ক্রিয়েশন মিথঃ অন্য আলোয় সৃষ্টতত্ত্ব (পর্ব-২)

(প্রথম পর্বের পর)

ওয়ার্ল্ড প্যারেন্ট মিথ

দুইটি ভিন্ন সত্ত্বার মিলনের ফলে জন্ম নেয় আমাদের এই ইউনিভার্স, সংক্ষেপে এই হচ্ছে ওয়ার্ল্ড প্যারেন্ট। এতক্ষণ পর্যন্ত যেসব মিথ সম্পর্কে জানলাম, তাদের মধ্যে কমন প্যাটার্ন হলো, সব জায়গাতেই নারী অনুপস্থিত। এক সুপ্রিম পুরুষসত্ত্বা সকল কিছু সৃষ্টি করেছে। এবার আসবো সেসব মিথে, যেখানে পৃথিবীকে পরিচিত করা হয়েছে মাতৃরূপে। অন্যদিকে আকাশ তথা স্বর্গকে দেখা হয়েছে পিতৃরূপে। এ জাতীয় মিথের সবচেয়ে আদর্শ উদাহরণ গ্রীক মিথোলজি।

জিউস, পসেইডন, অ্যাপোলো, আফ্রোদিতির গ্ল্যামারের কারণে গ্রীক মিথোলজি এ ভুখন্ডে তুমুল জনপ্রিয়। তবে সত্যি বলতে, জিউসের ন্যায় দেবতারা দ্বিতীয় ধাপের সত্ত্বা(deity)। সৃষ্টির সূত্রপাত তারও আগে। এখানে হেসিওডের থিওগোনি(Hesiod’s Theogony) থেকে সংক্ষেপে কিছু তুলে ধরবো। গ্রীক মিথোলজি অনেক বেশি কমপ্লেক্স, এতো ছোট আঙ্গিকে পূর্ণাঙ্গ কাহিনী তুলে ধরা আসলে কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

আদিতে ছিলো ক্যাওস, ক্যাওস থেকে এলেন গাইয়া(Gaia) বা পৃথিবী, বা পৃথিবীর উন্নতবক্ষা দেবী। গাইয়া দেখলেন তিনি বড় একা, তার সঙ্গী দরকার। অতঃপর নিজের অনুরুপে তৈরি করলেন হেভেন বা ইউরেনাস, গাইয়ার পুরুষ প্রতিবিম্ব। দেবতাদের জন্য এক ইটারনাল বাসস্থান হিসেবে মাউন্ট অলিম্পাসে যার স্থান হলো।

গাইয়া আর হেভেনের সঙ্গমে জন্ম নিলো ওশেনাস(Oceanus), কিয়াস(Coeus), ক্রিয়াস(Crius), থিয়া(Theia), রিয়া(Rhea), মেমোরি(Memory), ফিবি(Phoebe)সহ আরো একগাদা দেবতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ক্রোনাস(Cronus, god of time and future castrator)। আমাদের এ কাহিনীর নায়ক, ক্রোনাস। ক্রোনাস আর তার ভাইবোন টাইটান নামে পরিচিত।

কেবল টাইটানরাই নয়, গাইয়ার গর্ভে আরো জন্ম নেয় একচোখা সাইক্লপস এবং পঞ্চাশ মাথা ও একশ হাতওয়ালা বিকটদর্শন হেকাটনকিয়ারস (Hecatonceires)। এরা এতোটাই ভয়ংকর দেখতে যে পিতা হেভেন(Uranus) তাদের টারটারাস নামের এক গুহায় আটকে রাখেন। নিজের সন্তানদের এভাবে দেখে গাইয়া ক্ষেপে যান। প্রতিশোধের নেশায় পুত্র ক্রোনাসের হাতে তুলে দেন এক কাটাওয়ালা কাস্তে(sickle)। ক্রোনাস সেই কাস্তের সদব্যবহার করেন নিজের পিতার পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়ে(catastration)। সেই পুরুষাঙ্গ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে তা ক্রিট দ্বীপে পৌঁছে। ঢেউয়ের ফেনা থেকে জন্ম নেন সৌন্দর্যের দেবী, আফ্রোদিতি।

Castration of Uranus by Cronus; source:researchgate

যাই হোক, ক্রোনাস জানতেন তিনি যা করেছেন তার প্রায়শ্চিত্ত তাকেই করতে হবে। সেকারণে বোন-বউ রিয়ার ঔরসে জন্ম নেওয়া নিজের সন্তানদের ব্যাপারেও তিনি নার্ভাস ছিলেন। অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে নিজের সন্তানদের জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই গিলে ফেলতেন। রিয়া এতে রেগে যান।

যখন জিউসের জন্ম হয়, রিয়া ক্রিট দ্বীপে পালিয়ে যান এবং শিশু জিউসকে তার দাদী, গাইয়ার কাছে হস্তান্তর করেন। ক্রিট থেকে একটা পাথরকে চাদরে মুড়িয়ে অলিম্পাসে ফিরে যান। ক্রোনাসকে দেখান। ক্রোনাস তাকে নিজের সন্তান ভেবে খেয়ে ফেলেন।

জিউস বড় হতে থাকেন, পুরো সময়টা তিনি টাইটানদের কাছ থেকে অলিম্পাসের সিংহাসন ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। অবশেষে যখন তিনি পুরোপুরি প্রস্তুত, টারটারাস থেকে পঞ্চাশ মাথাওয়ালা হেকাটোনকিয়ারসদের মুক্ত করেন এবং একসাথে, তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ক্রোনাসের পেট থেকে নিজের ভাইবোনদের উদ্ধার করেন এবং সকলে মিলে টাইটানদের ক্ষমতাচ্যুত করেন। জিউস আর তার পরিবার হয়ে উঠেন গডস অব গ্রীস।

Fall of the titans; an oil painting by Peter Paul Ruben

পিতা পুত্রে সংঘাত, এবং পিতাকে পরাজিত করে পুত্রের ক্ষমতা দখল মিথোলজিতে খুবই কমন এক ঘটনা। গ্রীক মিথোলজি ছাড়াও আরেক জনপ্রিয় মিথ নর্স মিথোলজিতেও এর বহু উদাহরণ রয়ে গেছে। যে জাতি যত বেশি যুদ্ধংদেহী, তাদের মিথও ততবেশি ভায়োলেন্সে পূর্ণ। গ্রীক আর নর্স মিথোলজি ভরা হানাহানি মারামারি তারই সাক্ষ্য দেয়।

চলে আসি নর্স মিথোলজিতে। এডা নামক এক গাথাকাব্যে(Prose of Edda) নর্স ক্রিয়েশন মিথ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

সৃষ্টির শুরু হয় ইমির(Ymir) হতে, যে ছিলো এক বরফদানব(frost giant) । ইমির ফ্রস্ট জায়ান্টদের এক পরিবার সৃষ্টি করেন। ইমিরের নেতৃত্বে ফ্রস্ট জায়ান্টরা জগৎজুড়ে রাজত্ব করে বেড়াতো।

বোর(Borr, son of Buri) নামধারী এক ব্যক্তি বিয়ে করেন বেলথর(Boelthor) নামক ফ্রস্ট জায়ান্টের কন্যা বেৎসলাকে(Bestla)। বেৎসলা একে একে তিন সন্তানের জন্ম দেয়ঃ ভিলি, ভে আর ওডিন(Vili, Ve and Odin)। তিন ভাই ইমির আর তার ফ্রস্ট জায়ান্টদের ঘৃণা করতেন। তারা যুদ্ধ করলেন, ফ্রস্ট জায়ান্টদের পরাজিত করলেন এবং ইমিরকে হত্যা করলেন। এবার মৃত ইমিরের দেহকে কাজে লাগিয়ে দুনিয়া সৃষ্টি করলেন।

দেহ থেকে তৈরি হলো পৃথিবী। অস্থি রুপ নিলো পাহাড়-পর্বত এবং পাথরে। তার রক্তে তৈরি হলো নদী, খুলি পরিণত হলো আকাশে। বিশাল আকাশ ধরে রাখার জন্য চার কোণায় চার বামন(dwarves) পাঠানো হলো। তাদের নাম উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ,পশ্চিম। আগুনদানবদের(fire giants) দুনিয়া মাসপেলহেইমের(Muspelheim) এর স্পার্ক থেকে সৃষ্টি করা হলো চন্দ্র ও সূর্য। পরাজিত ফ্রস্ট জায়ান্টদের নির্বাসিত করা হলো জতুনহেইম(Jotunheim) নামক স্থানে।

ইমিরের আঁখিপল্লব থেকে তিন ভাই সৃষ্টি করলেন এক উর্বর ভূমি, মিডগার্ড। সেখানে বসবাস করার জন্য সৃষ্টি করা হলো মানুষের। অ্যাশ গাছ থেকে সৃষ্টি হলো মানব, এলম গাছ থেকে সৃষ্টি হলো মানবীর। ওডিন জীবনদান করলেন, ভিলি দান করলেন বুদ্ধিমত্তা ও অনুভূতি, ভে দিলেন জ্ঞান। প্রথম মানব হলেন আস্ক, প্রথম মানবী এমব্লা।

ইমিরের দেহ পঁচে বেড়িয়ে আসা লার্ভা থেকে দেবতারা সৃষ্টি করলেন বামনদের। বোর এর পুত্র হিসেবে তারা অমর দেবদেবীদের এক পরিবার সৃষ্টি করলেন যার নাম অ্যাসির(Aesir)। সকলের আদি পিতা ওডিন।

সবশেষে মিডগার্ডের উপরে তারা সৃষ্টি করলেন এক অত্যাশ্চর্য জগৎ, অ্যাসগার্ড, দেবতাদের বাসস্থান। মিডগার্ড ও অ্যাসগার্ডের যোগাযোগ রক্ষার্থে নির্মিত হলো বাইফ্রস্ট তথা রংধনু সেতু। দেবতারা অ্যাসগার্ড এবং মানুষ মিডগার্ডে বাস করতে লাগলো।

Fall of Ymir, victory of Odin ; source:pinterest

প্রাচীন ব্যবিলনের এনুমা এলিস(Enuma elis) মিথোলজি আবার সবকিছুর সমন্বয়। ভায়োলেন্স, এক্স নিহিলো, ওয়ার্ল্ড প্যারেন্ট সব ধরনের অস্তিত্বই এতে পাওয়া যায়।

এখানেও সৃষ্টি শুরু হয় পানি থেকে। লবণপানির দেবী তিয়ামাত এবং স্বাদুপানির দেবতা আপসুর সঙ্গমে জন্ম নেয় লামু ও লাহামু(Lahmu and Lahamu), যারা প্রকৃতপক্ষে প্রথম সৃষ্ট দুই ভূমি। এই দুই ভাইবোন একত্র হয়, জন্ম দেয় দেবতাদের প্রথম পরিবারের। আনশার(Anshar), কিশার(Kishar) এবং তাদের পুত্র আনু(Anu)। তারা আবার সৃষ্টি করে দ্বিতীয় প্রজন্মের একদল দেবতাকে, যাদের নেতৃত্ব দেন ইয়া(Ea)।

ইয়া আর তার ভাইবোনেরা ছিলো অত্যধিক দুষ্টপ্রকৃতির শিশু, তাদের গ্র‍্যান্ডপ্যারেন্টস আপসু আর তিয়ামাত কে জ্বালাতন করাই ছিলো তাদের কাজ। হঠাৎই মুহূর্তের ভুলে, ইয়া অ্যান্ড কোং তাদের দাদা আপসুকে খুন করে ফেলে। তিয়ামাত রেগে যান। ইয়াকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি সৃষ্টি করেন সাপ, ড্রাগন, মৎসমানব, বৃষমানব সহ নানান ভয়ংকর ক্রিয়েচার। ইয়া, আনশার, আনু এই দানবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু ইয়ার পুত্র, মারডাক(Marduk) এর সাহায্য ছাড়া তাদের পরাজিত করা সম্ভব হচ্ছিল না।

মারডাক তথা সূর্যদেবতা ছিলেন চতুর, সুযোগসন্ধানী। নিজের পিতাকে বেকায়দায় দেখে তিনি সিংহাসন হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। ইয়া-র সাথে তিনি চুক্তি করেন, তিয়ামাতকে তিনি হত্যা করবেন, বিনিময়ে তিনি হবেন দেবতাদের রাজা।রাজি হওয়া ব্যতীত ইয়া-র হাতে কোনো বিকল্প ছিলো না। কাজেই, তিয়ামাতকে হত্যা করে মারডাক স্বর্গের সিংহাসনে বসলেন। শাসন করার জন্য, তিয়ামাতের দেহ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। এক্ষেত্রে, তার দেহ পরিণত হলো পর্বতে, চোখ থেকে এলো তাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদী, বুক পরিণত হলো পাহাড়ে আর নাসারন্ধ্র পরিণত হলো লেকে। ব্যাবিলন শহরের গোড়াপত্তন করা হলো, এ শহর হলো দেবতাদের বাসস্থান। মারডাক ভাবলেন, নিজেদের খেদমত করার জন্যও লোক দরকার। তারই আদেশে তিয়ামাতের রক্ত থেকে ইয়া সৃষ্টি করলেন মানুষ, যাদের দায়িত্ব ছিলো সেই কাজগুলো সম্পন্ন করা যা দেবতারা করতে ছিলেন অনিচ্ছুক।

সোশ্যাল অর্ডার ইন ক্রিয়েশন

জাপানের শিন্তো ক্রিয়েশন মিথ শুধু জগৎ সংসার সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত দেয়না, বরং একইসাথে রীতিনীতি, রিচুয়ালস, অর্ডারও শিক্ষা দেয়। শিন্তো ক্রিয়েশন মিথ হতে প্রাপ্ত রিচুয়ালস জাপানের বাসিন্দারা বহুকাল অনুসরণ করে এসেছে।

এক্ষেত্রে শুরুটা একেবারে শূন্য থেকে হয়নি। পৃথিবী চিরকালই ছিল, তবে তা ছিলো অপরিপক্ক, জেলিফিশের ন্যায় থকথকে কাদার মতো। তিন অদৃশ্য দেবতা দৃশ্যমান হন, যারা কামি নামে পরিচিত, বাস করতেন স্বর্গের উচ্চতম ভূখন্ডে, যার নাম তাকামাগাহারা(Takamagahara)। একে একে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের দেবতা আবির্ভূত হন। একদম শেষপর্যায়ে আবির্ভাব ঘটে আদি দম্পতি, ইজানাগি(Izanagi) ও ইজানামির(Izanami), যারা আবার পরস্পরের ভাই বোন।

ভাসমান ভূমিকে স্থির ও শক্ত করে তুলতে দেবতাদের আদেশে ইজানাগি ও ইজানামি স্বর্গীয় নৌকায় চড়ে পৃথিবীতে নেমে আসেন, এবং স্যুপের মতো তরল মাটিকে অলৌকিক বর্শার সাহায্যে নাড়তে থাকেন। বর্শার মাথায় কিছু তরলের ফোঁটা জমাট বাঁধে। সৃষ্টি হয় অনোগোরো(Onogoro) দ্বীপের, যা প্রথম শুকনো ভূমি। ইজানাগি-ইজানামি দম্পতি অনোগোরো দ্বীপে নেমে আসেন, এবং এক স্বর্গীয় স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করেন। এবার তারা বিবাহের চিন্তা করেন। সেই স্তম্ভকে কেন্দ্র করে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়, যেটা জাপানে রিচুয়াল হিসেবে মানা হতো। যাই হোক ,সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।

তাদের প্রথম সন্তান, হিরুকো, ছিল বিকলাঙ্গ। সেকারণে তাকে একটা নৌকায় করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার ইজানামির গর্ভে মানুষ, দ্বীপসমূহ, দেবতা, দেবীর আগমন ঘটে। এবং সেখান থেকেই জগৎ-সংসারের সূত্রপাত।

Creation of Onogoro;source: pinterest

দুঃখজনক কিন্তু সত্য, এই মিথ অনুসরণ করে শিন্তো মতাবলম্বীরা বহু বছর যাবৎ নিজেদের প্রথম সন্তানদের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে ।

দ্যা ইমারজেন্স মিথ

এতক্ষণ যেসব মিথ নিয়ে আলোচনা করা হলো, সেসবের মাঝে ভায়োলেন্স খুবই কমন। এ জাতীয় কাহিনীগুলোতে লড়াই ঝগড়াই মূল উপজীব্য । হানাহানি মারামারির এসব মিথ ছাড়াও কিছু মিথ, স্পেশালি আদিবাসী আমেরিকান উপজাতিগুলোর মিথগুলোর মাঝে প্রকৃতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব মিথে দেখা যায়, বিভিন্ন পোকামাকড় বা জন্তুজানোয়ার থেকে বা এদের সহায়তায় মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। হোপি মিথে দেখা যায়, পূর্বে প্রাণিজগৎ বাস করতো পাতালে, অন্য এক জগতে। স্পাইডার গ্র‍্যান্ডমাদার আর তার সহকারী কাঠবিড়ালি সহ বিভিন্ন পশুপাখি মিলে বর্তমান পৃথিবীর প্রবেশদ্বার বা সিপাপুনি(sipapuni) খুঁজে বের করে। আবার একই মিথের নাভাহো ভার্সনে দেখা যায়, মানুষ পতঙ্গের রুপ ধারণ করে সিপাপুনি দিয়ে বেড়িয়ে আসে। এমন বহু মিথ পাওয়া যায় যেখানে কোনো মানুষের রুপধারী বা বিকটদর্শন দৈত্যদানোর বদলে প্রাত্যহিক সঙ্গী বিভিন্ন প্রাণীর মাধ্যমে ক্রিয়েশন ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

 ইমারজেন্স মিথের মূল বক্তব্য হলো, এখানে মানুষ অথবা অন্যান্য পশুপাখি ভিন্ন কোনো জগৎ থেকে আমাদের জগতে এসেছে। অর্থাৎ সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হয়েছে ভিন্ন কোনো জগতে, সেখান থেকে আমরা বর্তমান ভূমিতে চলে এসেছি। এই ক্যাটাগরির সবচেয়ে বড় উদাহরণ বিবলিক্যাল মিথ। তবে আপাতত বাইবেল বাদ দিয়ে অন্য দিকে নজর ফেরানো যাক।

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বনভূমিতে বাস করা ইরোকিওস ইন্ডিয়ানদের মিথ থেকে আমরা ইমারজেন্স মিথের উদাহরণ পেতে পারি। একই মিথ আবার আর্থ ডাইভার ক্যাটাগরিতেও পড়ে, যেখানে কেউ একজন স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসে, তার মাধ্যমেই বংশবৃদ্ধি শুরু হয়।

বহু বর্ষ পূর্বে, মানুষ বাস করতো আকাশেরও উপরে, স্বর্গে। স্বর্গের দলপতির কন্যা খুবই অসুস্থ হয়ে যায়, কোনোভাবেই তাকে সুস্থ করে তোলা যাচ্ছিল না। সেখানে এক জাদুকরী গাছ ছিলো, সেই গাছ হতে উৎপাদিত ভুট্টা দ্বারাই সকলের ক্ষুধা মিটতো। দলপতির এক বন্ধু স্বপ্নে দেখেন, তাকে আদেশ করা হচ্ছে যেন অসুস্থ মেয়েকে জাদুকরী গাছের পাশে শুইয়ে গাছকে যেন উপড়ে ফেলা হয়। কন্যার চিন্তায় অস্থির দলপতি সেটাই করবেন বলে মনস্থির করলেন। যেই কথা সেই কাজ। মেয়েকে শুইয়ে রেখে তিনি গাছকে উপড়ে ফেললেন।

ঠিক সেই সময় এক ইয়াংম্যান সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। সে খুব বিরক্ত এবং ক্লান্ত ছিলো, গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলো। কিন্তু সেখানে কোনো গাছ ছিলোনা। রাগে দুঃখে শুয়ে থাকা মেয়েটাকে জোড়সে লাথি কষালো। উপড়ে ফেলা গাছের স্থলে থাকা গর্ত দিয়ে মেয়েটা নিচে পড়ে গেলো। নিচে মানে একদম নিচে। পৃথিবীতে।

পৃথিবীতে কোনো ভূমি ছিলোনা। ছিলো শুধু পানি আর পানি, পানিতে চড়ে বেড়াতো একদল হাঁস আর কিছু সামুদ্রিক পাখি। সেই মেয়েকে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে তারা সকলে গায়ে গা লাগিয়ে ‘হংস নির্মিত দ্বীপ’ নির্মাণ করলো। মেয়েটাকে সাধ্যমত ভাসিয়ে রাখল।

কিছুক্ষণ পর তারা ক্লান্ত হয়ে গেলো। মেয়েটাকে ভাসিয়ে রাখার ভার এক কচ্ছপের পিঠে চাপিয়ে তারা উধাও হয়ে গেলো। একটা সময় পর কচ্ছপ নিজেও ক্লান্ত হয়ে গেলো। এবার তার সাহায্যে এগিয়ে এলো ব্যাঙ। সে সমুদ্রের তলদেশ থেকে পলি নিয়ে এসে কচ্ছপের পিঠে জমাতে লাগলো। এই ভূখন্ড বাড়তেই থাকলো বাড়তেই থাকলো, যতক্ষণ না সকল প্রাণ বসবাস করার মতো উপযুক্ত জমি সৃষ্টি হলো।

রেড ইন্ডিয়ানদের মিথগুলো এরকমই। তারা জাতি হিসেবে সহজ সরল, প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন। ক্রিয়েশন সংক্রান্ত তাদের  চিন্তা ভাবনাও এমনই সহজ সরল ছিলো; গ্রীক-নর্সম্যানদের মতো মারামারি আর সেক্সের মধ্যে সীমাবধ্য ছিলোনা। আবার আফ্রিকানদের মতো বমি দ্বারা দুনিয়া সৃষ্টির চিন্তাও তাদের মাথায় আসেনি।

Girl falling from heaven; source:medium

মিথোলজির জগৎ বিশাল। এনিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে শেষ করা যাবেনা। তবে “জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই” বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও তো কোনো কাজের কথা নয়। এখানে কেবল ক্রিয়েশন বিষয়ে বিভিন্ন মিথের কথা বলেছি। প্রতিটা মিথেই এমন বহু বহু কাহিনী রয়েছে, প্রকৃতিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু গল্প হিসেবে পড়লেও মিথোলজি এক অসাধারণ গল্পভান্ডার। কাজেই, মিথোলজি সম্পর্কে পড়ুন, জানুন, শিখুন, অন্যকেও জানান। মিথোলজির বিশাল দুনিয়ায় সবাইকে স্বাগতম।

ক্রিয়েশন মিথঃ অন্য আলোয় সৃষ্টতত্ত্ব (পর্ব-১)

Leave a Comment