শহরের একটি হুল্লোড়ের গল্প

যে লাল ইটের কোমরসমান ওয়ালের উপর আমি বসে আছি, তার পাশেই একটা ইস্পাতের ডাস্টবিন পাতা। সিটি করপোরেশনের এই উদ্যোগ বেশ প্রসংশনীয়। যদিও বেশিরভাগ ডাস্টবিন ই বসানোর কয়েকদিনের মাথায় উধাও হয়ে যায়। ঢাকা শহরে এই ডাস্টবিন উধাও করার মানুষজনের অভাব নেই সম্ভবত। আর তাদের অভাব থাকলেও যে কজন মানুষ এই কাজ করে, এই বিশেষ কাজে তাদের বিদ্যার অভাব নেই বলা যায়। কেননা একটি বিশেষ পদ্ধতিতে এরা এই কাজ করে বলেই, আপনি এদের সহজে ধরতে পারবেন না। যাই হোক, আপাতত আমার ডাস্টবিন বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় নেই। আমি বাদামের খোসা ছাড়িয়ে লাল ইটের হাফওয়ালে বসে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে মারছি। এই বিশেষ কাজে যে আমি সবসময় সফল হচ্ছি, তাও না। অনেক খোসাই ডাস্টবিনের বাইরে গিয়ে পড়ছে। আশেপাশের পরিবেশ সচেতন মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিপ্রকাশ করছে। আর কিছুক্ষন পরে আমার বাদাম খাওয়া শেষ হয়ে এলে বিনের বাইরে পরা খোসাগুলোকে আমি কুড়িয়ে বিনের ভেতরে ফেলবো, এই দৃশ্যও অনেকে দেখবে। এই দুইসময়ে এসব দেখা মানুষজন যদি আমার মুখের দিকে তাকায়, তাহলে সহজেই বুঝবে আমি বেশ উৎফুল্ল মন নিয়ে এখানে বসে আছি। অথচ এখন আমার মোটেও উৎফুল্ল থাকার কথা না। এই লাল ওয়ালটিতে আমার পাশে যে বেশিরভাগ সময়ে বসে বাদাম খেতো, সে হাসপাতালে ভর্তি। তাও একটি বিশেষ কারনে। রাফিয়ার এই হাসপাতালে ভর্তি থাকার বিশেষ কারনটির বিশেষ বিশেষত্বের জন্য, এখানে উপস্থিত সবাই মোটামুটি রাফিয়ার কথা জানে। কিন্তু ওরা আমার কথা জানেনা। জানলে হয়তো অবাক ই হতো। কেননা, আমার উচিত এখন মুখ ভারাক্রান্ত করে বসে থাকা, সেই আমি উৎফুল্ল চিত্তে বাদাম চিবোচ্ছি। একটু তো অবাক হওয়ার ই কথা!

বাইরে পরা খোসাগুলো বিনের ভেতরে ফেলার কাজ শেষ। যারা বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিলো, আমি এবার তাদের দিকে বাঁকাচোখে তাকিয়ে চেহারায় একটা বিজয়ী অভিব্যক্তি আনার চেষ্টা করলাম! এগোনো দরকার। রাফিয়া ঢাকা মেডিকেলে আছে। আমার হেঁটে যেতে সময় লাগবে এগারো মিনিট। এই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হাঁটতে বেশ আরাম লাগে। চারদিকের সবকিছুর কেমন জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব। সাধারণ কাঁঠাল গাছের দিকে তাকালেও মনে হয়, চশমা পড়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এই বুঝি এক্ষুনি দর্শন নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিবে।

রাফিয়ার সাথে আমার পরিচয় আড়াই বছরের মতো হবে। মোটামুটি পরিস্কার চিন্তাভাবনার এই মেয়েটির সাথে আমার সখ্যতা বেশ। ওর সাথে আমার পরিচয়ের বেলায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আর তখন ও কলেজে পড়তো। এখন রাফিয়া আমার জায়গায় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। চিন্তাভাবনাও বেশ পরিপক্ব! আর আমি একটা ডিগ্রী নিয়ে আপাতত পড়াশুনার ইতি টেনে ঘুরে বেড়ানোর কাজ করছি। ঠিক ঘুরে না বেড়ানো বলে বলা যায় চাকরি করছি। সাংবাদিকতার। রাফিয়া আমাকে ডেকে আনে প্রায় প্রতিদিন ই। আমিও চলে আসি ওর এক কথায়। টেনে নিয়ে আসে কোনো অদৃশ্য শক্তি। কখনো ভাবিনি ওই শক্তির ব্যাপারে। এই আড়াই বছরের পরিচয়ে রাফিয়ার ব্যাপারে যে খুব বেশি জেনে গিয়েছি, এমনটাও না। যদিও আমার জানাটাই বেশ উচিত ছিলো। কিন্তু বেশ আনকোরা আমি কখনো বুঝিওনি একটা মেয়ের সাথে মিশলে তাকে জানতে হয়। জানার চেষ্টা করতে হয়, বুঝতে হয়। বুঝার চেষ্টা করতে হয়। আমি বেশ দিব্যি চলে আসতাম, বসে আড্ডা দিতাম। কথা শুনতাম রাফিয়ার। তারপর নিজের ডেরায় চলে যেতাম।

রাফিয়ার ব্যাপারে আমার যে আরো ভাবা আর জানার উচিত ছিলো সেটা বুঝতে পারছি এখন। ওর নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকিয়ে। চোখ বুজে আছে। বড় বড় মানুষেরা বলেন, চোখের দিকে তাকালে নাকি অনেক কিছু বুঝা যায়। অথচ রাফিয়ার চোখ বন্ধ, তবুও আমি অনেক কিছু বুঝতে পারছি। আমার মনে অনেক প্রশ্ন আসছে। আমি কোনো সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিনা।

রাফিয়ার মাথার কাছে ওর মা বসে আছেন। ওর মায়ের সাথেও আমার পরিচয় আড়াই বছর হবে। যেদিন প্রথম রাফিয়াদের বাসায় ওকে পড়াতে গিয়েছিলাম, সেদিন থেকেই। মহিলা বেশ ভালো মানুষ। এই অবস্থায় আমার উনাকে কি বলা উচিত আমি বুঝতে পারছিনা। রাফিয়ার বাবা কেবিনের বাইরে পায়চারী করছেন। আমাকে দেখেই যেন নতুন করে তার চোখের পানি ঝরা শুরু হয়েছে। অবশ্য ঝরবেই না বা কেন! শুধু আমিই আড়স্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রাফিয়া ঘুমিয়ে আছে। ওকে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে। আমি বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারলাম না। ওর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। পারলাম না। রাফিয়ার মায়ের মাথায় একবার হাত রাখলাম। এরপরে বেরিয়ে চলে আসলাম৷ আমি নিজের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াতে শুরু করেছি! রাফিয়ার চেহারায় আমি কিছু একটা দেখতে পাচ্ছিলাম। যে দেখায় শূন্যতা ছিলো বেশ প্রকট৷ আমি এর আগে এমন করে ভাবিনি কখনো। এটাকে আমি কি বলবো! আমি জানিনা আমি কি বলবো! খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। এখন মানুষজন আমার চেহারায় আর উৎফুল্লতা দেখতে পাবে না। সাময়িক ব্যবধানে আমার চেহারা থেকে সব হারিয়ে গিয়েছে। জানোয়ার গুলোকে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ওরা রাফিয়াকে নিশ্চয় অনেক কষ্ট দিয়েছিলো। আমি ভাবতে পারছিনা। অসহ্য যন্ত্রনা আমাকে ঘিরে ফেলেছে।

পাবলিক লাইব্রেরীর পেছন দিকটায় বেশ নিরবতা থাকে সন্ধ্যার দিকে। আমার এখন নিরবতাই প্রয়োজন। চারদিকে বেশ হুল্লোড়। রাফিয়াকে নিয়ে হুল্লোড়। রাফিয়ার ধর্ষণ নিয়ে হুল্লোড়। মিডিয়া রসিয়ে রসিয়ে নিউজ করছে। যেন রাফিয়ার ধর্ষণ তাদের রাতের পর রাত জেগে ভেবে বের করা অসাধারণ কনটেন্ট! ধর্ষণের পর আবার প্রতি মুহুর্তে এইসব সস্তা খবরে ধর্ষিত হচ্ছে রাফিয়া। আমার চ্যানেলের সিনিওর ক্রাইম রিপোর্টার সালিম ভাই। রাফিয়া ধর্ষনের নিউজের দায়িত্ব পড়েছে তার উপরে। সালিম ভাই কল দিয়েছিলো আমাকে। কিছুক্ষন আগে। আমার সাথে তার সখ্যতা বেশ। “তোমার বান্ধবী রাফিয়া, কি খবর তার? হাসপাতালে গেছিলা কখন শেষবার? কি যে বলি তোমারে! তোমার অবস্থা বুঝতেসি। হ্যালো, শুনতেছো? একটা গোপন খবর পাইলাম। এগুলা পাবলিকলি প্রচার করা যাবেনা। তোমারে জানানো যায়। তাই ফোন দিলাম। শোনো, রাফিয়ার শরীরে ধর্ষকের সিমেন পাওয়া গেছে। বুজলা? কি অবস্থা দেখো! কয়েকজন আলাদা আলাদা ব্যক্তির সিমেন নাকি পাওয়া গেছে! হারামজাদাগুলা! আমার তো রাফিয়ার কথা ভেবে খুব কষ্ট হইতেছে। বেচারী আর এত্তোগুলা অমানুষ! আহারে!” আমি ফোন কেটে দিয়েছি। সালিম ভাইয়ের কথাগুলো শুনতে পারছিলাম না। বেশ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। জাদুঘরের সীমানার বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। সামনের গাছের ফাঁক দিয়ে আর আকাশ দেখা যাচ্ছেনা। কালো হয়ে এসেছে সব। আমার চারদিকে বেশ কিছু কুকুর ঘুরঘুর করছে। আমি নির্বাক তাকিয়ে আছি ওদের দিকে। আমার চেহারায় উৎফুল্লতা আসছে না। আমি হারিয়ে গিয়েছি অজানায়। একটি বাদুর ধুপ করে মাটিতে পড়লো। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলো আসছিলো। আর উড়ে গেলোনা বাদুরটা।শোয়া থেকে আর উঠলো না। কিছুক্ষন পর আরেকবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য আমিই উঠে পড়লাম।

রাফিয়ার বাবা আগের মতোই কেবিনের বাইরে আছেন। এখন চুপচাপ বসে আছেন। পায়চারী করছেন না। আমি উনার চোখে চোখ পড়লেও কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। রাফিয়ার মা নির্বাক। রাফিয়ার চাদরখানি ওর মুখ পর্যন্ত ঢাকা। মারা গিয়েছে রাফিয়া। সবাই জেনে গিয়েছে। শুধু আমিই জানতাম না। চোখ সরিয়ে নিলাম ওর ঢেকে দেয়া চেহারা থেকে। পরক্ষনেই চাদরটা সরিয়ে আবার তাকালাম। ওর ঘুমন্ত চেহারার দিকে। হ্যাঁ, ঘুমিয়েই আছে। ওর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বন্ধ চোখই অনেক কথা বলে দিচ্ছে। আমি পারলাম না। রাফিয়া আমাকে জানিয়েছে। আমি বেরিয়ে এসেছি হাসপাতাল থেকে। বাইরে বেশ ভীড়। সালিম ভাইকেও দেখতে পেলাম এক কোণে। আমি তাড়াতাড়ি জায়গা টা থেকে দূরে সরে এলাম। এখন রাফিয়ার মৃত্যুতে আরো হুল্লোড় হবে। আরো গল্প তৈরী হবে। রাস্তায় মিছিল হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা উত্তাল হবে। সালিম ভাই আমাকে ফোন করে টাটকা খবর জানাবেন। কিন্তু এসবে আমার কিচ্ছু আসবে যাবে না। আমার চেহারার উৎফুল্লতা ফিরে আসছে।

আমি এগারো মিনিট হেঁটে গিয়ে বসলাম লাল ইটের হাফওয়ালটিতে। শেষবার রাফিয়ার মৃত ঘুমন্ত চেহারা আমাকে বলে গিয়েছে,” এবার বুঝলেন প্রত্যয়দা, আপনি আমাকে কতোটা ভালোবাসতেন?”

Leave a Comment