নীল-গোলাপীর ফ্যাশনের ইতিহাস

আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করি তারা প্রায়শই এমন ধরণের ট্রল দেখতে পাই যেখানে লেখা থাকে, একটি মেয়ে দোকানে গিয়ে বলছে পিংক কালারের বাংলাদেশের পতাকা দিতে, অথবা মেয়েটির কোনো এক ছেলে বন্ধু নিজের নতুন কেনা ল্যাপটপের ব্যাপারে আলাপ করলে মেয়েটি বলে তার ল্যাপটপ পিংক কালারের। এটা এমনভাবে বলা হয় যেন পিংক বা গোলাপী একটি খোঁড়া এবং হাস্যকর রঙ, এটি পছন্দ শুধু মেয়েরাই করতে পারে(!)। কিন্তু আসলেই কি তাই? মেয়েরা কি আসলেই জন্মগতভাবে গোলাপী রঙের প্রতি আসক্ত? আর নীল মানেই কি খুব ‘Classy’ রঙ? ছেলেদের জন্য মানানসই? ছেলেরা গোলাপী পড়লেই সে গে অথবা ক্ষ্যাত? অনেক মেয়েকেই দেখি গর্ব করে, নিজেকে অন্য মেয়েদের থেকে কুল ভাবার জন্য গোলাপী রংকে এড়িয়ে চলে। এটা খুবই হাস্যকর। আর ছেলেরা? গোলাপী দেখলে উল্টো দিকে দৌড় লাগায়।

রঙের বেলায় লিঙ্গ বৈষম্য আর কারো কাছে না হোক, অন্তত আমার কাছে খুবই হাস্যকর। ফ্যাব্রিক কালার নিয়ে এ ধরণের বৈষম্য আগে ছিল যুগের দাবী। কিন্তু এই পোশাকের রঙটিই আজ পরিণত হয়েছে সমগ্র নারীসমাজকে হেয় প্রতিপণ্য করার এক অতুলনীয় অস্ত্রে। আমার মা গত বছর পূজায় আমায় একটি গোলাপী থ্রি-পিছ স্যুট কিনে দেয়। স্যুটটা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। সেটি পড়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার হিসেবে সেট করার আধ ঘন্টার মধ্যেই ইনবক্সে জনাকতক গাধারা গাদাগাদি করা আরম্ভ হলো। তাদের মেসেজগুলো ছিল অনেকটা এরকম,“কিরে প্রথা, তুই তো অনেক কুল! তুই তো টিপিক্যাল মেয়েদের মত না! তাইলে তুই গোলাপী জামা পড়লি কেন ব্রো?!” মেসেজগুলো পড়ে আমার হাসি পেলো। এরা বলে কি? গোলাপী মানেই টিপিক্যাল মেয়েদের রঙ? কেনো কেনো? আর যদি হয়েও থাকে তাতে দোষ কি? গোলাপী কি খুব খারাপ রঙ? টিপিক্যাল মেয়ে কি মানুষ নয়? সে কি কুল হতে পারে না? গোলাপী মানে খ্যাত বিশ্রী? তোমাদের আরেকটা ঘটনা বলি। ২ মাস আগে আমার ক্লাস টু পড়ুয়া একমাত্র মামাত ভাইকে আমার মা আদর করে একজোড়া গোলাপী কনভার্স কিনে দেয়। সে এগুলো পড়ে ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে তাকে নিয়ে হাসিতামাশা শুরু হয়। একারণে সে আর জুতোগুলো পড়েনি। গোলাপী রংটাকে মানুষ কেন এভাবে দেখে তার আসল কারণ শুনলে তোমাদেরও হাসি ছাড়া উপায় থাকবেনা।

মানুষের জন্মগত স্বভাব হলো তাঁরা সমাজবদ্ধ জীব। এ কারণে সমাজে কোনো ট্রেন্ড শুরু হলে মানুষকেও সেটা ফলো করতে হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে কোনো একটি রুমে যদি দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশনা দিয়ে ৯ জনকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এবং নির্দেশনা না দিয়ে ১ জনকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তবে সেই একজনও বাকি ৯ জনের দেখাদেখি দাঁড়িয়ে থাকবে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি মানুষ স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দিতে ভালোবাসে। বিশেষ করে তখন যখন কোনো বড় মাপের কেও একজন তাদের কোনো কিছু করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝের দিকে নীল-গোলাপী ট্রেন্ডের শুরু। প্রথমে কিন্তু এই রঙগুলো লিঙ্গভেদে ব্যবহৃত হতো না। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ জো বি, পাওলেটি তাঁর লেখা ‘পিংক এন্ড ব্লু; টেলিং দ্য গার্লস টু দ্য বয়েজ ইন আমেরিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এ রঙগুলো প্রথমে এসেছিলো শিশুদের জন্য। বিশেষ করে নীল রঙের জামা নীল চোখের শিশুদের পড়ানো হতো। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের মায়েরা শিশুদেরকে ছ’বছর বয়স পর্যন্ত সাদা জামা পড়াতো। তারা অন্য কোনো চড়া রঙ শিশুদেরকে পড়াতো না কারণ তারা মনে করতো ভুলরঙের জামা পড়ালে তাদের সন্তানরা বড় হবে ভুল পথে। বোস্টনের একটি পোশাকের ব্র্যান্ড, ফিলেন’স, এই সাদা রঙের পরিবর্তন আনতে শিশুদের জন্য আনে নীল এবং গোলাপী রঙ। বিক্রি প্রথমের দিকে ভালো না হলে তারা বুদ্ধি করে মায়েদেরকে উপদেশ দেয় ছেলেদের নীল এবং মেয়েদের গোলাপী রঙের জামা পড়াতে। এতে তাদের বিক্রি বেড়ে যায়। ছোট মেয়ে এবং ছেলে শিশুদের গায়ে ক্রমশ সোভা পেতে থাকে গোলাপী এবং নীল জামা। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে এই ট্রেন্ডটা ছড়িয়ে পড়ে বড়দের বেলায়ও। এবং তা ক্রমশ হয়ে পড়ে লিঙ্গ বৈষম্যের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

মূলত ফিলেন’স এর ষড়যন্ত্রেই আজ পোশাকের রঙে এমন বৈষম্য দেখা দিয়েছে। গোলাপী বা নীল কোনো রঙের প্রতিই মেয়েরা বা ছেলেরা জন্মগত আসক্তি নিয়ে বড় হয় না। এটি হলো একটি সামাজিক স্রোত, যাতে তারা গা ভাসিয়ে দেয়। ১০০ বছর প্রায় হয়ে গেছে এই ফ্যাশনের বয়স। এখন হয়তো আমাদের সময় হয়ে এসেছে এটি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আসার।

লেখক: শিক্ষার্থী, কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।

Loading

Leave a Comment