ধন্যবাদ, আবার আসবেন

 

জুলাই মাসের এক রাতের বেলায় দেখা যায় মধ্যপাড়া এলাকাটা অপেক্ষাকৃত নীরব। বৃষ্টি হবে। অন্য কোনো দিন দৃশ্যটা ভিন্ন থাকে। আসলে মধ্যপাড়া এলাকাটা উন্মাদের মতো, পানির ছোঁয়া লাগলে পাগলামি বাড়ে। ডুবা রাস্তায় রিক্সা উলটায় পরে, খোলা ম্যানহোলে জলজ্যান্ত মানুষ ডুইবা যায়। তাই সবাই আগেভাগে ঘরে বসে থাকায় রাস্তাঘাট আজকে ফাঁকা। এছাড়া অন্যদিনে কিন্তু মানুষ ঠিকই থাকে। সন্ধ্যাবেলাটা সোডিয়াম লাইটের আলোয় কি-একটা অজানা উৎসবের লাইটিঙের মতো লাগে। এইখানের মানুষ গুলাও বিচিত্র। শত মানুষের শত শত কাহিনী। ওদের নিজেদের যত গল্প তার ছিটেফোঁটা মাখায় দেয়া আছে এলাকার দেয়ালে দেয়ালে। যেমন নূরের গল্লির একটা ওয়ালে লেখা-‘ড্রেইনের মাছের গন্ধও কাইটা যায়, কিন্তু প্রেমিকার গন্ধ যায়না’ এর লেখক কে তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নাই।
এই নূরের গল্লির মাথায় একটা দুইতলা বিল্ডিং দেখা যায়। বিল্ডিঙের হলুদ রঙটা শ্যাওলা পরায় আধাপাঁকা আমের মতো দেখায়।এমন সময় নূরের গল্লির রাস্তা দিয়া থ্রি-কুয়ার্টার প্যান্ট আর একটা কালো টি-শার্ট পরা যে যুবক হাঁইটা আসতে থাকে তার মাথায় খুব সুন্দর কোঁকড়া চুল। এই গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র। আমরা তার সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানার চেষ্টা করি।
নামঃ মুস্তাফা
পিতাঃ মৃত
মাতাঃ মৃত
অভিভাবকঃ চাচা (অবিবাহিত)
পেশাঃ বেকার
মুস্তাফা গলি থাইকা যখন এলাকার মেইন রোডে উঠে তখন আবহাওয়া শীতল। বাতাস চলে জোড়ে জোরে, সাথে হঠাৎ হঠাৎ আকাশের উত্তর মাথায় বিদ্যুৎ চমকায়। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন সে একটা চালের দোকানের সামনে আসে তখন নাজিম মিয়া মাত্র দোকানের শাটার ফালানো শেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।
-ওই মুনসী
নাজিম মিয়া তাকায়, মুস্তাফা ডাকে। নাজিম মিয়া একটা হাসি দেয় আর চাবিটা পাঞ্জাবির পকেটে রাইখা মুস্তাফার দিকে আগায়।
-আপনে কই যান বাপজান?
-আও, কাম আসে।
নাজিম মিয়া দ্বিমত করেনা। পকেটে চাবির ঝুনঝুন তালের সাথে মুস্তাফার পিছন পিছন হাঁটতে থাকে। এই অবস্থায় নাজিম মিয়া কেন মুস্তাফার পিছন পিছন হাঁটে, কেন পাশাপাশি হাঁটেনা? কারণ এতক্ষণে মুস্তাফা তার থ্রিকুয়ার্টার প্যান্টের পকেট থাইকা একটা সিগেরেট আর লাইটার বের করে। আর একটু আগে তার হাতে থাকা বাটারবনের টুকরা এলাকার নেরী কুত্তাগুলার দিকে ছুইড়া মারায় সেই কুত্তার পালও মুস্তাফার সাথে অল্প দূরত্ব বজায় রাইখা হাঁটতে থাকে। নাজিম মিয়ার সিগেরেটের ধোঁয়া আর নাপাক প্রাণি কুত্তার সাথে কিছু ঝামেলা আছে। তাই পিছন পিছন হাঁটাই তার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।
নাজিম মিয়ার বয়স পঞ্চাশের উপরে। একটা টমটম খাদে পইরা গেলে যখন একলা ছয় বছরের মুস্তাফারে রাইখা নাজিম মিয়ার আপন বড় ভাই আর ভাইয়ের বউ ইন্তেকাল করে তখন নাজিম মিয়ার জীবনে ব্যাপক টানাটানি। সে তখন বেকার, ভাইয়ের উপরে চলে। এমন অবস্থায় মুস্তাফাকে নিয়া তার নতুন জীবন শুরু হয়। ওই জীবনের গল্প পরে করা যাবে।
মুস্তাফা বেয়াদবের মতো তার পিতৃতুল্য চাচার সামনে সিগেরেট টানলেও চাচার প্রতি তার ভালবাসার কোনো কমতি নাই। আর নাজিম মিয়ারও এই তথ্য জানা, আর সেও মুস্তাফাকে অন্ধের মতো ভালবাসে। সুতরাং নাবালকের বেয়াদবি তার চোখে পরেনা।
এইভাবে হাঁটাতে হাঁটতে ওরা মধ্যপাড়া-উত্তরপাড়া ব্রীজে যায়া দাঁড়ায়। বাতাসে নাজিম মিয়ার টুপি উইড়া যাইতে চায় আর মুস্তাফার সিগেরেট অর্ধেক টাইনা নেয়। কেউ কোনো কথা বলেনা। নাজিম মিয়া বুঝতে পারে মুস্তাফার মন খারাপ। আর মন খারাপের কারণ হইল উত্তরপাড়ার তালিব মাস্টারের ছোট মেয়ে।
– কী হইসে বাপজান? আমারে কও।
– তুমি বুঝবানা, অফ যাও।
নাজিম মিয়া অফ যায়। আর একটু হতাশ হয়। তার বিয়ে না করা নিয়া শ্লীল-অশ্লীল যতরকমের কৌতুক করার মুস্তাফা করে। কিন্তু এর আসল কারণ আন্দাজ করতে পারলেও গল্পটা কেউ জানেনা। নাজিম মিয়া ভাবতে থাকে…
নূরের গল্লির হলুদ বিল্ডিঙটায় তখনও শ্যাওলা পরেনাই। সেই বিল্ডিঙে বড় ভাইয়ের সাথে একটা কম বয়স্ক ছেলে থাকত। সে তখনো আল্লা-খোদা চিনেনাই, শার্ট প্যান্ট পরে। সারাদিন তার ঘুড়াঘুড়িতে কাটে। এমনে ঘুরতে ঘুরতে একদিন তার মাথা ঘুইড়া যায়। মাথা ঘুড়ার কারণ ঘুড়াঘুড়ি না, একটা মেয়ে। মধ্যপাড়ায় নতুন ভাড়াটিয়া, মেয়ের বাপ মধ্যপাড়া সরকারি কলেজের প্রফেসর (বদলি)। মেয়ে ভর্তি হইল মধ্যপাড়া হাইস্কুলে। প্রেমে পরার ঘটনাটা ছিল নাটকীয়। মধ্যপাড়ার মুদির দোকানদার বাতেন মামার সাথে ছেলেটার বিশেষ খাতির ছিল। বিকাল বেলায় কারণে অকারণে বাতেন মামার দোকানে তার রেগুলার আসা যাওয়া ছিল। এক বিকাল বেলায় বাতেন মামা দোকানে নতুন মাল আসায় তার হিসাব মিলাইতে সেইলস্ম্যানের সাথে বাকবিতন্ডায় ব্যস্ত। আর দোকানে ভিতরে অন্যমনষ্ক হয়ে ছেলেটা রেডিওতে গান শুনতে থাকে-লেকে প্যাহলা প্যাহলা পেয়ার। এমন সময় ছেলেটা অদ্ভুত এক মিষ্টি গন্ধ পায়। গন্ধ নেশা ধরানোর মতো। ছেলেটা অবাক হয়। এইটা কিসের গন্ধ? এমন সময় তার মতে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি গলাটা সে শুনতে পায়, “বার্মিজ আচার আছে?”
পিছনে তাকায় দেখে একটা মেয়ে দাঁড়ায় আছে। মেয়েটা, ছেলেটার মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। গাত্রবর্ণ শ্যামলা। গরণ পাতলা, কিন্তু যা আসল ব্যাপার, তা হইল চোখ। মেয়ের চোখে, ছেলেটার মতে, কিজানি একটা ছিল। আর তার চাইতেও বড় ব্যাপার হইল গন্ধ, মেয়েটার গায়ের ওই নেশা ধরানো গন্ধটা। এসব ভাবতে ভাবতে ছেলেটা হাবার মতো তাকায় থাকে।
-বার্মিজ আচার…নাই?
-আছে।
ছেলেটা বয়াম থাইকা চারটা বার্মিজ আচারের প্যাকেট বের করে দেয়। কিন্তু টাকা নিতে চায়না। ছেলের ইচ্ছা দাম সে দিবে, মেয়রে দিতে দিবেনা। এই ঘটনা দেইখা মেয়েটা মুচকি হাসে আর বয়ামের উপরে চারানার একটা পয়সা রাইখা চলে যায়। ছেলেটাও, ইঁদুরের দল যেমন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পিছন পিছন যায়, ঠিক সেইভাবে মেয়েটার পিছন পিছন যাইতে থাকে ওদের বাসার গেইট পর্যন্ত আর মেয়েটা একটু পরেপরে হাসতে থাকে।
এই মেয়েকে দেইখা মাথা আউলায় গেলে ছেলেটা পাগলপ্রায় হয়ে যায়। তার খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়, গলা দিয়া কিছু নামেনা। চোখ বন্ধ করলে মেয়ের চেহারা ভাসে। ঘুমাইলে মেয়েরে স্বপ্ন দেখে। প্রতিদিন মেয়ের সাথে সাথে স্কুল পর্যন্ত যায়, ছুটির পরে আবার বাসা পর্যন্ত, হয় প্রেমের লোভে, নাইলে ওই গন্ধের লোভে। প্রায় প্রত্যেকদিন বিকাল বেলায় ঐ মেয়েটা বাতেন মামার দোকানে যাইত বার্মিজ আচার কিনতে। ছেলেটা চুপচাপ দাঁড়ায় থাকত, গন্ধ নিতো আর দেখত। তাদের চোখাচোখি হইত আর ছেলেটা মরত, একা একা। ছেলেটাযে বিশেষ প্রেমিক টাইপ ছিল তা না, কিন্তু প্রেমে পরায় সে কবিতা লিখতে শুরু করে। ওই কবিতার কাগজ চোখের পানিতে ভিজে।
অবস্থা যখন বেগতিক তখন একটা খারাপ ঘটনা ঘটে। একদিন মেয়েটার হাসি দেখতে দেখতে আর গন্ধ নিতে নিতে বিকাল বেলায় আচার কিনার পরে যখন মেয়েটার প্রায় কাছাকাছি দূরত্বে ছেলেটা হাঁটতে থাকে তখন তারা মেয়েটার বাপের সামনে পরে। ফলে মেয়েটার মুখ থেকে হাসি এবং ঘটনাস্থল থেকে ছেলেটা তৎক্ষণাৎ উধাও হয়া যায়। এর দু’দিন পর বাতেন মামার দোকানে গেলে ছেলেটা লক্ষ্য করে বাতেন মামার মুখটা কালো হয়ে আছে, বাতেন মামা কী যেন বলতে চায়।
-ও মামা, কি হইসে?
বাতেন মামা তার এলাকার আদরের ভাইগ্নারে ভীষণ আদর করত। তাই ভাইগ্নাকে “তুই মামা বিকাল বেলায় আর দোকানে আইসনা” কথাটা বলতে তার বুকটা ফাইটা যায়। ছেলেটা এমন কথা শুনে অবাক হয় এবং জিজ্ঞেস করে-মামা কাহিনী কী?
অনেক জড়াজুড়ির পর মামা আসল ঘটনা জানায়। মেয়েটা সেদিন তার বাপের রাগ থেকে বাঁচতে উলটা বিচার দেয়-বাবা, ওই দোকানের ছেলেটা আমারে রোজ ডিস্টার্ব করে। ছেলেটা এর পরে আর ওই মেয়ের সামনে পরেনাই।
এমন সময় নিঃশব্দে টানা চারটা সিগেরেট শেষ করার পরে মুস্তাফা তার চাচারে বলে- আসো যাইগা। নাজিম মিয়াও হাঁটা শুরু করে। অনেক রাত। বৃষ্টি এখনও নামেনাই। তখনও বাতাস চলে আগের মতোই। পাঞ্জাবির পকেটে চাবির ঝুনঝুন আওয়াজটা এখন একটু বেশীই জোড়ে শোনা যায়।
আর নাজিম মিয়া এখন ওই কাহিনী মনে করে মনে মনে হাসতে থাকে। ওই মেয়ের চেহারাও তার মনে নাই। চোখটা কেমন ছিল তাও খেয়াল নাই। ওই মেয়ের জন্য নাজিম মিয়া আর বিয়ে করেনাই তাও বিস্বাসযোগ্য ঘটনা বলে মনে হয়না। কিন্তু একটা ঘটনা তার জীবনে প্রায়ই ঘটে তা কিন্তু সত্যি। তা হল প্রায়ই অঘুমা রাত কাটানো। রাতে ঘুম না আসার কারন হল গন্ধ। প্রায়ই রাত্রে বেলা একটা মিষ্টি গন্ধে তার ঘুম আসেনা। নাজিম মিয়া প্রায়ই ওই মেয়ের গন্ধ পায়।

Loading

Leave a Comment