গর্ভধারিণী

সমরেশ মজুমদারের বেশ কিছু বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রতিটা বইই মাস্টারপিস। বিশেষত উপন্যাস গুলো। দীপাবলির নাম শোনেনি এমন বইপ্রেমিক দুই বাংলায় কমই আছে। গর্ভধারিণীর জয়িতাও কিন্তু কম জনপ্রিয় নয়।
“একটা মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে কোনো কিছুই আটকে থাকেনা। কেউ একুশ বছর বয়সে পুলিশের গুলিতে মারা যায় কেউ সত্তরে রোগে মারা পড়ে। যদ্দিন প্রাণ তদ্দিন সব চোখের সামনে, যেই শরীরটা গেল অমনি অস্তিত্বের বিলোপ। কারও কারও স্মৃতি কিছু বছর, কয়েক বছর অথবা শতাব্দী মনে রাখে মানুষ। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষকে তিনমাসেই বিস্মরিত হয় মানুষ, যারা থেকে গেলো। হেসে ফেলল সুদীপ। কেউ থাকেনা। যাওয়ার জন্যে অপ্রস্তুত থাকে। মা এখন কোথায়? একটাই তো জীবন আর সময়টাও বড় অল্প অথচ মানুষ ভাবার সময় কয়েক শতাব্দী ধরে নিজেকে ছড়িয়ে ভাবে। কল্যাণ তবু যাওয়ার আগে কিছু ওষুধ পৌছে দিয়ে গেল। তার পরে যে মানুষগুলো যাবেই তাদের থাকার সময়টা যাতে একটু স্বস্তিতে কাটে তারই ব্যবস্থা করে গেলো। এইটুকুই বা ক’জন করতে পারে। সাবাস কল্যাণ!” – গর্ভধারিণী।
পুরো উপন্যাসটি বাংলার তথাকথিত রোমান্টিক বইগুলো থেকে একটু আলাদা। পুরো উপন্যাসটি বাংলার তথাকথিত রোমান্টিক বইগুলো থেকে একটু আলাদা। একই সাথে রোমাঞ্চকর, উদ্দীপনাময়, রোমান্টিক,দ্বন্দযুক্ত।
জয়িতা, সুদীপ, আনন্দ আর কল্যাণ এই চার বন্ধুর এক দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প নিয়েই গর্ভধারিণী। ঘূণে ধরা সমাজের মানুষের বিবেক বোধকে নাড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্য একের পর এক অভিযান চালিয়ে যায় তারা। হত্যা করে মানুষরূপী অমানুষদের। কিন্তু একসময় এই চার বন্ধুর প্রয়াস বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। আইনের হাত থেকে বাঁচতে তারা বেরিয়ে পরে। ছুটে যায় পাহাড়ের পাদদেশে। নেপাল আর ভারতের বর্ডারের দিকে। পুলিশের নাগালের বাইরে। কিন্তু সেখানে তাদের পরিচয় ঘটে সভ্যতাবিবর্জিত এক জনগোষ্ঠীর সাথে। তাপল্যাঙ। এই তাপল্যাঙ কে নিয়ে তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এক নতুন সাম্যের সমাজ গড়ে তোলায় চেষ্টায় রত হয়। এই প্রচেষ্টায় আনন্দ গ্রামবাসীকে নেতৃত্ব দেয়। বাকীরা সাহায্য করে। কিন্তু জয়িতার আত্মবিশ্বাস, গ্রামবাসীর সাথে একাত্ব হয়ে যাওয়া এবং সবশেষে সেই গ্রামেরই সন্তানকে পেটে ধরে জয়িতা তার বাকী বন্ধুদের চেয়ে এগিয়ে যায় অনেক। নিজেকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায় । গর্ভধারিণী নামের স্বার্থকতা এখানেই।
কল্যাণ চরিত্রে দেখা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অভাবে বেড়ে উঠা এক যুবককে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ই যার কাছে দ্বিধা- দ্বন্দময়। আনন্দ একই সামাজিক কাঠামোতে বেড়ে উঠলেও তার মায়ের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কারণে তার মাঝে নেতৃত্বের পূর্ণ পরিস্ফুটন ঘটে। বাবার মতো সেও রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে। অপরদিকে সুদীপ এবং জয়িতা উভয়েই বিত্তবান বাবা মায়ের অবহেলিত সন্তান। উচ্চ শ্রেণির আরাম আয়েশ তাদের কাছে মরীচিকার মতো মনে হয়। জীবনের অর্থ খুঁজতে চার বন্ধু তাই এক অনিশ্চিত পথে পা বাড়ায়। সেই পথে লেখক হোন তাদের সঙ্গী।
বইটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক অদৃশ্য আকর্ষণ কাজ করে। লেখক পুরো বইয়ে সমাজের এলিট শ্রেণির পারিবারিক বিপর্যয় তুলে ধরেছেন। সেই সাথে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ভালোবাসা,আত্বিক বন্ধন, শিক্ষার স্ফুটন ঘটে আনন্দ চরিত্রটির মাধ্যমে। এই চরিত্র পুরো বইয়ে কিছুটা কর্তার ভূমিকা পালন করে। সামাজিক অবক্ষয় যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে আর সেই অবক্ষয়ের জন্য যে বাঙালী সমাজের গা বাঁচিয়ে চলাটাই দায়ী- উপন্যাস টিতে তা চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি লেখকের সমাজচিন্তা, নারীদের সামাজিক অবস্থান আর নারী স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি লেখক তুলে ধরেছেন। সমরেশের বেশ কিছু বইয়ে নারীদের স্বাধীনতার বিষয় টি উঠে এসেছে। গর্ভধারিনী বইটিতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিটা চরিত্রই স্বতন্ত্র। একটি অন্যটি থেকে আলাদা। সামাজিক অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু লেখকের পক্ষে তাদের মানসিক দ্বন্দ ও চিন্তা ভাবনা ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব হয়নি। অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ভাবে তিনি একই সাথে কলকাতা আর তাপল্যাঙ এর মানুষদের কথা তুলে ধরেছেন। লেখকের লেখনি এক্ষেত্রে অসাধারণ ।
ভাষাগত প্রয়োগ প্রশংসার যোগ্য। অঞ্চলভেদে সাবলীল পরিবর্তন দেখা যায়। একি সাথে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানু্ষের পরিচয় ঘটে এই বইয়ে। বাস্তবিকতার নিমিখে গড়ে তোলা এই উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্রই যেন নিজ নিজ স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। পুরো বইয়ে লেখক নিজের মতামতের পাশাপাশি সামাজিক আর্থসামাজিক কাঠামতে সাধারণ জনগণের অবস্থান তুলে ধরেছেন।
শুধুমাত্র আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট ই নয় সমাজের উন্নয়নে দরকার মানসিক ও ব্যক্তিত্যের পরিবর্তনও। খুব বেশি দেরি নেই যেদিন সমাজের সকল স্তরের মানুষ মিলিতভাবে সমাজ গঠনে এগিয়ে আসবে। এই আশাবাদই বইটিতে ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে বইটি অনন্য! বিশেষত বর্তমানে সমাজের এইই ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে সমাজকে পুনরায় গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে বইটি। লেখকের অসাধারণ এই সৃষ্টি যুবক সমাজকে সমঝদার করে তোলে,করে তোলে আশাবাদী। কাজেই সমরেশ প্রেমিক ছাড়াও অন্যান্য সকল বইপোকারা বইটি পড়ে দেখবে, তা আশা করা যেতেই পারে।
সমাজের মানুষগুলোর বিবেকবোধ আর মানবিকতাকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বইটি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।
সমরেশ মজুমদারের এক অসাধারণ কীর্তি গর্ভধারিণী। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিশোর যুবকদের উপযোগী এই বইটিকে তাই দশে দশ দেয়া যায়। বাকীটা পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী।

Loading

Leave a Comment