কৃষ্ণ-দাসী মীরা

মীরা বাঈ ছিলেন বৈষ্ণবীদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা সন্ন্যাসী যিনি ছিলেন কৃষ্ণ-প্রেমিক এবং কৃষ্ণকে স্বামী হিসেবে মানতেন। কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে তিনি পাঁচ সহস্রাধিক ভজন রচনা করেছেন যা আজও অমর হয়ে রয়েছে প্রেম এবং প্রার্থনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণের সাহিত্য হিসেবে। মীরা বাঈকে নিয়ে কাকাড্ডা ডট কমে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী তাসফিয়া ফারাহ। 

কৃষ্ণ প্রেমে পাগলিনী রাধিকার কথা আমরা সবাই জানি। তবে সেই রাধা আর কৃষ্ণের অস্তিত্ব তো ছিল কেবল পুরাণে, বাস্তবেও কৃষ্ণের জন্য রাধার মত আরেক পাগলিনী রাই ছিলেন যাঁর জন্ম ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রাজস্থানে । সনাতন ধর্মে “বৈষ্ণববাদ” বলে একটি ধারা প্রচলিত আছে। এই ধারার অনুসারীরা কৃষ্ণ-ভক্ত বা শ্রীকৃষ্ণের পূজারী। তাদের মতে কৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর বা পরম পুরুষ আর রাধা হলেন নারী বা সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতীক। বৈষ্ণব মতাবলম্বীদের মাঝে অনেক নামকরা সাধু-সন্ন্যাসীরা আছেন যাদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন মীরা বাঈ। কৃষ্ণকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন ভাষা যেমন সংস্কৃত, রাজস্থানী, হিন্দী প্রভৃতিতে রচনা করেছিলেন প্রায় ৫ হাজার গান যেগুলো মীরার ভজন নামে পরিচিত। এসব রচনায় ফুটে উঠেছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তার পতিভক্তি (মীরা মনে মনে একমাত্র কৃষ্ণকেই স্বামী হিসাবে মানতেন), প্রভুভক্তি।

মীরা যখন খুব ছোট ছিলেন তখন বিয়ের পোশাক পরে তিনি মাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, আচ্ছা মা, কার সঙ্গে আমার বাসর হবে? তখন মা তাকে মজা করে বলতেন, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে! তখন থেকেই তার মনের ভেতর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে জগৎ সৃষ্টি হয়। এরপরে তার মাত্র ৮ বছর বয়সে মেয়রের রাজপুত্র রানাকুম্ভ বা কুম্ভরানার সাথে তার বিয়ে হয় । তিনি বাসর রাতেই স্বামীকে জানিয়ে দেন তার কৃষ্ণভক্তির কথা। স্বামী বিষয়টি যেমন ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি, তেমনি পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করেন। নানাভাবে জ্বালাতন করতেন, অপবাদ দিতেন। কিন্তু মীরা এর প্রতিবাদ করতেন না। বরং তাদের সঙ্গে কথা বলতেন নিচু স্বরে; আস্তে আস্তে পরিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায়। তিনি গান লিখতেন ও গাইতেন ওই ভাষাতেই। সে যাই হোক। আঠারো বছর বয়সে মীরা আবার বিয়ে হয়। স্বামী চিতরের রাজা ভোজরাজ। মীরার উপর নির্যাতন তো কম হয়নি! তার স্বামীর মৃত্যুর পর তার শ্বশুরবাড়ির কালী উপাসকেরা তার এই প্রবল কৃষ্ণভক্তিতে এতটাই রুষ্ট ছিল যে তাকে বিষ দিয়ে এবং ফুলের ঝুড়িতে সাপ দিয়ে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু মীরার তাতে কিছুই হয়নি। মীরা এক মনে জপ করে চলেছেন – “কৃষ্ণজী, কৃষ্ণজী!”

মীরার মত কবিদের ডাকা হয় একটি গালভরা নাম ধরে – “অতীন্দ্রিয়বাদী কবি” বা “Mystic poet”। উনারা বিশ্বাস করেন স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। ইসলাম ধর্মে যেমন “সুফীবাদ”, সনাতন ধর্মে “বৈষ্ণববাদ”। ফার্সি ভাষায় যেমন রুমি, ইংরেজি ভাষায় তেমনি এমিলি ডিকিনসন। আবার ফিরে আসি মীরা বাঈয়ে। তার বিশেষত্ব ছিল যে তিনি কৃষ্ণকে মানতেন তার স্বামী এবং প্রেমিক পুরুষ হিসেবে। তাঁর অনেক ভজনের শেষে “মীরা কি প্রভু গিরিধর নাগর” কথাটির উল্লেখ রয়েছে। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত প্রধানত খেয়াল, ঠুমরি ছাড়াও উনিশ শতকের বহু চলচ্চিত্রের গানে বিরহের আবহ তৈরি করতে মীরার ভজন ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও এগুলো প্রার্থনা সংগীত, তবুও তা প্রেম এবং প্রার্থনাকে একীভূত করে। বিরহের বেদনাকে ঘনীভূত করার জন্য এসব চলচ্চিত্রে মীরার ভজন ব্যবহারের জুড়ি নেই। অনেক প্রাচীন আমলের গান বলে এগুলোর প্রকৃত সুর খুঁজে পাওয়া যায় না। চলচ্চিত্রের সুরকারেরা নতুন করে সুরারোপ করে এ সকল গান চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন অলংকার হিসেবে। মীরা বাঈয়ের সঙ্গে সুরসম্রাট ও বুলবুল-ই-হিন্দ মিয়াঁ তানসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানা যায়। মীরা তানসেনের শিষ্যা ছিলেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের পর মীরার ভজনের লিরিক্সের পাশাপাশি সুরেও যুক্ত হয় অধিকতর নিষ্ঠা ও আবেদন। কৃষ্ণের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও বিরহের যন্ত্রণা ঝরে ঝরে পড়তো তাঁর গানের বাণী ও সুরে।

বীণা হাতে নিয়ে তিনি কৃষ্ণের প্রতি ভক্তিমূলক গান গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় নেচে বেড়াতেন। তাঁর ভাষায় –

https://www.high-endrolex.com/48

“সাজি শৃঙ্গার বালি পাগ ঘুঙ্গরু লোক লাজ ত্যাজি নাচি।”

মীরা কোনো পৌরাণিক চরিত্র নন তবুও তাকে নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। বলা হয় যে তিনি কৃষ্ণের মন্দিরের সামনে গান গাইতে গাইতে কৃষ্ণের মূর্তির মাঝে বিলীন হয়ে গেছেন। শেষের বছরগুলোতে সন্ন্যাসীনি হয়ে গুজরাটের দ্বারকায় মীরাকে দেখা গিয়েছিল। তিনি ১৫৪৬ সালে সেখানেই মাত্র ৪৭/৪৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এবং অমর করে গেলেন কৃষ্ণের প্রতি তার ভালোবাসাকে –

“এরি ম্যাঁয় তো প্রেম দিওয়ানী মেরা দর্দ না জানে কোয়ে।”

লেখক : শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Loading

Leave a Comment