CRISPR: প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হতে জিন এডিটিং

CRISPR  শব্দটা শুনতে ক্রিস্পার হলেও জিনিসটা কিন্তু মোটেও ক্রিস্পি নয় বরং সাধারণ অর্থে এটা হচ্ছে একটা জিন এডিটিং টুল। অর্থাৎ যা দিয়ে আমরা যেকোনো জীবের (হ্যাঁ, মানুষেরও) জিনে যে কোনো ধরণের পরিবর্তন বা পরিমার্জন করতে পারি। জিন হচ্ছে DNA এর একটা সুনির্দিষ্ট সিকুয়েন্স যা জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। প্রত্যেক জীবের জিন ভিন্ন প্রকৃতির, এমনকি জিনের এই ভিন্নতা মানুষে মানুষেও বিদ্যমান। ঠিক এই কারণে, আমরা সবাই মানুষ হলেও আমাদের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা বর্তমান থাকে যা আমাদের একে অপর থেকে আলাদা করে।

CRISPR শব্দটির পূর্ণরূপ করলে দাঁড়ায় “Clustered Regularly Inter spaced Short Palindromic Repeats” যা মূলত নির্দেশ করে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে। ব্যাকটেরিয়ার এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন ফ্রান্সিস্কো মোজিকা ১৯৯৩ সালের দিকে। তবে CRISPR তখন একটা অনুকল্প ছিল মাত্র যেটাকে পরবর্তীতে ফিলিপ হোরভাথ এবং তার দল ২০০৭ সালে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন। আর CRISPR কে জিন এডিটিং টুল হিসাবে ব্যবহার করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় ২০১৩ সালে ঝাং ল্যাবরেটরিতে।

ব্যাকটেরিয়া CRISPR ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। একটা CRISPR লোকাসে একই DNA সিকুয়েন্স বিশিষ্ট অনেকগুলো জিন বর্তমান থাকে আর একই DNA সিকুয়েন্স বিশিষ্ট দুটি জিনকে আলাদা করে রাখে স্পেসার জিন। স্পেসার জিনের বৈশিষ্ট্য হলো এরা প্রত্যেকে একে অপর হতে আলাদা। এখন এই একই সিকুয়েন্স বিশিষ্ট জিনগুলি এক ধরণের বিশেষ প্রোটিন উৎপন্ন করে যা CAS প্রোটিন নামে পরিচিত। বিভিন্ন ধরণের CAS প্রোটিন বিদ্যমান যেমন CAS-1, CAS-9, CPF-1  ইত্যাদি (জিন এডিটিং এ সাধারণত CAS-9 বা CPF-1 প্রোটিন ব্যবহার হয়)। তো এই CAS প্রোটিনে থাকে নিউক্লিয়েজ এনজাইম যা DNA কাটার ক্ষমতাযুক্ত। আর স্পেসার জিনগুলি থেকে ট্রান্সক্রাইব (DNA সিকুয়েন্সকে RNA তে রূপান্তরকরণ পদ্ধতি) হয়ে তৈরি হয় গাইড RNA। একটি গাইড RNA এবং একটি CAS প্রোটিন নিয়ে গঠিত হয় CRISPR সিস্টেম যা কিনা গাইড RNA এর অনুরূপ DNA সিকুয়েন্স তথা জিন খুঁজে বের করে এবং সুনির্দিষ্টভাবে DNA সিকুয়েন্সের ঠিক সেই অংশটুকুই কেটে ফেলে। এখন ব্যাক্টেরিয়া যদি CRISPR ব্যবহার করে কোনো ভাইরাসের DNA কর্তনের দ্বারা ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে চায় তাহলে ব্যাক্টেরিয়াকে অবশ্যই সেই ভাইরাসের নির্দিষ্ট জিন তথা DNA সিকুয়েন্স জানতে হবে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, স্পেসার জিনগুলি মূলত বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাসের জিন তথা DNA সিকুয়েন্স; যা ব্যাক্টেরিয়া নিজ প্রতিরক্ষার জন্য পূর্বে থেকেই সংরক্ষণ করে রাখে। ফলে কোনো ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করলে ঐ ভাইরাসের DNA কাটতে সক্ষম CRISPR সিস্টেম দ্বারা ব্যাক্টেরিয়া ঐ ভাইরাসটিকে মেরে ফেলে। এখন যদি ভাইরাসটি নতুন প্রকারের হয়? তাহলেও সমস্যা নেই। CRISPR সিস্টেম তাকেও আক্রমণ করতে সক্ষম। শুধু তাই না, নতুন ভাইরাসটিকে মেরে ফেলার পর CRISPR সিস্টেম ভাইরাসটির DNA এর নির্দিষ্ট জিন কপি করে এবং CRISPR লোকাসে নতুন স্পেসার জিন হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখে যেন ভবিষ্যতে ঐ ধরণের ভাইরাসের আক্রমণ সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

এখন যদি গাইড RNA কে আমরা পরিবর্তন করে নিজেদের ইচ্ছামত একটা দেই? আর CRISPR সিস্টেমকে মানবদেহ বা অন্য কোনো প্রাণীর দেহে প্রবেশ করিয়ে দেই? হ্যাঁ, তাহলে CRISPR সিস্টেম গাইড RNA এর অনুরূপ জিন খুঁজে বের করে তাকে কেটে ফেলবে। আর কাটা অংশটুকু ঐ প্রাণীর DNA রেপ্লিকেশনের মাধ্যমে পূরণ করে ফেলবে। ফলে আমরা পেতে পারি মিউটেশন। অথবা আমরা চাইলে CRISPR সিস্টেমে কম্পলিমেন্টারি জিন সংযুক্ত করে দিতে পারি। DNA এর যেই অংশটুকু কাটা পড়বে সেই কাটা অংশটুকু এই কম্পলিমেন্টারি জিন দ্বারা পূরণ হয়ে যাবে। ফলে আমরা চাইলেই কোনো একটা জিন সরিয়ে তার জায়গায় অন্য জিন জুড়ে দিতে পারি। আর এভাবেই CRISPR করবে জিন এডিটিং।

আর CRISPR এর এই বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে নিরাময় করা যাবে হিমোফিলিয়া, বর্ণান্ধতা, ডাউন সিন্ড্রোম, মাস্কুলার ডিসট্রফি, স্কিজোফ্রেনিয়ার মত বিভিন্ন জটিল জিনগত রোগ। এছাড়া ক্যান্সার, HIV এর মত রোগসমূহেরও নিরাময় করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন প্রাণী থেকে অপসারণ করা যাবে বিভিন্ন ক্ষতিকর ভাইরাস; যেমন- মশা থেকে ম্যালেরিয়া ভাইরাস অপসারণ। এতে মশা কামড় দিলেও ম্যালেরিয়া হবার ভয় থাকবেনা। অন্য প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যাবে মানবদেহে। কল্পবিজ্ঞান আর কল্পবিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকবেনা। সুপার হিউম্যান, X-man দের খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে বাস্তবে। বিলাসিতার নতুন অধ্যায় হিসেবে আবির্ভাব ঘটানো যাবে নিজ পছন্দ অনুযায়ী বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন গৃহপালিত প্রাণী পালন।

এখন এই আবিষ্কারের ভবিষ্যৎ কি হয়, কতটা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয় এই আবিষ্কারকে -সেটাই দেখার বিষয়।

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

Loading

Leave a Comment