা যাচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে দুটা সাদারঙের কাগজের নৌকা। তারা হেলেদুলে রক্ত নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তারা কেবল রক্তশূন্য। রক্ত তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না।

আমি সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সম্ভবত বলছি কারণ এমনও হতে পারে আমি ঘুমাইনি। হতে পারে না? হয়ত আমি তন্দ্রায় ছিলাম। না হয় দিব্যি সজাগ ছিলাম। আমার পূর্ণ চেতনা বিদ্যমান ছিল। আমার চোখ দুটো জ্বালা করছে। যেন অক্ষিকোটর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে। তারা যেন হাঁসফাঁস করছে আর চিৎকার করছে। সেই চিৎকার অক্ষি কারাগারের মাঝেই প্রতিধ্বনিত হয়ে থেমে যাচ্ছে। বের হতে পারছে না। তবে চিৎকার গুলো অক্ষি কারাগারের দুর্ভেদ্য দেয়ালে প্রবল আক্রোশে ধাক্কা দিচ্ছে। আর ক্ষণে ক্ষণে দেয়াল গুলো কেঁপে উঠছে। আমি আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আমার চোখ দুটো রক্তলাল। মনে হল তারা কাঁপছে তিরতির করে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি দু ফোঁটা রক্ত বের হবে চোখ থেকে। আমার ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন ঘুমিয়ে থাকব।

“একটু রক্ত খাবে?”
“রক্ত?”
“হুম। টাটকা রক্ত?”
“লাল রঙের রক্ত?”
“হুম। কি হল খাবে না? ”
“নাহ!”
“কেন?”
“খাবনা তো!”
“একটু খাও ।”
“নাহ। আমি এখন চলে যাব ।”
“কোথায় যাবে?”
“জানিনা। আমার কাগজের নৌকাগুলা দেও ।”
“কাগজের নৌকায় করে যাবে?”
“হুম ।”
“রক্তে ভেসে যাবে তো!”
“নাহ, আমি জানি আমার কাগজের নৌকাগুলো রক্তে ভাসবে না। তুমি বিদেয় হও!”

সময় কাটানোটা বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিভাবে সময়ের আঠালো সুতোগুলো কেটে দিই? খুব ভালো একটা উপায় অবশ্য পেয়েছি। কাগজের টুকরো কুঁচি কুঁচি করা। কিন্তু কাগজও তো শেষ হয়ে যাচ্ছে।
“অন্ধকার ঘরে কাগজের টুকরো ছিঁড়ে কেটে যায় আমার সময়” কার জানি গানটা? অনেকদিন হল রক্তের গান ছাড়া আর কিছুই শুনি না। রক্তের গান শুনতেও অবশ্য তেমন খারাপ লাগে নাহ! ফিনকি দিয়ে সুর বের হয়। আসলে সময়গুলো নাটাই বিহীন ঘুড়ি। কিন্তু বাতাসও সময়ের কবলে। তাই সময় ঘুড়িগুলো নির্দ্বিধায় সগৌরবে উড়ে চলে। বাতাস তাদের ভ্রুক্ষেপ ঘটাতেও সক্ষম হয়না। আমরা সবাই ঘুড়ির লেজ ধরে ঝুলে থাকি। আমি এই মুহূর্তে লাল রঙের ঘুড়িটার লেজ ধরে আছি। ব্যাটা বড্ড বেপরোয়া! এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে। পই পই করে উপরে উঠে যায়। আমি যতই ওটার লেজটা টান দিয়ে ধরি কেবলই আমার হাতের পেশীগুলো ক্লান্ত হয়। আর কোনও কাজই হয় না। আমি নিজেই আমার অক্ষমতার উপহাস করি। একা একাই হাসি। লাগাম ছাড়া সময় ঘুড়ির লেজটা তে আবার হেঁচকা টান দেই। ঘুড়ি পই পই শব্দে উপরে উঠে যায়। আমার কানে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। চিৎকার করে উঠি। কিন্তু দুহাত দিয়ে কান ঢাকার সামর্থ্য আমার থাকে না। আমার হাত যে সময় ঘুড়ির লেজ ধরা।
আমার বিছানার চাদরের ফুলগুলিও যেন পরিচর্যার অভাবে কেমন মুষড়ে পড়েছে। তারাও যেন একটু পরিচর্যা চায়। সজীব হয়ে উঠতে চায় ঠিক আগের মতো করে। যখন আমি আমার দুটা সাদা কাগজের নৌকা রক্তের নদীতে ভাসাইনি।

“এই একটু রক্ত খাও না!”
“কার রক্ত?”
“তোমার রক্ত । ”
“তুমি খাচ্ছ?”
“হুম। একটু মুখে দিয়ে দেখ!”

ড্রাকুলার মতো চুষে চুষে আমার শরীরের রক্ত খাচ্ছে সে। তবে সে আমার কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার লাল চোখ দুটো কেবল জীবন্ত। নেচে নেচে উঠছে। চোখ দুটোর মাঝে তার দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। আমাকে তা দিয়ে কেমন কামড়ে ধরছে! শব্দ করে চুষে চুষে খাচ্ছে আমার রক্ত। আর আমি চুপচাপ সময় ঘুড়ির লেজ ধরে বসে আছি। ঘুড়ি উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আর সে আমাকে চুষে যাচ্ছে। দৃশ্যটা আমি বেশ উপভোগ করছি। রোমহর্ষক সে অনুভূতি। ঠিক থ্রিলার বইয়ের মতো। কি সুন্দর এই রক্তশিল্প।

আমার আকাশটায় অনেকদিন হল বৃষ্টি হয়না। রাত-দিন হয় না। শুধুই আকাশটা একা ঝিমায়। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ায়। মেঘেরা গর্জন ছেড়ে শান্তিচুক্তি করেছে যেন। তারা একটু ঘুমাতে চায়। আমার সকল নিদ্রা তারা নিয়ে নিয়েছে তাদের একান্ত অম্বরে। আমি কেবল চুপচাপ রক্তের ফোঁটা গুনি। টপটপ শব্দ শুনি। সেই রক্ত জিভে ছোঁয়ানোর সাহস হয়ে ওঠে না। সাহসের ঝুড়িটা কিছুদিন আগে পরিপূর্ণই ছিল। যেদিন থেকে আমার রক্ত কমছে সেদিন থেকে আমার সাহসের ঝুড়িটাও খালি হতে শুরু করে। ফোঁটায় ফোঁটায় সাহস হারিয়ে যায়। মিশে যায় রক্তের সাথে। সে রক্তের সাথে সাহসও চুষে চুষে খায়। চুক চুক শব্দও হয় মাঝে মাঝে। ছন্দ আছে সেই শব্দে। রক্তিম ছন্দ। রক্তের বেহালার করুণ সুরে রক্ত কণারা নৃত্যে মগ্ন হয়।

আজ আকাশটা ভারী করে খুব রক্তের বৃষ্টি ঝরছে। ঠিক চোদ্দদিন পর বৃষ্টি হচ্ছে। সে আমার সব রক্ত প্রায় খেয়ে শেষ করে এনেছে। আমি এখন খুব জোরে এক হেঁচকা টানে সময়ের সেই লাল বেপরোয়া ঘুড়িটার লেজ ছিঁড়ে রক্ত নদীতে ভাসব। আমার কাগজের নৌকা দিয়ে। আমার কাঁচের জানালার ওপাশ থেকে লালমতন পাখিটা দেখছে আমার ঘর। কিছু টুকরো টুকরো ছড়ানো ছিটানো কাগজ। অসংখ্য কাগজের তৈরি নৌকা। আমি আর আমার ফুলতোলা চাদরে তার লাশ। আচ্ছা আমি কি একজন খুনি?

সেই লাল পাখিটা তার পাখার কোনো গোপন গহ্বর থেকে একটা সাদা পালক আমাকে দিয়ে গেল। এই পালকটাও রক্তে ভেসে যাবে না। একজন খুনিকে কি একটা পাখি তার পালক দেবে? ভাবতে ভাবতে আমি হেঁচকা টানে সময় ঘুড়ির লেজ ছিঁড়ে ফেললাম। আমার কাগজের নৌকা দিয়ে আর সেই পাখিটার পালককে বৈঠা বানিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। আজ আমি মুক্ত, স্বাধীন!

আমি আসলে কে? কি আমার পরিচয়? আমি কি একজন সাধারণ কুৎসিত খুনি?

লেখকঃ হাদিউল আলম দীপ্র
সম্পাদক, বিষমিষ্টি

Loading

Leave a Comment