বইয়ের কথা – স্মৃতির শহর

স্মৃতির শহর ঢাকা। রুক্ষতা, যানজট আর তীব্র গরমের মধ্যেও পুরান ঢাকা এখনো অনুভব করার মতো একটা জায়গা। এখানকার প্রতিটা কদম যেনো ইতিহাস মাড়িয়ে পথ চলার মতো। যারা পুরান ঢাকাকে অনুভব করতে চান, বিশাল এই নগরীর ইতিহাস জানতে চান তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর বইটি। এই বইটিকে নিয়ে কাকাড্ডা ডট কমে লিখেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন

 

উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকার প্রাচীনতম বিদ্যাতীর্থ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুবাদে এক নতুন চোখে পুরান ঢাকাকে দেখতে পাই। পুরান ঢাকার রূপ-রস-রুক্ষতা সম্পর্কে আমার আগ্রহ দেখে আমার বিভাগেরই এক সিনিয়র শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর বইটি আমাকে ধার দিয়েছিলেন। ক্লাস টু’তে  ট্রেনের বাড়ি কই কবিতাটি দিয়ে শামসুর রাহমানের লেখার সাথে আমার পরিচয়। এরপর বিভিন্ন সময় তাঁর লেখা পড়লেও পুরান ঢাকার অলিতেগলিতে চষে বেড়ানো এই কবির শৈশবের কথা ওভাবে জানা হয়নি। এই বইটি আমাকে কবি শামসুর রাহমানের অসাধারণ শৈশবের স্মৃতিতে মুগ্ধ তো করেছেই আর তিলোত্তমা প্রাচীন নগরী ঢাকার প্রতি আমার অনুরাগকে প্রেমের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।

রাজধানী ঢাকার বয়স চারশেরও বেশী। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে বুড়িগঙ্গার পারে এই নগরীর পত্তন ছয়শ থেকে হাজার বছর আগে। দিনে দিনে, শতাব্দী থেকে শতাব্দীতে বদলে গেছে ঢাকার চেহারা। বদলেছে চেনা মানুষগুলো। ঢাকার এই বদলে যাওয়াকে একটা-আধটা বইয়ে ঢুকিয়ে দিলে শেষ হয়ে যাবে না। তবে আজ থেকে সাত-আট দশক আগে কেমন ছিলো ঢাকার চেহারা, তার এক সুন্দর-সাবলীল বর্ণনা পাওয়া যায় স্মৃতির শহর বইটি থেকে। ১৯২৯ সালে জন্ম নেয়া শামসুর রাহমান তাঁর শৈশবের অসাধারণ স্মৃতি দিয়ে সাজিয়েছেন এই বইটি।

গুলিস্তানের কামান। (ছবিঃ রজার গেইন)

চলতি পথে সবকিছুর ওপর চোখ বুলানো ছিল শামসুর রাহমানের প্রিয় কাজ। তাঁর অসাধারণ চোখে ধরা পড়েছে ঢাকার রাস্তার পাশের গাছে পাখিদের সংসার, কথা-বার্তা। সে সময় ঢাকার রাস্তায় মোটর চলতো না। বড় রাস্তা ছিলো না। ছিলো ছোট ছোট রাস্তা, একটা কি দুইটা বড় রাস্তা। চুলের ফিতের মতো গলি ছিলো, গলির ভেতর মানুষের বসতি। সে সময় ঢাকার রাস্তায় টগবগিয়ে চলতো ঘোড়া, ছিলো ঘাস-বিচুলির গন্ধে মাখা আস্তাবল। আজকের মতো বৈদ্যুতিক ল্যাম্পপোস্ট তখন ছিলো না। সন্ধ্যের আগে আগে বাতিঅলা এসে জ্বালিয়ে দিয়ে যেতো রাস্তার সব বাতি। বাতিঅলার জন্য ছড়া লিখেছিলেন শামসুর রাহমান।

বাতিঅলা করছ তুমি

কী যে মজার কাজ।

পড়িয়ে দিয়ে সাঁঝের গায়ে

আলো-জরির কাজ।

গলায় মাদুলি, মাথায় কিস্তি টুপি দেয়া বাতিঅলা হঠাৎ করে যেনো হারিয়ে গেলো। তাকে কখনো এই ছড়া শোনাতে পারেননি শামসুর রাহমান। যেমন শোনাতে পারেননি পাম্প শু পায়ে গলি পারি দেয়া আলীজান বেপারীকে নিয়ে তাঁর অনুভূতির কথা। বইটিতে তাঁর শৈশবের আরো বেশ কয়েকটি মানুষের কথা জানিয়েছেন কবি। ১৯৪১ এর ইউরোপীয় যুদ্ধ, গুলিস্তানের কামান, ভিক্টোরিয়া পার্ক, সদরঘাট, হোসেনী দালান, আশুরার মিছিল, ১৯২৬-এ ‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা সহ কোনো কিছুই বাদ যায়নি বইটিতে। ভুলেননি আহসান মঞ্জিলের কথা। তুলে ধরেছেন ১৮৫৭ সনের সিপাহী বিপ্লবের কথাও। শ্রীগগনচন্দ্রের  সাথে তার পরিচয় পর্বও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন লিখার এক ফাঁকে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত ঢাকার করুণ চিত্রও তিনি তুলে ধরেছেন এই অসাধারণ স্মৃতিকথায়। 

পুরান ঢাকার এক সরু গলি। (ছবিঃ রজার গেইন)

গল্পটা শুরু হয়েছিল অনেকটাই রূপকথার গল্পের মতো। লেখক ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে অচেনা এক জায়গায় যেখানে তাঁর সাথে দেখা হয় ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির। তাদেরকেই কবি শুনেয়েছেন তার ছেলেবেলার গল্প, প্রিয় শহরের গল্প। তাঁর বাড়ির পাশে ছিল তেলওয়ালি বুড়ি যার কাছে লেখক যেত পিঠে খেতে আর সুযোগ বুঝে পালাত বুড়ির শুকাতে দেওয়া কুল নিয়ে। রোজার দিনে মসজিদের ইফতারের জন্য মসজিদের আশে পাশে ঘুরঘুর করা কিন্তু অজানা এক বাঁধার জন্য মন খারাপ করে ইফতার না নিয়ে চলে আসা আর ইশকুল বাড়িতে গিয়ে ফুল কুড়ানো -এ সব কিছু তাঁর কিশোর মনে কিভাবে দাগ কেঁটে গেছে তার এক সুন্দর সুনিপুণ বর্ণনা পাওয়া যায় এই বইটি থেকে।

তাহের, শিশির, নীহার, অনিল সহ আরোও অনেকেই লেখকের বন্ধু হয়ে উঠে তার স্কুলের দিন গুলোতে। ঝগড়াতো হতই কিন্তু পরক্ষনেই গলাগলি করতে দেরি করতেন না তারা। স্কুলের হিন্দুস্থানি দারোয়ান, কেরানিবাবু, বাবু বাজারের পুল, দুলদুল নামের সেই তীর খাওয়া ঘোড়াটা সবার সাথেই পরিচয় হওয়া যাবে গল্পটির মাধ্যমে। 

বই পড়তে পড়তে একদিন হোসেনি দালানের সামনে চলে গিয়েছিলাম আমি। লেখকের মতো ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল। বাস্তবতায় ফিরতে ফিরতেই এক সময় নিজেকে অনুভব করলাম মাঝরাতের মিছিলের মাঝে। আর কাজলা দিদি, তার কথাই বা বাদ দেই  কিভাবে! যার কথা শুনে সকলেরই মন হু হু করে উঠে। বাজার থেকে আনা হাঁস খেলার সাথী হয়ে উঠার কথা, মাহুতটুলি নামের সেই প্রাণবন্ত মহল্লার কথা, আলীজান বেপারীর কথা, বাতিঅলার কথা জানা যাবে, অনুভব করা যাবে এই বইটি পড়ে। 

সত্যি স্মৃতির শহর যেন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো সাত-আট দশকের সেই পুরোনো শহরে। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা অনেক বদলে গেলেও প্রাচীনত্বের অনেক গন্ধই থেকে গেছে পুরান ঢাকাতে। এখনো পিচঢালা রাস্তায় টগবগিয়ে চলে ঘোড়ার গাড়ি, শাঁখারীবাজারে ঢুকলেই পাওয়া যায় শাঁখের গন্ধ, সদরঘাটে চালু আছে পুরোনো সেই রকেট সার্ভিস। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্টোরিয়া পার্কের মনুমেন্ট, আহসান মঞ্জিল, রূপলাল হাউজ, বিউটি বোর্ডিং, তারা মসজিদ আর আমাদের শতবর্ষী ক্যাম্পাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

রুক্ষতা, যানজট আর তীব্র গরমের মধ্যেও পুরান ঢাকা এখনো অনুভব করার মতো একটা জায়গা। এখানকার প্রতিটা কদম যেনো ইতিহাস মাড়িয়ে পথ চলার মতো। যারা পুরান ঢাকাকে অনুভব করতে চান, বিশাল এই নগরীর ইতিহাস জানতে চান তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর বইটি। সাহিত্য বিলাস প্রকাশনীর এই বইটি পাবেন ঢাকার বাংলাবাজার, নিউমার্কেট সহ দেশের সব বড় লাইব্রেরীগুলোতে।  

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Loading

Leave a Comment