শহীদ জননীর গল্প

জাহানারা ইমাম- এক অসাধারণ মমতাময়ী, কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত ‘শহীদ জননী’, কথাসাহিত্যিক এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা, যার সফল নেতৃত্বে পরিচালিত হয় গণআদালত।

দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বময়ী এই মানুষটির জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এক রক্ষনশীল বাঙালি মুসলিম পরিবারে। তিনি বেড়ে উঠেছেন এক অদ্ভুত সমাজে। সামাজিক নানা অনুশাসনের মধ্য দিয়ে কেটেছে তাঁর ছেলেবেলা। তাঁর আত্মজীবনী ‘অন্যজীবন’ বইয়ে কিশোরী জুড়ুর চোখ দিয়ে তিনি দেখেছেন, দেখিয়েছেন সেই সময়ের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিচিত্র সমাজব্যবস্থা।

তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। আর মা হামিদা বানু মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাদের অনুপ্রেরণায় সমাজের সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কিশোরী জুড়ু হয়ে উঠেছিল ‘জাহানারা ইমাম’। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় সাহিত্যনুরাগী শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তিনি তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, ভিক্টর হুগো, সেলমা লেগারলফ, শেক্সপিয়র, বার্নাড শ, ন্যুট হামসনের মত লেখকদের সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা নেহেরুর ‘এ ফাদার্স লেটার টু হিজ ডটার’ জাহানারা ইমামকে মুগ্ধ করে। তিনি জানতে পারেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস, নারীশিক্ষা বিস্তারে বেগম রোকেয়ার সংগ্রামের ইতিহাস। এইসব কিছু তাঁর মনোজগতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে।

এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন, “আধো অস্পষ্টতার মধ্যে আমি বোধহয় সত্যিকারের মানুষ হতে চেয়েছিলাম। বাবা আমাদের Plain living, High thinking-এর কথা বলতেন। অল্প বয়সেই বড় বড় লেখকের বই পড়তাম, বড় বড় লেখকের জীবনী পড়তাম। রবীন্দ্রনাথকে তো হৃদয়েই গেঁথে নিয়েছিলাম। ধর্মীয় গ্রন্থ, বিশেষ করে সুফিদের ওপর পড়াশোনা করতাম। বাউল বৈরাগীদের জীবন আমাকে আকর্ষিত করত। সব খানেই মূল সুর তো আত্মার মুক্তি এবং একই সঙ্গে মানবকল্যাণ। নিজের ঊর্ধ্বে উঠে সবার জন্য ভাবনা।

তিনি যে সবার জন্য ভাবতেন, তাঁর প্রমাণ তাঁর লেখা শেষ চিঠিটি। ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগে তাঁর শেষ চিঠিতে তিনি দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে লিখে গিয়েছিলেন- “মৃত্যুর পথে বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আপনাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই ……………আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা- আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন। এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে……… গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। অবশ্যই, জয় আমাদের হবেই।”

তিনি সত্যিই অন্ধকার সময়কে জয় করে নিজের ঊর্ধ্বে উঠে হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর ব্যক্তিজীবন, সাহিত্যকর্ম আমাদেরকে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়তে বাধ্য করে।

জাহানারা ইমামের স্কুল জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৪২ সালে। ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। ১৯৪৪ সালে সেখান থেকে আইএ এবং কলকাতাঁর লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন তিনি। ১৯৬০ সালে বি.এড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করে ফিরে আসেন ঢাকায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ পাস করেন ১৯৬৫ সালে।

তাঁর কর্মজীবনের প্রথম দিকে ১৯৪৮-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। এরপর ঢাকায় এসে যোগদান করেন সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (১৯৫২-৬০) হিসেবে। ১৯৬২-১৯৬৬ সালে তিনি বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষক এবং ১৯৬৬-৬৮ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তিনি।

১৯৬০ সালে দুই ছেলে রুমী ও জামীর দেখাশোনার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল- শিক্ষক হিসেবে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে তিনি মানুষ করেছেন, এবার তাঁর সন্তানদের গড়ে তোলার পালা। তিনি তাঁর লক্ষ্যে সফল হয়েছিলেন, তাঁর সন্তানদের এক অসাধারণ আদর্শে দড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তাই তো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমী আজ তারুণ্যের প্রেরণা।

একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি এর আহ্বায়ক ছিলেন। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪ টি ছাত্র সংঘটন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির” আহ্বায়ক ছিলেন তিনি।

১৯৮১ সালে জাহানারা ইমামের মুখের ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় সম্ভব হয়েছিলো বলে ডাক্তাররা আশ্বাস দেন যে অস্ত্রোপচার করেই রোগ নির্মূল সম্ভব হবে। কিন্তু প্রথমবার অস্ত্রোপচারের কিছুদিন পরেই মুখের অন্য অংশে ক্যান্সারকোষের উপস্থিতি দেখা দেয়। বারবার কেমোথেরাপী নেয়া, চোয়ালের হাড়ে চিড় সৃষ্টি হওয়া, অসহনীয় কষ্টের পাশাপাশি দেখা দেয় আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ। ক্যান্সারে তাঁর মায়ের মৃত্যু, একাত্তরে বড় ছেলে রুমী আর স্বামী শরীফুল আলম ইমাম আহমেদকে হারানোর দুঃসহ স্মৃতি, মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।কিন্তু ছোট ছেলে জামী, পুত্রবধূ ফ্রিডা, তাঁর ভাই-বোন, শুভানুধ্যায়ী সবার ভালোবাসা, অনুপ্রেরনায় তিনি ক্যান্সারের সাথে লড়াই চালিয়ে যান। এ সময় খলীল জিবরানের কবিতায় তিনি স্বস্তি খুঁজে পান। “তোমার উপলব্ধ্বিকে আবৃত করে রাখে যে শক্ত খোলস, বেদনাই তাকে বিদীর্ণ করে,” “সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার জন্য, ফলের বীজকে বিদীর্ণ হতে হয়, বেদনা তোমার জন্য তাই”- পঙক্তিগুলো তাকে সান্ত্বনা জোগায়, স্বস্তি এনে দেয়।

ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ের এই গল্প তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর “ক্যান্সারের সাথে বসবাস” বইটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসারত অবস্থায়ই তিনি একাত্তরের দিনগুলি, বীরশ্রেষ্ঠ, অন্যজীবন এই অসাধারণ বইগুলো লেখেন। এরপর দ্রুত তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। সব ধরণের খাবার গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। ২৬জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়েসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রিয় জাহানারা ইমাম। জাতীয় ঈদ্গাহ ময়দানে নামাযে জানাজার পর শহীদ জননীকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের ৮ জন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।

বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি ছিলো তাঁর। ১৯৯০ এর ডিসেম্বরে তিনি লিখেছিলেন – “এখন আমি ২০০০ সালের দিকে তাকিয়ে আছি। অতোদিন বাঁচবো কি? এখন আমি বাঁচতে চাই। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য আরো লিখে যেতে চাই!” তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়ের সম্পর্কে বলেছিলেন, “তারা আমাকে ঘিরে রাখে। তাদের জন্যই আমি এই বৃদ্ধ বয়সে একাকী বাস করেও কখনো নিঃসঙ্গবোধ করিনা। তাদের আগ্রহে জ্বলজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আরো বাঁচার, আরো লিখে যাবার প্রেরণা পাই।“

জাহানারা ইমাম আমাদের জন্য লিখে গেছেন অনবদ্য সব বই- একাত্তরের দিনগুলি, বীরশ্রেষ্ঠ, অন্যজীবন, জীবন্মৃত্যু, বুকের ভেতর আগুন, প্রবাসের দিনলিপি, দুই মেরু, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, বিদায় দে মা ঘুরে আসি (একাত্তরের দিনগুলির কিশোর সংস্করণ), অনুবাদ করেছেন জাগ্রত ধরণী, তেপান্তরের ছোট্ট শহর, নদীর তীরে ফুলের মেলা। তাঁর লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭), রোকেয়া পদক (১৯৯৮), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) সহ অসংখ্য সম্মাননা। বাংলা ১৪০১ সনে দৈনিক আজকের কাগজ তাঁকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কারে ভূষিত করে।

তবে তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন অগণিত ভালোবাসা। প্রিয় এই মানুষটির আজ জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি জানাই বিন্ম্র শ্রদ্ধা। আমাদের অনুপ্রেরণা উৎস হয়ে থাকবেন অনন্তকাল- শুভ জন্মদিন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম!

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment