আমার ওপেনহাইমার দেখার অভিজ্ঞতা

লিটলবয়, ফ্যাট ম্যান, ৬ ও ৯ আগস্ট, হিরোশিমা, নাগাসাকি, ট্রুমান, ওপেনহাইমার, ন্যাটজিওর ডকুমেন্টারি, আমেরিকান প্রমেথিউয়াস – সব পরিচিত থাকার পরেও, পুরো ঘটনা জানার পরেও, যেটা কখনোই উপলব্ধি করা যায়নি তা হলো ওপেনহাইমারের সত্যিকারের নৈতিক দ্বন্দ্ব। কোনো নতুন প্লট না, নতুন কোনো সায়েন্টিফিক টার্ম এর সাথে নতুন করে পরিচিতি না। কিন্তু এরপরেও নোলানের উপর চোখ বন্ধ করে আস্থা রেখে তার আসা নতুন মুভি নিয়ে এক্সাইটেড থাকা কেনো উচিত সেটার প্রমাণ, ‘ওপেনহাইমার’। ওপেনহাইমারের নৈতিক দ্বন্দ্ব কোনো ডকুমেন্টারি তে অথবা আমেরিকান প্রমেথিউয়াস পড়ে যতখানি বোঝা যায়, তার চেয়েও বেশি করে বোঝা হয়ে গেলো ‘কিলিয়ান মার্ফি’ র দুটি নীল রঙা চোখে।

আইন্সটাইনের সাথে ওপেনহাইমারের কথোপকথন আর শেষে ওপেনহাইমারের বলে ওঠা “You already did” যে কত গভীর সেটা সেই দৃশ্য না দেখলে বোঝা সম্ভব না। দুটো শুনানি পাশাপাশি চলা নিয়ে বানানো একটা মুভি। অনেক গুলো ঐতিহাসিক নাম, ঘটনার উল্লেখ কিন্তু বোরড হবার সময় ছিলো না। কারণ হঠাৎ করে চলে আসবে হাইজেনবার্গ এর নাম, হঠাত করে আসবে নীলস বোর, হঠাৎ করে আসবে চেইন রিয়াকশন অথবা হাইড্রোজেন বোমা। মাথার মধ্যে একটা ভিন্ন চিন্তা এসে যেকোনো একটা টার্ম মিস করলে পরের ঘটনার সাথে যোগ সংযোগ করা কঠিন হয়ে যাবে৷ যেমন হাইজেনবার্গ কেনো সফল হবে না শেষমেষ, ওপেনহাইমারের দেয়া ব্যাখ্যাটা আমি মিস করে পাশ থেকে শুনেছি। আবার নীলস বোর এই ঘটনায় এসে কী করে গেলেন সেটি পাশের জন কে বুঝিয়েছি৷

অসংখ্য পরিচিত মুখ, অস্কারজয়ী অভিনেতা,বড় বড় ঐতিহাসিক চরিত্রে। কিন্তু নোলানের এই মুভিতে তারা সবাই কমন ম্যান। এখানে গুরুত্বপূর্ণ শুধুই ওপেনহাইমার। ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি অথবা মিম টেমপ্লেটে থাকা রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে আমি প্রথম দেখায় চিনতেই পারিনি। ভীষণ পরিচিত আয়রনম্যানকে আমি দেখে স্তম্ভিত, লুইস স্ট্রসের চরিত্রকে এমনভাবে ক্যারি করেছেন তিনি যে নিজের চোখকেও অবিশ্বাস্য মনে হবে। মুন্সিয়ানা না থাকলে এইভাবে এতোগুলো চরিত্রকে কেবলই কমন ম্যান, জাস্ট এ পার্ট হিসেবে উপস্থাপন করা সম্ভব না।

স্ক্রিনে তৈরি হওয়া টেনশন, সাউন্ডের ওঠানামা এইসব কারিকুরির মধ্যে দিয়ে ওপেনহাইমারের মধ্যে যে নৈতিক দ্বিধা চলছে তার রেশ পরবে দর্শকের মস্তিষ্কেও। টেস্টের সময়ে আগে আলো,পরে সাউন্ডের বেসিক সায়েন্সও আপনাকে স্ক্রিনে দেখিয়ে মুগ্ধ করবে নোলান।

“জাপান অপছন্দ করেছে, জার্মানি হলে আরো ভালো হতো” বলার পরে ওপেনহাইমারের সহকর্মীরা যে নোংরা উল্লাস দেখায় সেখানে একজন মানুষ হিসেবে আপনি বাকরুদ্ধ হয়ে যাবেন। আবার যেই বিজ্ঞানী এই ঘটনার পরে বমি করে ফেলছে, যারা কোণে বসে চোখের জল মুছছে – তাদের দেখে আপনার মানবমনের অপরাধবোধ নিয়ে একেবারে ভিন্ন ধারণার জন্ম নেবে৷

জাপানের কোনো ছবি ব্যবহার না করেও পুরো ঘটনায় ওপেনহাইমারের চোখে দেখানো কষ্টে হিরোশিমা নাগাসাকির মানুষের জন্য আপনার আত্মা কেঁপে উঠবে। মিলিটারি, বুরোক্রেসি সবকিছুর উপরেই আপনার রাগ জন্মাবে ট্রুমানের আচরণে। যখন ওপেনহাইমারের সিকিউরিটি হিয়ারিং চলবে তখন তা আরো পোক্ত হবে। সেই রাগ হঠাৎ আনন্দে রুপ নেবে যখন স্ট্রসের সেক্রেটারি হিয়ারিংয়ে তাকে অসংখ্য কংগ্রেসম্যান শেইমিং করবে।

এইভাবে একটা জানা জিনিস কেও অজানারূপে তুলে ধরেছেন, তৈরি করেছেন ক্রিস্টোফার নোলান। নোলানের সর্বশেষ মুভি টেনেট আমি বুঝেছি দ্বিতীয়বার দেখে। ওপেনহাইমারের বেলায় সেই বালাই নেই। কিন্তু তবুও বলবো, ‘নোলান সুপ্রিমেসি’ সিনেমায় আমার সবচেয়ে প্রিয় সুপ্রিমেসি। শুরু থেকেই যেভাবে এক্সাইটেড ছিলাম, টিকেট কাটার সময়ে যেই মানসিক চাপ নিয়েছি – তা আমাকে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিয়েছে নোলান, মার্ফি, ডাউনিরা। প্রতিটি চরিত্র অভিনয়ে মুগ্ধতা ছাড়িয়ে গেছে।

একজন মানুষ তুখোড় মেধাবী হলেও তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তার ভুক্তভোগী হতে হয় কত লক্ষ মানুষকে, তার প্রমাণ হিরোশিমা আর নাগাসাকি। কিলিয়ান মার্ফির নীল চোখের অপরাধবোধ আমি যতই দেখি না কেনো, হিরোশিমা নাগাসাকিতে আজকেই জন্ম নিলো যেই শিশু, সে কি কখনো তাকে ক্ষমা করতে পারবে?

ওপেনহাইমার হচ্ছে সমস্ত মেধাবীদের জন্য একটা কেস স্টাডি যে, আপনার মেধা আপনার শ্রম, আপনার ডেডিকেশন আপনি কোথায় ব্যয় করবেন আপনার অসাধারণ মেধার এক ভাগ দিয়ে হলেও সেটার এনালাইসিস আপনাকে সবার আগে করতে হবে। নাহলে একজন প্রেসিডেন্টের সামনে বসে আপনাকে আক্ষেপ নিয়ে বলতে হবে, “আই হ্যাভ ব্লাডস ইন মাই হ্যান্ডস”। আর সেই প্রেসিডেন্ট আপনার আবেগকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে, মক করে আপনাকে এগিয়ে দেবে রুমাল আর আপনার কানে আসবে “ক্রাই বেবি।”

গরীব দেশের মানুষ হয়ে ওপেনহাইমার দেখে আপনি বুঝবেন – লাখ লাখ লাশের জন্য, জেনারেশনের পর জেনারেশনকে মৃত্যুপুরীর বাসিন্দা বানানোর জন্য, একজনকে সবচেয়ে জনপ্রিয় সেলেব্রিটি বানিয়ে উল্লাস করা হবে৷ আপনি বুঝবেন মানুষের জীবন নেয়া এইখানে কোনো অপরাধ নয়। বরং অপরাধ হলো কমিউনিস্ট বন্ধু থাকা, কমিউনিস্ট প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী থাকা৷ অপরাধ হলো, পাপের অপরাধবোধে ভোগা।

মানুষের রক্তের দাগ যাদের হাতে পাকাপোক্ত হয়ে বসে আছে, গরীব দেশের মানুষ হয়ে আপনাকে তাদের ঠিক করে দেয়া হিউম্যান রাইটসই মেনে নিতে হবে। এই যে বৈষম্য, ওপেনহাইমার দেখে এটাও আপনার অনুভব হবে খুব ভালো করেই।

– লিখেছেন অন্তরা শারমিন

Loading

ভালোলাগার বই – “প্রথম আলো প্রথম খন্ড”

“সব ছাপিয়ে, এই উপন্যাসেরও মূল নায়ক-সময়। তীর সামনে ছুটে যাবার আগে কিছুটা পিছিয়ে যায়। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে আগিয়ে যাবার … আরো পড়ুন…

হালদা একটি সিনেমার নাম

আজাদ বুলবুলের গল্পে, তৌকির আহমেদের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত “হালদা” চলচ্চিত্রটি ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর দেশব্যাপী মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রের…

Loading

জেমস পটার এবং উপেক্ষিত উপাখ্যান

জেমস পটার সম্ভবত সবচেয়ে আন্ডাররেটেড জাদুকর। পুত্র হ্যারি পটারের খ্যাতি কি জেমস কে আড়াল করে দিয়েছে? অথবা সেভেরাস স্নেইপের সাথে তিক্ত মনস্তাত্ত্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা?

Loading

বইয়ের কথা: ক্রনিকল অব অ্যা ডেথ ফরটোল্ড

পৃথিবীর সাহিত্যের অন্যতম সেরা হাতবোমা, সবচেয়ে সেরা যদি নাও হয়। অবশ্য, অন্য কেউ তো আর এই হাতবোমার কারিগর না, এই লোকটার নাম গার্সিয়া মার্কেজ। উনি সবই পারেন।

Loading

হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস ও আমরা

এক মোহময় সময়েই খোঁজ পাই হ্যারি পটার সিরিজটার। বইয়ের জগতে হারিয়ে যাবার দুর্দান্ত অনুভূতি কাঠের কোন খেলনাও দিতে পারেনা। আর এ তো নিরেট এক কল্পণা। একদিন লাইব্রেরিতে চোখে পড়ল ঝকঝকে মলাটের একটা বই। প্রচ্ছদে এলোমেলো চুলের এক কিশোরের ছবি। পশ্চাৎপটে একটা দূর্গ আর সাথে তিন মাথার কুকুর। সব মিলিয়ে কেমন জাদুকরী একটা অনুভূতি দিচ্ছিল পুরো ব্যাপারটা।

Loading

আমরা গাইব শুধু গান, হতে চাইনা শিরোনাম

পঁচাত্তর কি ছিয়াত্তরের কলকাতা শহর। প্রতিবেশী বাংলাদেশে তখন চলছে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ষাটের দশকের শুরু থেকে বব ডিলান, জিম মরিসনরা তখন আরবান ফোক নামে নতুন এক জনরার (genre) গান নিয়ে রাজত্ব করে চলেছে। সারা বিশ্বের সংগীত যেখানে এগিয়ে চলছে তখন বাংলা গানের চর্চায় লেগে আছে স্থবিরতা। গতানুগতিকতার বাইরে কোনো ভাবেই বের হতে পারছিলো না বাংলা গান। তখনই এসেছিলো মহীনের ঘোড়াগুলি। বাংলা গানের নতুন ধারা সৃষ্টি করা এই গানের দলকে নিয়ে কাকাড্ডায় লিখেছেন তরুণ কবি সোহান আহমেদ তন্ময়। 

Loading

বইয়ের কথা – স্মৃতির শহর

স্মৃতির শহর ঢাকা। রুক্ষতা, যানজট আর তীব্র গরমের মধ্যেও পুরান ঢাকা এখনো অনুভব করার মতো একটা জায়গা। এখানকার প্রতিটা কদম যেনো ইতিহাস মাড়িয়ে পথ চলার মতো।

Loading

জনবিচ্ছিন্ন সংগীত ও জনসংযোগের সংগীত

ইস্ক্রা রহমান ও শাদিউল আলম জীবন কর্তৃক যৌথভাবে লিখিত। ১. বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার জ্ঞান সংক্রান্ত যাবতীয় আলাপের গোড়ার কথা … আরো পড়ুন…

Loading